বাংলা ব্যাকরণ- সমাস


বাংলা ব্যাকরণ- সমাস
সমাস = সম-অস্ + অ ( ঘঞ্ )  
** 'সমাস' শব্দের অর্থ 'সংক্ষেপ' | 
সংজ্ঞা - পরপর অর্থ সম্বন্ধ যুক্ত দুই বা ততোধিক পদ মিলিত হয়ে এক পদে পরিণত হলে ,তাকে সমাস বলে | 
যেমন - ইন্দ্রকে জয় করেছে যে = ইন্দ্রজিত | 
সমাস সৃষ্টির শর্ত:- 
1) দুই বা তার বেশি পদের অস্তিত্ব |
2) একাধিক পদের একপদে মিলিত হওয়ার উপকরণের সহাবস্থান |
3) বক্তব্যকে সংক্ষেপে ও সুন্দরভাবে উপস্থাপন | 

সমাস-সম্পর্কিত কিছু বিষয়:
ক) সমস্তপদ:-- সমাস-জাত পদ অর্থাত্ একপদীকরণের ফলে উতপন্ন পদকেই সমস্তপদ / সমাসবদ্ধ পদ বলে | 
যেমন:-- গায়েহলুদ, রাজপথ, প্রতিদিন  | 
খ) পূর্বপদ ও উত্তরপদ :-  সমস্তপদের পূর্বাংশের নাম পূর্বপদ |
শেষ অংশের নাম উত্তরপদ / পরপদ | 
যেমন:- 'বীণাপাণি' সমস্ত পদটিতে 'বীণা' পূর্বপদ ও 'পাণি' পরপদ / উত্তরপদ | 
গ) সমস্যমান পদ :- যে পদগুলো মিলিত হয়ে সমস্তপদটি গঠিত হয়, তাদের প্রত্যেকটিকে সমস্যমান পদ বলে | 
যেমন:- পথের রাজা ( 2 টি সমস্যমান পদ ) 
ঘ) ব্যাসবাক্য / বিগ্রহবাক্য / সমাসবাক্য :- সমস্ত পদটিকে বিশ্লেষণ করে, সমাসের অর্থটি যে বাক্য বা বাক্যাংশ দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়,তাকে ব্যাসবাক্য বলে | 
যেমন:- যিনি রাজা তিনিই ঋষি , চতুঃ অঙ্গের সমাহার, জানা ও অজানা | 

::সমাসের শ্রেণীবিভাগ ::
সমাসের তিনটি প্রধান বিভাগ হল--- 
1) সংযোগমূলক সমাস :-- এই প্রকার সমাসে সমস্যমান পদগুলির দ্বারা দুই বা ততোধিক পদার্থের ( ভাবের বা বস্তুর ) সংযোগ প্রকাশ পায় | 
যেমন-- দ্বন্দ্ব সমাস  | 
2) ব্যাখ্যানমূলক / আশ্রয়মূলক সমাস ::- 
 এই প্রকার সমাসে প্রথম শব্দটি দ্বিতীয় শব্দটিকে আশ্রয় করে থাকে বা তার বিশেষণ রূপে বসে |
যেমন:- ততপুরুষ সমাস , কর্মধারয় সমাস, দ্বিগু সমাস | 
3) বর্ণনামূলক সমাস :::- সমস্যমান পদগুলি একত্রে মিলিত হয়ে অন্য কোনো ভিন্ন অর্থের প্রকাশ করে |
যেমন:- বহুব্রীহি সমাস |
সব মিলিয়ে আলোচনার সুবিধার্থে আমরা সমাসকে নিম্নলিখিত ভাবে ভাগ করে বিশ্লেষণের চেষ্টা করব ----- 
1) দ্বন্দ্ব সমাস
2) দ্বিগু সমাস
3) কর্মধারয় সমাস
4) ততপুরুষ সমাস
5) বহুব্রীহি সমাস
6) অব্যয়ীভাব সমাস
7) অলোপ/অলুক সমাস 
8) নিত্য সমাস 
9) বাক্যাশ্রয়ী সমাস | 

