মঙ্গলকাব্যের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণিবিভাগ


মঙ্গলকাব্যের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও শ্রেণিবিভাগ
সংজ্ঞা:-
        বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সমাজের সর্বস্তরে নানা দেবদেবীর পূজা প্রবর্তনের ও তাদের লীলা মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে যে অখ্যানধর্মী কাব্যসমূহ রচিত হয়েছিল ,সেই কাব্যগুলিকে মঙ্গলকাব্য বলে।

উদ্ভব ও সময়কাল:-
                আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গসহিত্যে যে বিশেষ এক শ্রেণির ধর্মবিষয়ক আখ্যান-কাব্য প্রচলিত ছিল,তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গল কাব্য নামে পরিচিত।(বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস-আশুতোষ ভট্টাচার্য)
               বাংলাদেশের একটি বিশেষ যুগের সাহিত্য সাধনা মঙ্গলকাব্য।মঙ্গলকাব্যগুলিতে কেবল দেবদেবীর মাহাত্ম্যই নয় ;প্রাঞ্জল ভাষায় রচিত হয়েছ বাঙালীর জীবন চিত্রের খুঁটিনাটি।মঙ্গলকাব্যের প্রথম উদ্ভব পল্লীর জনসভা থেকে হলেও এটি পূর্ণ রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল রাজসভায়।
        কোনো বিশেষ ধর্মমত নয়; বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, লৌকিক-বহিরাগত ধর্মমতের মিলন,ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়ের সংস্কার -সংস্কৃতি,ধর্মবিশ্বাসের
সংমিশ্রনের ফলশ্রুতিতেই মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব।

 রচনার সামাজিক প্রেক্ষাপট:-
  ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মুসলমান শাসনকালেই  মঙ্গল কাব্যগুলো সৃষ্টি হয়েছিল।এর পশ্চাতে কিছু সামাজিক কারণ বর্তমান ছিল।
যেমন---
• তুর্কী আক্রমণ
• উচ্চবর্ণের হিন্দুসমাজের সঙ্গে নিম্নবর্ণের লোকজীবনের মিলন
• লৌকিক দেবতাদের বাঙালী সমাজে প্রতিষ্ঠালাভ
• লৌকিক দেবদেবীর সঙ্গে পৌরাণিক দেবদেবীর আর সংস্কৃতির সমন্বয়
• হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ
• বঙ্গদেশে অধিদৈবিক ও অধিভৌতিক চর্চা
• আর্য সংস্কৃতিতে ক্রমশ অনার্য দেবদেবীর প্রবেশ

'মঙ্গল' নামের উৎপত্তি:-
          'মঙ্গল ' নামটি উৎপত্তির বিভিন্ন কারণ অনুমান করা হয়ে থাকে ।যেমন--
 ▪দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত এই কাব্যের কাহিনী শ্রবণে মঙ্গল হয় বলে মানুষের বিশ্বাস।

▪এক মঙ্গলবার থেকে আরেক মঙ্গলবার পর্যন্ত গানগুলি গাইবার রেওয়াজ ছিল।

▪প্রাচীন -মধ্য যুগের সাহিত্য মাত্রই ছিল গেয় ।তাই অনুমান করা হয় কাব্য কাহিনীর আদ্য পান্ত মঙ্গল রাগে বা প্রধানত মঙ্গল রাগেই গাওয়া হতো।

▪বিবাহাদি অনুষ্ঠানে যে সকল গীত গাওয়া হতো সেগুলিকে সাধারণ ভাবে মঙ্গল বলে অভিহিত করা হয়।উত্তরাকাণ্ডে এর উল্লেখ আছে

▪ 'মঙ্গল' শব্দটি সম্ভবতঃ ভারতীয় কোনো অনার্য ভাষা থেকে আগত।দ্রাবিড় ভাষায় মিলন অথবা বিবাহ অর্থে এটি ব্যবহার হয়।

▪ বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাসকার আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন----
      প্রাচীন বাংলায় বিবাহ উপলক্ষে প্রচলিত লোকসঙ্গীতের রাগকেই মঙ্গলরাগ বলা হতো।পরে এর অর্থ সঙ্কুচিত হয়ে দেবদেবীর বিবাহ অর্থে শব্দটি ব্যবহৃত হয়।অতঃপর বাংলায় দেবদেবীর মাহাত্ম্য সূচক রচনা মাত্রই মঙ্গল নামে পরিচিত হয়েছে।
▪মঙ্গল কাব্যের দেবদেবীর      অমঙ্গলকারী শক্তি কে ভক্তের মনে স্থান না দেবার উদ্দেশ্যে মঙ্গল নামকরন হতে পারে ।

