ভারতের সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন


ভারতের সংস্কৃতিঃ প্রসঙ্গ আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন

    বর্তমানকালে আমরা যে ভারতবর্ষকে দেখি তার সংস্কৃতি অবশ্যই বহুমাত্রিক ও বৈচিত্রপূর্ণ৷ কিন্তু সুদূর অতীতকালে ভারতীয় সংস্কৃতির এত বৈচিত্র্যতা ছিল না৷ অতিপ্রাচীন কালে আমাদের দেশ ছিল অনার্য অধ্যুষিত৷ তথাকথিত অর্থে যাঁরা আর্য নয়;তাদেরকে অনার্য বলছি৷ আর্যরা এলেন অনেক পরে৷ ক্রমে আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটল৷ ঋকবেদ আর্যদের দ্বারা রচিত গ্রন্থ৷ ঋকবেদের যুগকে বৈদিকযুগ বলা হয়৷ বৈদিক আর্যরা অনার্য অধ্যুষিত ভারতবর্ষে সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলেন,তার কারণ;বেদপূর্ব ভারতবর্ষে লোহা ও ঘোড়ার ব্যবহার ছিল না৷ তাই হরপ্পা ও মহেঞ্জোদোড়ো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষগুলিতে লোহা ও ঘোড়ার কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় না৷ জানা যায় বৈদিক আর্যরা এই দুইয়ের ব্যবহারে যথেষ্ঠ দক্ষ ছিলেন৷ 

  বৈদিকসভ্যতা ভারতবর্ষে প্রসার লাভ করার পর এদেশের সংস্কৃতিতে যাগযজ্ঞমূলক কর্মগুলির উদ্ভব ঘটে৷ ইতিপূর্বে অনার্য সংস্কৃতিতে যাগযজ্ঞের কোনো স্থান ছিল না৷ অার্য সংস্কৃতির সংস্পর্শে তা অনেক পরবর্তীকালে অনার্য সংস্কৃতিতে সংযুক্ত হয়৷

    ইতিহাসে আমরা পড়েছিলাম যে, আগুনের ব্যবহার শুরু হবার পর মানবসভ্যতায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে৷ প্রসঙ্গত বলছি; অনার্যরা যে আগুনের ব্যবহার জানতেন না,এমনটা কিন্তু নয়৷ তাঁরাও আগুন ব্যবহার করতেন৷ তবে তৎকালীন অস্ট্রিক,দ্রাবিড় ইত্যাদি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষেরা মৃতদেহের সৎকারের জন্য আগুনের ব্যবহার করতে জানতেন না৷ এই দাহপ্রথায় আগুনের ব্যবহার অনার্যরা রপ্ত করেছেন আর্য সংস্কৃতি থেকে৷ আর্যরা ভারতবর্ষে এসে প্রচুর বনভূমি দেখে চন্দন কাঠে মৃতদেহের সৎকার করা শুরু করেন৷ এইভাবেই পরবর্তীতে হিন্দু সংস্কৃতিতে অগ্নিসংযোগে দাহ করার প্রচলন ঘটে৷

    বেদবাহ্য অনার্য সংস্কৃতিতেও ভক্তিবাদ এবং প্রেমধর্মের প্রাবল্য ছিল৷ কিন্তু আর্যরা আগমনের পর নিষ্কাম ধর্মসাধনা,জন্মান্তরবাদ,মায়াবাদ,যোগসাধনা, বৈরাগ্যসাধনা,ব্রত-উপবাস ও তীর্থভ্রমণ ইত্যাদি মহান আদর্শের ছোঁয়ায় পূর্ববর্তী প্রেম ও ভক্তিবাদ আরো প্রখর হয়ে হিন্দু সংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠলো৷

    আমরা হয়তবা অনেকেই জানি যে,আর্য সংস্কৃতি ছিল পিতৃতান্ত্রিক৷ অর্থাৎ আর্যসমাজের প্রধান ছিল পুরুষ৷ বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ আর্যরা এদেশে এসে অনার্য নারীদের বিবাহ করতেন,ফলস্বরূপ সন্তান ব্রাহ্মণ হতেন৷ এর উদাহরণ আমরা মনসাপুরাণেই পাই৷ জরৎকারু মুনির পুত্র আস্তিক মুনি ব্রাহ্মণোত্তম ছিলেন,অথচ মনসা ছিলেন অনার্য কাল্টের উপাষ্য দেবী৷ উল্লেখ্য; আর্যসমাজের সংস্কৃতি বজায় রেখে আস্তিক মুনিও ব্রাহ্মণ৷ অন্যদিকে, দ্রাবিড়সহ অন্যান্য অনার্য জাতির সংস্কৃতি ছিল মাতৃতান্ত্রিক৷ এক্ষেত্রে অর্বাচীন যুগে আর্য সংস্কৃতি বিশেষভাবে অনার্য সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মাতৃতান্ত্রিক প্রাধান্যকে অনেকটা মেনে নিয়েছিল৷

     ভারতবর্ষ নদীমাতৃক দেশ৷ তাই এখানকার অধিবাসীরা নদনদী ও জলেই বেশী স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন৷ কিন্তু আর্যরা এখানে আসার পূর্বে নদনদী ও সমুদ্রের সঙ্গে বেশী পরিচিত ছিলেন না৷বর্তমান নাগ সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা তথাকথিত অনার্য ছিলেন৷জলসম্বন্ধীয় বিষয়গুলিও আর্যরা শিখেছিলেন এই নাগসম্প্রদায়ভুক্ত অনার্যদের কাছ থেকে৷ নৌকা চড়া,মাছ ধরার জাল এমনকি মাছ ভক্ষণ করাটাও অনার্য সংস্কৃতি থেকে আর্যদের মধ্যে পর্যবেশিত হয়েছে৷ আর্যরা মাংস,ফলমূল ইত্যাদি খুব পছন্দ করতেন৷

    এদিকে আশ্চর্যের বিষয়; শাঁখা-সিঁদুর যা নিয়ে আজকের উচ্চবর্গীয় হিন্দুসমাজ এত গর্ব করেন,তাও কিন্তু আদিম অনার্যদের কাছেই পাওয়া৷এছাড়াও বেদজ্ঞ আর্যরা শিব,সূর্য ও বিষ্ণুর আরাধনা করতেন বলে যজ্ঞটাই এদের প্রধান কাজ ছিল৷গান-বাজনা ও নাচ-গান পরবর্তীকালে অনার্যদের থেকে আর্যরা শিখেছিলেন৷

আকর গ্রন্থঃ ভারতের সংস্কৃতি - ক্ষিতিমোহন সেন
আলোচকঃ ধনঞ্জয় চক্রবর্তী 
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য

Success বাংলা

Share this