** বিভিন্ন সমাসে বিভিন্ন পদের অর্থপ্রাধান্য ::
ক) পূর্বপদের অর্থপ্রাধান্য = অব্যয়ীভাব সমাস
খ) পরপদের অর্থপ্রাধান্য = ততপুরুষ সমাস, কর্মধারয় সমাস, দ্বিগু সমাস | 
গ) উভয় পদের অর্থপ্রাধান্য = দ্বন্দ্ব সমাস | 
ঘ) অন্যপদের অর্থপ্রাধান্য = বহুব্রীহি সমাস | 

* দ্বন্দ্ব সমাস *
সংজ্ঞা::-- যে সমাসে প্রত্যেকটি সমস্যমান পদের অর্থ প্রধানভাবে বোঝায় |
* 'দ্বন্দ্ব' শব্দের অর্থ 'জোড়া' |
** এই সমাসে ব্যাসবাক্যে সমস্যমান পদগুলি ও, এবং,আর প্রভৃতি দিয়ে যুক্ত থাকে |
** এই সমাসে যে পদটি বানানে / উচ্চারণে অপেক্ষাকৃত ছোট , স্ত্রীলিঙ্গ পদ, পূজনীয় ব্যক্তি --সেটি আগে বসে | তবে ব্যতিক্রম ও আছে |
** দ্বন্দ্ব সমাসের দৃষ্টান্ত ::: -
1) বিশেষ্য-বিশেষ্য দ্বন্দ্ব -- সমস্যমান পদগুলি সব বিশেষ্য হয় |
উদাহরণ--
রবি ও শশী = রবিশশী
ভাই আর বোন = ভাইবোন
কায়, মনঃ ও বাক্য = কায়মনোবাক্য
2) বিশেষণ-বিশেষণ দ্বন্দ্ব -- এখানে একাধিক বিশেষণ , বিশেষ্যবত্ ব্যবহৃত হয় |
উদাহরণ--
হিত ও অহিত= হিতাহিত
নরম ও গরম = নরমগরম
গত ও আয়াত = গতায়াত
3) সর্বনামের দ্বন্দ্ব-- একাধিক সর্বনাম পদের একপদীকরণ হয় এখানে |
উদাহরণ--
আমি ও তুমি = আমি-তুমি
যাকে ও তাকে = যাকে-তাকে
4) ক্রিয়ার দ্বন্দ্ব-- একাধিক ক্রিয়াপদের সমাসবদ্ধ পদে রূপান্তরিত করা হয় |
উদাহরণ--
হাসি ও খেলি = হাসিখেলি
ছুঁয়ে আর ধরে = ছুঁয়েধরে
চলো ও ফেরো = চলোফেরো
5) প্রায় সমার্থক শব্দের দ্বন্দ্ব-- সমস্যমান পদগুলি প্রায়-সমার্থক হয় |
উদাহরণ--
আদর ও অভ্যর্থনা = আদর-অভ্যর্থনা
মান ও ইজ্জত= মানইজ্জত
আদব আর কায়দা = আদবকায়দা
হাসি ও ঠাট্টা = হাসিঠাট্টা
6) সমার্থক শব্দের দ্বন্দ্ব-- সমস্যমান পদগুলি পরস্পর সমার্থক হয় |
উদাহরণ--
ছাই ও ভস্ম = ছাইভস্ম
দয়া আর মায়া = দয়ামায়া
পাহাড় এবং পর্বত = পাহাড়-পর্বত
7) বিপরীতার্থক শব্দের দ্বন্দ্ব -- সমস্যমান পদগুলি পরস্পর বিপরীত অর্থ বহন করে |
উদাহরণ--
আদি ও অন্ত = আদ্যন্ত
বাঁচা আর মরা = বাঁচামরা
অগ্র ও পশ্চাত = অগ্রপশ্চাত
পাপ এবং পূণ্য = পাপ-পূণ্য
8) একশেষ দ্বন্দ্ব-- সমস্যমান পদগুলি সমাসবদ্ধ হয়ে বহুবচনান্ত একটি পদে পরিণত হয় |
উদাহরণ--
আমি, তুমি ও সে = আমরা (বহুবচন )
তুমি ও সে = তোমরা ( বহুবচন ) |