গঠন:-
মঙ্গল কাব্যের কাহিনি মূলত চারটি অংশে বর্ণিত হয়ে থাকে-
(১)বন্দনাখন্ড
(২)আত্মবিবরনী ও কাবিরচনার কারণ
(৩)দেবখন্ড
(৪)নরখন্ড
 ● মঙ্গল কাব্যের সুদীর্ঘ কাহিনী কতগুলি পালায় বিভক্ত করে গাওয়া হতো।
সাধারণত আট দিনের ষোলো পালায় অর্থাৎ আট টি দিবা পালা ও আট টি রাত্রি পালায় কাহিনী বিভক্ত হতো। তবে বিষয়ানুযায়ী মঙ্গল কাব্যের পালা বিভাগ স্বতন্ত্র হতো।
ছন্দ:-
 ▪ মঙ্গলকাব্য প্রধানত অক্ষরবৃত্ত পয়ার ছন্দেই লিখিত।এই ছন্দকে মধ্যযুগে পাঁচলী ছন্দও বলা হতো।
▪পয়ার বা পাঁচালী ছাড়া মঙ্গলকাব্যের আরেকটি অন্যতম প্রধান ছন্দ ত্রিপদী।এই ত্রিপদী প্রধানত অক্ষরবৃত্ত ত্রিপদী।একে অনেকক্ষেত্রে লাচারী ছন্দ ও বলে।
▪ত্রিপদী ছন্দের একটি বিশেষ রূপকে ললিত ছন্দ বলে।এটিও মঙ্গলকাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে।
▪মঙ্গল কাব্যে পয়ার ,ত্রিপদী ছাড়াও একবলী ছন্দের প্রয়োগ দেখা যায়।▪পয়ার ,ত্রিপদী, একবলী ছন্দ ছাড়াও মঙ্গলকাব্যের কবিগণ সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণে ছন্দ সৃষ্টির প্রয়াস করেছেন।তোটক,  তুনক প্রভৃতি ছন্দের বাংলা অনুবাদ 'অন্নদা-মঙ্গল' কাব্যে দেখা যায়।

লক্ষণ/বৈশিষ্ট্য:-
▪প্রথমেই মঙ্গলকাব্যে গনেশাদি পঞ্চদেবতার বন্দনা ,তারপর গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ বর্ণন, সৃষ্টি-রহস্য,কথন প্রভৃতির সূচনা অংশে এই কাঠামো প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যে দেখা যায়।
▪দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচার মঙ্গল কাব্যের প্রধান উদ্দেশ্য।অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিম্নশ্রেণীর চরিত্রের মহিমা প্রচারিত হতো।▪মঙ্গলকাব্যে বর্ণিত কবির আত্মপরিচয় অংশে পূর্বপুরুষের পরিচয় ,বাসস্থানের বর্ণনা,স্বপ্নাদেশ প্রভৃতির অল্পবিস্তর বর্ণনা থাকে।
▪মঙ্গলকাব্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কবিদের  ভনিতা ব্যবহার। এই অংশে কবির নাম,পদবী,আশ্রয়দাতা পৃষ্ঠপোষকের নামের উল্লেখ থাকে।
▪মঙ্গল কাব্যে বর্ণিত সমগ্র কাহিনি একাধিক পালায় বিভক্ত হয়ে থাকে।
▪মঙ্গল কাব্য দেবখন্ড ও নর খন্ডে বিভক্ত।
▪প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যের নায়ক নায়িকা স্বর্গচ্যুত  দেবদেবী।দেব মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যেই তাদের মর্ত্যে আগমন।
▪মঙ্গলকাব্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সমুদ্রপথের বর্ণনা থাকে।
▪মঙ্গলকাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য নারীদের পতিনিন্দার বর্ণনা।
▪বিপন্ন নায়ক নায়িকার দ্বারা দেবীর চৌতিশা স্তব বর্ণনা মঙ্গলকাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
▪নায়িকার বারোমাস্যার বর্ণনা মঙ্গলকাব্য তথা মধ্যযুগের কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
▪মনসামঙ্গল ছাড়া ,সমস্ত মঙ্গলকাব্যেই যুদ্ধের বিস্তৃত বর্ণনা পাওয়া যায়।
▪মঙ্গল কাব্যে প্রহেলিকা ধাঁধাঁ ,প্রবাদ-প্রবচন,লোকবিশ্বাস,লোকশ্রুতি,মঙ্গলকাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
▪দেবতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীকে দেবতার পদতলে নতশীর্ষ করানো মঙ্গলকাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
▪শঠ চরিত্রের বিপরীতধর্মী  নির্বোধ চরিত্রেরাও মঙ্গলকাব্যে কোনো কোনো সময় স্থান  নিয়ে থাকে,তবে এদের সংখ্যা খুব বেশি নয়।

শ্রেণীবিভাগ:-
 লৌকিক:~
শিবায়ন /শিবমঙ্গল
মনসামঙ্গল
চণ্ডীমঙ্গল
ধর্মমঙ্গল
কালিকা মঙ্গল/বিদ্যাসুন্দর
শীতলামঙ্গল
রায়মঙ্গল
ষষ্ঠীমঙ্গল
সারদামঙ্গল
সূর্যমঙ্গল

পৌরাণিক:~
• গৌরীমঙ্গল
• ভবানীমঙ্গল
• দুর্গামঙ্গল
• অন্নদামঙ্গল
• কমলামঙ্গল
• গঙ্গামঙ্গল
• চণ্ডিকামঙ্গল 

 বৈষ্ণব:~
• চৈতন্যমঙ্গল
• অদ্বৈতমঙ্গল
• গোবিন্দমঙ্গল
• কৃষ্ণমঙ্গল
• রাধিকা মঙ্গল
• জগৎ মঙ্গল
• কিশোরী মঙ্গল
• স্মরণমঙ্গল
• গোকুল মঙ্গল
• রসিকমঙ্গল

  ধন্যবাদ
পূজা কুন্ডু
সাকসেস বাংলা

Share this