বাংলার মপাসাঁ : প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়


বাংলার মপাসাঁ : প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়
--------------------------------
জন্ম:---১৮৭৩ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি।
মৃত্যু--১৯৩২ সালের ৫ ই এপ্রিল।
জন্মস্থান:- বর্ধমান জেলার ধাত্রীগ্রামে
পৈতৃক নিবাস - পশ্চিম বঙ্গের হুগলী জেলার গুরাপ গ্রামে।
পিতার নাম -- জয়গোপাল মুখোপাধ্যায় ও মাতার নাম-- কাদম্বরী দেবী।
বাংলা উপন্যাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী বাঙালি কথাসাহিত্যিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। প্রভাতকুমার বিশেষ সিদ্ধি অর্জন করেছিলেন ছোটোগল্প-রচনায়। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের পরেই তাঁর স্থান স্বীকৃত হয়েছিল। তিনি বাস্তব পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, কিন্তু তার গভীরে প্রবেশ করেননি, এমন কথা বলা হয়ে থাকে। তবে দেশ ও বিদেশের পটভূমিকায় তিনি বহু ঘটনা ও চরিত্র এমনভাবে স্থাপিত করেছেন যাতে তারা প্রাণের স্পর্শ লাভ করেছে। সরল,অনাবিল হাস্যরসের গল্প লেখক রূপেই সমধিক প্রসিদ্ধ| কেরানি থেকে হন ব্যারিস্টার,পরে পত্রিকা সম্পাদক এবং শেষ জীবন কাটে অধ্যাপনায়| সম্পাদিত পত্রিকার নাম 'মানসী' ও' মর্মবাণী'| ১৪ বছর ধরে পত্রিকাটি সুষ্ঠভাবে চালিয়েছেন|
রবীন্দ্র সমকালের একজন ছোটগল্পকার হয়েও গল্প সাহিত্যের আকাশে তিনি স্বমহিমায় উজ্জ্বল । মূলত ছোটগল্পকার হিসাবেই তাঁর খ্যাতি। রবীন্দ্র সমকালেই তার ছোটগল্প রচনা শুরু।সমকালীন লেখক হলেও দুজনের মধ্যে পার্থক্য অনেক।রবীন্দ্রনাথ মুখ্যত কবি,প্রভাতকুমার সেখানে মূলত কথাবিদ।রবীন্দ্র
নাথের বেশিরভাগ ছোটগল্পগুলো যেখানে কল্পনাভূমিষ্ঠ ,প্রভাত কুমারের লেখা সেখানে বাস্তবসত্যে নিষ্ঠাবান।তাঁর লেখা জীবনের আত্মস্বরূপ প্রকাশ পরায়ণ।তাঁর গল্পের প্রাথমিক আবেদন গল্পের মধ্যেই।ভাবাত্মা তাঁর গল্পদেহে অনুবিষ্ঠ নয়,গল্পদেহেই তার উদ্ভব।তাঁর রচনা পরিদৃশ্যমান জীবনের পরিছন্ন অনুকৃতি।
তাঁর সম্পর্কে জগদীশ ভট্টাচার্য্য মহাশয় বলেছেন,---"উৎসমুখে আধুনিক বাংলা ছোটগল্প গঙ্গা-যমুনার যুগল ধারায় প্রবহমান রবীন্দ্রনাথ ও প্রভাত কুমার।রবীন্দ্র-কবিমানসের স্বমন্দাকিনীই ছোটগল্পে মর্ত্যভাগীরথীরূপে মানুষের আনন্দ-বেদনায় কলনাদিনী,তাই তার পাবনপ্রবাহে মৃতপুত্তলিকাও ক্ষণে ক্ষণে দেবতার অমর মহিমায় দীপ্তিমান।প্রভাত কুমারের যমুনা মৃত্যুসহোদরা কালিন্দী, তার নির্মল নীলাভ জলে পার্থিব জীবনেরই স্বমহিমছায়া প্রতিবিম্বিত।তার কূলে কূলে হৃদয়বৃন্দাবনে না প্রেমের বংশীধ্বনি ওঠে তাও জন্মমৃত্যুশাসিত মরজীবনেরই প্রাণবায়ুতে নিঃশ্বসিত। "
সমকালীন জনপ্রিয়তায় প্রভাতকুমার ' বাংলার মপাসাঁ ' বলে খ্যাত হোন। জগদীশ ভট্টাচার্য্য বলেছেন--" মপাসাঁ র মতোই প্রভাত কুমার ছোটগল্পের রূপদক্ষ শিল্পী। মপাসাঁ 'র মতোই প্রভাতকুমার জীবনের ভাষ্যকার নন,উন্মেষকার। "
সরল ও অনাবিল হাস্যরসের গল্পলেখক-রূপেই তাঁর খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা। সাধারণ আটপৌরে জীবনের লঘু ও দুর্বল দিক তাঁর গল্পে হাস্যরসচ্ছটাযোগে উপস্থাপিত। বাংলা ছোটগল্পকারদের মধ্যে তিনিই প্রথম যাঁর গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ হয়ে বিদেশে প্রচারলাভ করেছে | তাঁর গল্পগুলি কাহিনীপ্রধান এবং সুখপাঠ্য। ছোটগল্পে তিনি যতখানি সফল, উপন্যাসে ততটা নন । তাঁর গল্পের সরসতা অনেক সময়ে প্রকাশলাভ করেছে রঙ্গ ও ব্যঙ্গের মধ্য দিয়ে, তাই বলে গুরুতর ও বেদনাবহ গল্প যে তাঁর নেই, তা নয়।
১৮৯৭ সালে রাধামণি দেবী ছদ্মনামে ছোটোগল্প লিখে প্রথমবারের কুন্তলীন পুরস্কার লাভ করেন ।