:: কর্মধারয় সমাস::
সংজ্ঞা::-- যে সমাসে পূর্বপদ পরপদের বিশেষণ রূপে বসে এবং পরপদের অর্থ ই প্রধানভাবে প্রকাশ পায়, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে |
** 'কর্মধারয়' শব্দের অর্থ 'কর্ম' বা 'বৃত্তি' ধারণকারী |
এই সমাসে বিশেষ্য-বিশেষ্য , বিশেষণ-বিশেষণ , বিশেষণ-বিশেষ্য --- সকল পদের সংযোগে সমাস হয় |
** প্রকারভেদ --
1) সাধারণ কর্মধারয় সমাস
2) মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস
3) উপমান কর্মধারয় সমাস
4) উপমিত কর্মধারয় সমাস
5) রূপক কর্মধারয় সমাস

সাধারণ কর্মধারয় সমাস ::::
অ) বিশেষ্য+ বিশেষ্য :--
এখানে দুটি বিশেষ্য পদ যোগে একটি বিশেষ্যপদ ই তৈরী হবে সমাসবদ্ধ পদ হিসেবে |
যেমন:--
জ্ঞাতি যিনি শত্রুও তিনি = জ্ঞাতিশত্রু
যিনি রাম তিনিই কৃষ্ণ = রামকৃষ্ণ
যিনি রাজা তিনিই ঋষি = রাজর্ষি
আ) বিশেষণ + বিশেষণ :--
এই সমাসে দুটি বিশেষণ ই একসঙ্গে একই ব্যক্তি/ বস্তু তে উপস্থিত বোঝাবে |
যেমন--
কাঁচা অথচ মিঠে = কাঁচামিঠে ( একটি ফল)
আগে ধোয়া পরে মোছা = ধোয়ামোছা ( একটি স্থান )
ই) বিশেষণ + বিশেষ্য ::-
এখানে বিশেষ্য ও বিশেষণ পদ পূর্বপদ - পরপদ রূপে বসে একই ব্যক্তি / বস্তু কে প্রকাশ করে |
যেমন:-
সাধারণ যে জন = জনসাধারণ
পাণ্ডু ( খসড়া ) যে লিপি = পাণ্ডুলিপি
প্রিয় যে সখা = প্রিয়সখ
মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস ::::
এই কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যে অবস্থিত পদ লোপ পায় |
যেমন:--
জীবনহানির আশঙ্কায় বীমা = জীবনবীমা
আক্ষেপ- দ্যোতক অনুরাগ = আক্ষেপানুরাগ
ছাত্র থাকাকালীন জীবন = ছাত্রজীবন
সিঁদুর রাখিবার কৌটা = সিঁদুরকৌটা
** মনে রাখার বিষয় :--
ততপুরুষ সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত বিভক্তি-স্থানীয় অনুসর্গ লোপ পায় | আর মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাসে অনুসর্গ নয়, কোনো পদের লোপ ঘটবে |
 উপমান কর্মধারয় সমাস ::::
উপমানের ( যার সাথে তুলনা করা হয় ) সঙ্গে সাধারণ ধর্মবাচক পদের সমাসকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে |
** মনে রাখার বিষয়:-
এখানে উপমান পদটি প্রথমে বসে, তারপর সাদৃশ্যবাচক শব্দ , শেষে সাধারণ ধর্মবাচক পদ বসে |
উপমান + সাদৃশ্য বাচক শব্দ + সাধারণ ধর্মবাচক পদ = উপমান কর্মধারয় সমাস
যেমন:--
শঙ্খের ন্যায় শুভ্র = শঙ্খশুভ্র
বজ্রের মতো কঠিন = বজ্রকঠিন
আলতার মতো রাঙা = আলতারাঙা
 উপমিত কর্মধারয় সমাস :::::
উপমেয় ( যাকে তুলনা করা হয় ) -র সাথে উপমান এর যে সমাস হয় , তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে |
** মনে রাখার বিষয়:--
এই সমাসে কোনো সাধারণ ধর্মবাচক পদের উল্লেখ থাকে না |
উপমেয় + উপমান + সাদৃশ্য বাচক শব্দ = উপমিত কর্মধারয় সমাস |
যেমন:--
নয়ন কমলের ন্যায় = নয়নকমল
অধর বিম্বের ন্যায় = বিম্বাধর
কথা অমৃতের তুল্য = কথামৃত
রূপক কর্মধারয় সমাস ::::
যে সমাসে উপমেয় ও উপমান এর মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয় , তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে |
** মনে রাখার বিষয়:--
এখানে উপমেয় আর উপমান এর মধ্যে 'রূপ' শব্দটি বসে |
উপমেয় + রূপ + উপমান = রূপক কর্মধারয় সমাস
যেমন:--
যৌবন রূপ কুসুম = যৌবনকুসুম
প্রাণ রূপ প্রবাহিণী = প্রাণপ্রবাহিণী
জীবন রূপ যুদ্ধ = জীবনযুদ্ধ
সুখ রূপ দীপ = সুখদীপ |

* বহুব্রীহি সমাস *
সংজ্ঞা:-- যে সমাসে সমস্যমান পদগূলির কোনোটির অর্থই প্রধান ভাবে না বুঝিয়ে অন্য কোনো অর্থ প্রধানভাবে বোঝায় , তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে |
যেমন-- বীণা পাণিতে যাহার = বীণাপাণি ( সরস্বতী )
** 'বহুব্রীহি' = বহু ব্রীহি ( ধান ) যাহার
প্রকারভেদ::::::
1) সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস :--
এই সমাসে পূর্বপদ বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্য হয় |
এখানে উভয় পদেই শূন্য বিভক্তি থাকায় এর নাম সমানাধিকরণ |
যেমন:--
দৃঢ় প্রতিজ্ঞা যাহার= দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
ছিন্ন হয়েছে শাখা যার = ছিন্নশাখা (বৃক্ষ)
সমান পতি যাদের= সপত্নী
ব্যতিক্রম:::
** কখনও আবার বিশেষ্যপদটি পূর্বেও বসে |
যেমন:--
লক্ষ্মী ছাড়িয়াছে যাকে= লক্ষ্মীছাড়া
বুক ফাটে যার দ্বারা= বুকফাটা ( কান্না )
স্বার্থই পর ( পরম ) যার = স্বার্থপর
** কখনও আবার দুটি পদই বিশেষ্য / পূর্বপদটি বিশেষণ ভাবাপন্ন |
যেমন:--
চন্দ্র হয়েছে শেখর যার= চন্দ্রশেখর ( শিব )
পদ্ম আসন যাহার= পদ্মাসন
নদী মাতা যাহার= নদীমাতৃক
2) ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস ::::
এই বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদটি বিশেষণ নয় |
এখানে সমস্যমান পদ দুটি পৃথক বিভক্তিযুক্ত হওয়ায় এর নাম ব্যধিকরণ বহুব্রীহি |
যেমন:--
মিলন অন্তে যার= মিলনান্তক
অন্য বিষয়ে মন যার = অন্যমনস্ক
আশীতে (দন্তে) বিষ যার= আশীবিষ (সর্প)
রত্ন গর্ভে যাহার= রত্নগর্ভা
অন্তঃ (অন্তরে) অপ্ যার= অন্তরীপ
3) নঞর্থক বহুব্রীহি সমাস ::::::
নঞর্থক বা নাবাচক পদের সঙ্গে বিশেষ্যপদের যে বহুব্রীহি সমাস তাকেই নঞর্থক বহুব্রীহি সমাস বলে |
যেমন:---
নেই অর্থ যার = নিরর্থক
নিঃ (নাই) রদ (দন্ত) যার= নীরদ
বে (নাই) তার যাতে= বেতার
নিঃ (নাই) সহায় যার = নিঃসহায়
4) মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস :::::::
ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত পদের লোপ হয় এই বহুব্রীহি সমাসে |
**এই সমাসে বেশিরভাগভাগ স্থানে উপমানের সঙ্গে সমাস হয়, তাই একে উপমানাত্মক বহুব্রীহি ও বলা হয় |
** আবার ব্যাসবাক্যটি ব্যাখ্যামূলক হওয়ায় এর অপর একটি নাম ব্যাখ্যাত্মক বহুব্রীহি সমাস |
যেমন:--
ধর্মের(আদর্শের) উদ্দেশে ঘট স্থাপন পূর্বক যে আন্দোলন= ধর্মঘট
বিম্বের ন্যায় রঞ্জিত অধর যে নারীর= বিম্বাধরী
মীনের অক্ষির মতো অক্ষি যে নারীর= মীনাক্ষী
কাঞ্চনের প্রভার ন্যায় প্রভা যার= কাঞ্চনপ্রভ
5) ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস :::::
পরস্পর একজাতীয় ক্রিয়ার বিনিময় বোঝালে ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস হয় |
যেমন:--
কেশে কেশে আকর্ষণ করে যে যুদ্ধ= কেশাকেশি
পরস্পরের মধ্যে আড়ি= আড়াআড়ি
পরস্পরকে জানা= জানাজানি
হেসে হেসে যে আলাপ = হাসাহাসি
6) সহার্থক বহুব্রীহি সমাস ::::::::
পূর্বপদ বিশেষ্যের সঙ্গে, সহার্থক পরপদের বহুব্রীহি সমাসকে সহার্থক বহুব্রীহি সমাস বলে |
যেমন:--
শ্রদ্ধার সহিত বর্তমান= সশ্রদ্ধ
প্রতিভার সহিত বর্তমান= সপ্রতিভ
বেগের সহিত বর্তমান = সবেগ
চকিতের সহিত বর্তমান= সচকিত
** পূর্বপদ যদি বিশেষণ হয় , তবে তা সহার্থক বহুব্রীহি হয় না |
7) সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি সমাস :::::::
এই বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ হয় |
যেমন:--
একদিকেই চোখ যার= একচোখা
দশ আনন যার= দশানন
ত্রি নয়ন যার= ত্রিনয়ন / ত্রিনয়না (স্ত্রীবাচক)
সে (তিন) তার যার= সেতার
দুই দিকে অপ্(জল) যার= দ্বীপ |