গল্প সংকলন:-- প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা গল্পের মোট সংখ্যা হলো ১০৮ টি। এই গল্পগুলি মোট ১২ টি গল্প সংকলনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তাঁর এই গল্পসংকলন গুলো হলো--
১) ' নবকথা' (১৮৯৯)
২) 'ষোড়শী' (১৯০৬)
৩) ' দেশি ও বিলাতি'(১৯০৯)
৪) 'গল্পাঞ্জলি' (১৯১৩)
৫) ' গল্পবিথী'(১৯১৬)
৬) 'পত্রপুষ্প'(১৯১৭)
৭) 'গহনার বাক্স ও অন্যান্য গল্প'(১৯২১)
৮) 'হতাশ প্রেমিক ও অন্যান্য গল্প' (১৯২৪)
৯) 'বিলাসিনী ও অন্যান্য গল্প'(১৯২৬)
১০) 'যুবকের প্রেম ও অন্যান্য গল্প'(১৯২৮)
১১) 'নতুন বউ ও অন্যান্য গল্প'(১৯২৯)
১২) 'জামাতা বাবাজী ও অন্যান্য গল্প'(১৯৩১)
জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাই প্রভাত কুমারের ছোটগল্পগুলোকে এক অনন্য মাত্রা দান করেছে। বাঙালি জীবনের দুঃখ সুখের জীবন দোলার ছন্দে প্রভাত কুমারের গল্পগুলো এক নতুন জীবন পেয়ে সার্থক হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখা পড়ে অভিভূত রবি ঠাকুর এক চিঠিতে তাঁকে লিখেছিলেন --" তোমার গল্পগুলি ভারি ভালো।হাসির হাওয়ায় কল্পনার ঝোঁকে পালের উপর পাল তুলিয়া একেবারে হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিতেছে ,কোথাও কিছুমাত্র ভার আছে বা বাধা আছে তাহা অনুভব করিবার জো নাই ।"
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছোট গল্প:---
'দেবী'---- 'ভারতী' পত্রিকায় ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়।
'বলবান জামাতা'----'প্রবাসী' পত্রিকায় ১৩১৩ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়।
'রসময়ীর রসিকথা'--- হাস্যরসে পরিপূর্ণ এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'প্রবাসী' পত্রিকায় ১৩১৬ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যায়।
' আদরিণী' ----একটি অবোলা জীব হাতী কে নিয়ে লেখা এই গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় 'সাহিত্য' পত্রিকায় ১৩২০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র সংখ্যায়।
ঔপন্যাসিক প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
------------------------------
প্রভাতকুমারের উপন্যাস সম্পর্কে সমালোচকেরা সাধারণত একমত যে, তাঁর ছোটোগল্পের শিল্পচাতুর্য তাঁর উপন্যাসে নেই। তিনি জীবনকে দেখেছেন উপর থেকে, জীবনের গভীরতায় প্রবেশ করেননি। তাই এতে যত ঘটনা আছে বা চরিত্র আছে, তুলনায় তার তাৎপর্য বিশ্লেষণ নেই, অনেক সময়ে ধারাবাহিকতা নেই। তাঁর উপন্যাসে নাটকের গুণ আছে, উপন্যাসের সমগ্রতা অনুপস্থিত। ‘তিনি প্রথম শ্রেণীর ঔপন্যাসিক নহেন’ একথা বলেও শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, "জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে বাংলা উপন্যাসে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী"।
প্রভাত কুমার মোট ১৪ টি উপন্যাস রচনা করেন।
১) 'রমাসুন্দরী'(১৯০৮)--প্ৰথম লেখা উপন্যাস। ' ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত।
২) 'নবীন সন্ন্যাসী'(১৯১২)
৩) 'রত্নদীপ'(১৯১৫)--- প্রভাত কুমারের লেখা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।
৪)' জীবনের মূল্য'(১৯১৭)
৫)'সিন্দুর কৌটা'(১৯১৯)
৬) 'মনের মানুষ'(১৯২২)
৭) 'আরতি' (১৯২৪)
৮) 'সত্যবালা '(১৯২৫)
৯) 'সুখের মিলন'(১৯২৭)
১০)'সতীর পতি'(১৯২৮)
১১)'প্রতিমা'(১৯২৯)
১২) 'বিদায় বাণী'(১৯৩৩)
১৩)'গরীব স্বামী'(১৯৩৮)
১৪) 'নবদুর্গা'(১৯৩৮)

আলোচনায় ---অমিয়তোষ ঘোষ
আলোচনা সহায়তায় গ্রন্থঋণ---
' প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প' ---জগদীশ ভট্টাচার্য

Share this