::তৎপুরুষ সমাস::
সংজ্ঞা:- যে সমাসে পূর্বপদের কারকের বিভক্তিচিহ্ন বা বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গের লোপ হয় এবং পরপদের অর্থই প্রধান হয় , তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে |
যেমন:--
রথকে দেখা = রথদেখা
লোককে দেখানো=লোকদেখানো
* প্রকারভেদ *
1) কর্ম তৎপুরুষ সমাস ::::
এই সমাসে পূর্পদের কর্মকারকের বিভক্তিচিহ্ন ( যেমন 'কে' ) লোপ পায় |
উদাহরণ:--
লুচিকে ভাজা=লুচিভাজা
মালাকে বদল = মালাবদল
ছেলেকে ভুলানো = ছেলেভুলানো
2) করণ তৎপুরুষ সমাস :::::
এই সমাসে পূর্বপদের করণকারকের বিভক্তি ('এ', 'য়', 'তে')/ অনুসর্গ ( 'দ্বারা', 'দিয়া', 'কর্তৃক' ) লোপ পায় |
উদাহরণ--
আশা দ্বারা আহত=আশাহত
প্রথার দ্বারা বদ্ধ =প্রথাবদ্ধ
জরায় জীর্ণ=জরাজীর্ণ
3) অপাদান তৎপুরুষ সমাস ::::
এই সমাসে পূর্বপদের অপাদান কারকের বিভক্তি ('এ', 'তে' ) / অনুসর্গ ( 'হইতে', 'থেকে', 'চেয়ে' ) লোপ পায় |
উদাহরণ--
জল হইতে আতঙ্ক= জলাতঙ্ক
দল থেকে ছাড়া =দলছাড়া
মৃত্যুতে ভয়=মৃত্যুভয়
4) নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাস ::::
এই সমাসে পূর্বপদের নিমিত্ত / জন্য / উদ্দেশ্য প্রভৃতি নিমিত্তবাচক অংশগুলির লোপ হয় |
উদাহরণ---
স্বদেশের জন্য প্রেম =স্বদেশপ্রেম
তীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা = তীর্থযাত্রা
শিশুর নিমিত্ত সাহিত্য =শিশুসাহিত্য
5) অধিকরণ তৎপুরুষ সমাস ::::
এখানে পূর্বপদের অধিকরণ কারকের বিভক্তিচিহ্ন ('এ', 'য়', 'এতে' ) লোপ পায় |
উদাহরণ---
গীতায় উক্ত= গীতোক্ত
ওষ্ঠে আগত= ওষ্ঠাগত
স্বার্থে পর (আসক্ত) = স্বার্থপর
6) সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস :::::
এই সমাসে পূর্বপদের সম্বন্ধের বিভক্তিচিহ্ন ( 'র', 'এর', 'দের' ) লোপ পায় |
উদাহরণ--
বসন্তের সখা= বসন্তসখ (কোকিল)
মন্ত্রীদের সভা =মন্ত্রীসভা
রোগের রাজা =রাজরোগ
7) ব্যাপ্তার্থক তৎপুরুষ সমাস ::::
এখানে 'ব্যাপিয়া' বা বিস্তার অর্থ বোঝায় |
উদাহরণ--
চিরকাল ব্যাপিয়া সুখী = চিরসুখী
চিরকাল ব্যাপিয়া সুন্দর = চিরসুন্দর
8) উপপদ তৎপুরুষ সমাস :::::
উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের সমাসকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে |
উদাহরণ--
পঙ্কে জন্মে যে =পঙ্কজ
মুখে থাকে যা =মুখস্থ
গণিত জানেন যিনি =গণিতজ্ঞ
9) নঞ তৎপুরুষ সমাস ::::
নঞ অব্যয় কে পূর্বপদ করে, উত্তরপদ বিশেষ্য বা বিশেষণের সঙ্গে এই সমাস হয় |
** উত্তরপদের প্রথমবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ হলে 'নঞ' স্থানে 'অ' হয় |
আর স্বরবর্ণ হলে 'অন্' হয় |
উদাহরণ--
আবশ্যক নয়= অনাবশ্যক
আস্থা নেই =অনাস্থা
শুভ নয় =অশুভ
স্থির নয়= অস্থির
10) অকারক তৎপুরুষ / উপকারক তৎপুরুষ সমাস ::::
এখানে 'গত', 'প্রাপ্ত', 'আপন্ন', 'আশ্রিত', 'আরূঢ়', 'অতীত' ইত্যাদি শব্দযোগে পূর্বপদের 'কে' বিভক্তিচিহ্ন লোপ পায় |
উদাহরণ---
যৌবনকে প্রাপ্ত= যৌবনপ্রাপ্ত
অশ্বে আরূঢ় =অশ্বারূঢ়
দেবকে আশ্রিত =দেবাশ্রিত

*অব্যয়ীভাব সমাস *
অব্যয়ীভাব সমাস ::::
পূর্বপদ অব্যয়ের সাথে পরপদ বিশেষ্যের যে সমাস হয় , তাকে এই সমাস বলে |
** অব্যয়ের অর্থই প্রধান এবং সমস্তপদটি অব্যয়ের ভাবপ্রাপ্ত হয় | তাই নাম অব্যয়ীভাব সমাস |
** বিভিন্ন অর্থে এই অব্যয়ীভাব সমাস হয় |
যেমন ::::
1) অভাব অর্থে----
উদাহরণ :-
ভিক্ষার অভাব= দুর্ভিক্ষ
মিলের অভাব= গরমিল
হায়ার (লজ্জার) অভাব= বেহায়া
2) সামীপ্য / নিকট অর্থে -----
উদাহরণ:--
কূলের সমীপে= উপকূল
অক্ষির সমীপে= সমক্ষ
কণ্ঠের সমীপে = উপকণ্ঠ
3) বীপ্সা অর্থে -----
উদাহরণ:--
জনে জনে = প্রতিজন
দিনে দিনে =প্রতিদিন
রোজ রোজ = হররোজ
4) অনতিক্রম অর্থে ----
উদাহরণ:--
শাস্ত্রকে অতিক্রম না করে= যথাশাস্ত্র
রীতিকে অতিক্রম না করে = যথারীতি
ক্রমকে অতিক্রম না করে = যথাক্রম
5) সাদৃশ্য অর্থে----
উদাহরণ:--
বনের সদৃশ= উপবন
ভাষার সদৃশ = উপভাষা
কথার সদৃশ = উপকথা
6) সীমা / ব্যাপ্তি অর্থে -----
উদাহরণ:--
আদি হইতে অন্ত পর্যন্ত= আদ্যন্ত
মৃত্যু পর্যন্ত = আমৃত্যু
বাল্য হইতে = আবাল্য
7) ক্ষুদ্রতা অর্থে -----
উদাহরণ:--
ক্ষুদ্র শাখা= প্রশাখা
ক্ষুদ্র নদী = উপনদী
ক্ষুদ্র জাতি = উপজাতি
8) যোগ্যতা অর্থে----
উদাহরণ:--
রূপের যোগ্য = অনুরূপ
গুণের যোগ্য = অনুগুণ
9) সম্মুখ অর্থে----
উদাহরণ:---
অক্ষির সম্মুখে= প্রত্যক্ষ
কূলের সম্মুখে= অনুকূল
10) পশ্চাৎ অর্থে----
উদাহরণ:--
রাগের পশ্চাৎ =অনুরাগ
গমনের পশ্চাৎ= অনুগমন
রণনের পশ্চাৎ = অনুরণন
11) বিরুদ্ধ / প্রতিবাদ অর্থে ----
উদাহরণ:--
কূলের বিরুদ্ধে = প্রতিকূল
ক্রিয়ার বিপরীতে =প্রতিক্রিয়া
পক্ষের বিরুদ্ধে = প্রতিপক্ষ
12) বিবিধ অর্থে ----
উদাহরণ:--
পিতামহের পূর্ব= প্রপিতামহ
দস্তুর অনুযায়ী = দস্তুরমতো
হীন দেবতা = উপদেবতা
মুখের অভিমুখে = সম্মুখ
আত্মাকে অধিকার করিয়া= অধ্যাত্ম

*দ্বিগু সমাস*
পূর্বপদটি যখন সংখ্যাবাচক বিশেষণ, উত্তরপদটি বিশেষ্য হয় আর সমস্তপদটির দ্বারা কোনো সমষ্টি/সমাহার বোঝায় তাকে দ্বিগু সমাস বলে |
উদাহরণ::---
দুইটি গোরুর সমাহারে ক্রীত=দ্বিগু
চতুঃ (চার) অক্ষরের সমাহার= চতুরক্ষর
ত্রি প্রান্তরের সমাহার= ত্রিপ্রান্তর > তেপান্তর
সপ্ত ঋষির সমাহার = সপ্তর্ষি
সপ্ত অহ(দিন) এর সমাহার= সপ্তাহ
** দ্বিগু সমাসে সমস্তপদটি কখনও 'আ' কারান্ত , কখনও 'ঈ' কারান্ত হয় |
যেমন---
ত্রি ফলের সমাহার = ত্রিফলা
পঞ্চ বটের সমাহার = পঞ্চবটী
শত অব্দের সমাহার = শতাব্দী |

* অলোপ / অলুক সমাস*
সমাসবদ্ধ পদ গঠনের পরও যে সমস্ত সমাসে , পূর্বপদের বিভক্তিচিহ্নের কোনো লোপ ঘটে না, তাকে অলোপ বা অলুক সমাস বলে |
** 'লুক' কথার অর্থ হল 'লোপ' |
যেমন--
মনের মানুষ = মনের মানুষ ( বিভক্তির লোপ হয়নি ) |
প্রকারভেদ ::::
1) অলুক দ্বন্দ্ব সমাস :::
উদাহরণ :-
চোখে ও মুখে = চোখেমুখে
আগে ও পিছে = আগেপিছে
2) অলুক তৎপুরুষ সমাস ::::
অ) অলুক করণ তৎপুরুষ সমাস :::
উদাহরণ :-
হাতে কাটা = হাতেকাটা
কলে ছাঁটা = কলেছাঁটা
আ) অলুক নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাস ::::
উদাহরণ :-
ভুলের (ভুলের জন্য) মাশুল = ভুলের মাশুল
পেটের (পেটের জন্য) খোরাক = পেটের খোরাক
ই) অলুক অপাদান তৎপুরুষ সমাস ::::
উদাহরণ :-
বিদেশ থেকে আনা = বিদেশ থেকে আনা ( বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গ 'থেকে' অলুপ্ত থেকেছে )
চোখের (চোখের থেকে) জল = চোখের জল
ঈ) অলুক অধিকরণ তৎপুরুষ সমাস ::::
উদাহরণ :--
দিনে ডাকাতি = দিনেডাকাতি
অঙ্কে কাঁচা = অঙ্কেকাঁচা
উ) অলুক সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস ::::
উদাহরণ :--
চোখের বালি = চোখের বালি
মামার বাড়ি = মামার বাড়ি
ঊ) অলুক উপপদ তৎপুরুষ সমাস ::::
উদাহরণ :--
অন্তে বাস করে যে = অন্তেবাসী
কলেজে পড়ে যে = কলেজেপড়া
3) অলুক বহুব্রীহি সমাস ::::
উদাহরণ :--
গায়ে হলুদ দেওয়া হয় যে অনুস্থানে = গায়েহলুদ
হাতে খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = হাতেখড়ি
** এই সমাসকে 'অনুষ্ঠানবাচক বহুব্রীহি' সমাস ও বলে |

*নিত্য সমাস*
যে সমাসে সমস্যমান পদগুলি নিত্য বা সর্বদাই সমাসবদ্ধ থাকে, কোনো ব্যাসবাক্য হয় না বা ব্যাসবাক্য করতে গেলে অন্য পদের প্রয়োজন হয় ,তাকে নিত্য সমাস বলে |
যেমন--
কাঁচা কলা = কাঁচকলা
এখানে 'কাঁচকলা' নিত্যসমাস, কারণ 'কাঁচকলা' একটি বিশেষ ধরণের কলা বোঝায় | তাই এর ব্যাসবাক্য কখনই 'কাঁচা যে কলা' হবে না |
অ) সর্বদাই সমাসবদ্ধ এমন নিত্যসমাস :::
উদাহরণ :--
কৃষ্ণসর্প= কৃষ্ণসর্প
দাঁড়কাক = দাঁড়কাক
আ) 'অন্য' যোগে নিত্য সমাস ::::
উদাহরণ :--
অন্য মত = মতান্তর
অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর
ই) 'কেবল' বা 'শুধু' যোগে নিত্য সমাস ::::::
উদাহরণ :--
কেবল শোনা = শোনামাত্র
শুধু চিহ্ন =চিহ্নমাত্র
ঈ) 'তুল্য' যোগে নিত্য সমাস :::::
উদাহরণ :---
বজ্রের তুল্য = বজ্রসন্নিভ
জবাকুসুমের তুল্য = জবাকুসুমসঙ্কাশ

*বাক্যাশ্রয়ী সমাস*
কোনো বাক্য বা বাক্যখণ্ড কে সুসংহতরূপে একটি শব্দে পরিণত করে, তাকে বিশেষ্য / বিশেষণের রূপ দিলে অথবা কোনো সমাসবদ্ধ পদকে আশ্রয় করে, একটি বাক্যের অর্থ প্রকাশ পেলে , তাকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে |
উদাহরণ :---
গল্পকে বলা (কর্ম তৎপুরুষ), তার প্রতিযোগিতা (সম্বন্ধ তৎপুরুষ) = গল্পবলা-প্রতিযোগিতা
সবুজকে বাঁচাও (কর্ম তৎপুরুষ) , তার জন্য কমিটি (নিমিত্ত তৎপুরুষ) = সবুজ-বাঁচাও-কমিটি

** অসংলগ্ন সমাস**
সাধারণত সমাসবদ্ধ পদকে এক মাত্রায় লেখা হয় | তবে বাংলায় কিছু সমাসবদ্ধ পদকে বিচ্ছিন্ন ভাবেও লেখা হয়ে থাকে , সেগুলিকে অসংলগ্ন সমাস বলে |
উদাহরণ :----
পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতি
চায়ের দোকান
রাজার ছেলে
রাঘব বোয়াল |

ধন্যবাদান্তে
শিউলী ঘোষ | অ্যাডমিন সাকসেস বাংলা |

Share this