আলোচনার দর্পণে শাক্ত পদাবলী



শাক্ত পদাবলী 

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ হল পদাবলী সাহিত্য। গীতিকবিতাধর্মী এই পদাবলী সাহিত্য মূলত দুই ভাগে বিভক্ত-1)বৈষ্ণব পদাবলী ও 2)শাক্ত পদাবলী।আঙ্গিকগত মিল থাকলেও বিষয়সহ বেশ কিছু দিক দিয়ে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ প্রসঙ্গে বলেছেন "বৈষ্ণব পদাবলী ভাববৃন্দাবনে অনুষ্ঠিত অপ্রাকৃত রাধাকৃষ্ণের সূক্ষ্ম রসোতীর্ণ প্রেমগীতিকা, আর শাক্তপদাবলী বাস্তব বাংলাদেশের বাস্তব মায়ের বেদনার গান।... একটির (বৈষ্ণব) মূল রস আদিরস - তাই ই ভক্তিতে পরিণত হয়েছে, আর একটির (অর্থাৎ শাক্তপদ) মূল রস বাৎসল্য রস - তাও ভক্তিতে পরিণত হয়েছে।"  আজ আলোচনায় শাক্ত পদাবলী  সম্পর্কে দিকপাত করবো।
         
   শক্তি বিষয়ক ধর্ম চেতনার প্রাচীনতম পরিচয় পাওয়া যায় ঋগ্বেদের দেবীসূক্তে।যদিও শাক্ত পদাবলী নামকরণটি আধুনিক কালের। অষ্টাদশ শতাব্দীতে শক্তি সাধনাকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত পদ রচিত হয়েছিল তাকেই শাক্ত পদাবলী বলা হয়। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, "শক্তি অর্থাৎ উমা - পার্বতী- দুর্গা- কালিকাকে কেন্দ্র করে যে গান রচিত হয়, তাকে বলা হয় শাক্তগান"। পূর্বে শাক্তগানকে 'মালসী' বলা হত। অনুমেয় মালবশ্রী রাগে এই গান গাওয়া হত তাই এমন নামকরণ। শাক্ত পদাবলীর প্রধান রস হল বাৎসল্য রস। শাক্ত পদাবলীকে ১২ টি পর্যায়ে বিভক্ত করতে পারি । পর্যায়গুলি হল যথাক্রমে — বাল্যলীলা, আগমনী, বিজয়া, জগজ্জননীর রূপ, মা কি ও কেমন, ভক্তের আকুতি, মনোদীক্ষা, মাতৃপূজা, সাধনশক্তি, নামমহিমা, ও চরণতীর্থ, ইচ্ছাময়ী মা/লীলাময়ী /ব্রহ্মময়ী মা।

জাহ্নবীকুমার চক্রবর্তী শাক্ত পদাবলীর বিষয়কে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন। যথা :1)লীলাপর্ব, 2)উপাস্য তত্ত্ব ও 3)উপাসনা তত্ত্ব।

@@কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শাক্তপদকর্তা:
রামপ্রসাদ সেন ।
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য ।
মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ।
নীলাম্বর মুখোপাধ্যায় ।
গোবিন্দ চৌধুরী।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র।
মহারাজ নন্দকুমার।
মহারাজ মহাতাবচাঁদ।
মহারাজ রামকৃষ্ণ।
রাম বসু।
নিধুবাবু ।
কালিদাস চট্টোপাধ্যায় (কালী মির্জা)।
দাশরথি রায় ।
ঈশ্বর গুপ্ত ।
আশুতোষ দেব।
মধুসূদন দত্ত।
রূপচাঁদ পক্ষী ।
কাঙাল হরিনাথ বা হরিনাথ মজুমদার।
নবীনচন্দ্র সেন।

##শাক্ত পদকর্তা রামপ্রসাদ সেন##

 শাক্ত পদকর্তাদের মধ্যে প্রথম সারির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হলেন রামপ্রসাদ সেন। ঈশ্বর গুপ্তের মতে 1720 - 21খ্রীঃ চব্বিশ পরগনা জেলার হালিশহরের কুমারহট্ট গ্ৰামে জন্মগ্ৰহন করেন।তাঁর পিতার নাম রামরাম মতান্তরে রামদুলাল সেন, মাতা হলেন— সিদ্ধেশ্বরী দেবী।সুকুমার সেনের মতে তাঁরা জাতিতে ছিলেন বৈদ্য । পিতার মৃত্যুর পর অল্পবয়সেই তিনি বিষয়কর্মে লিপ্ত হন। তিনি ২২ বছর বয়সে সর্বানী নামের এক বালিকাকে বিবাহ করেন। দুই পুত্র ও দুই কন্যা যথাক্রমে রামদুলাল, রামমোহন, পরমেশ্বরী ও জগদীশ্বরী । কলকাতার কোন এক ধনাঢ্য ভূস্বামীর বাড়িতে তিনি মহুরিগিরির কাজ করতেন।বিবাহের পর তিনি কুলগুরু মাধবাচার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। মাধবাচার্যের মৃত্যুর পর তিনি তান্ত্রিক যোগী ও পন্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্ৰহণ করেন।একাধারে তিনি ছিলেন সাধক ও ভক্ত।"বিদ্যাসুন্দর", "কৃষ্ণকীর্তন" প্রভৃতি কাব্য তিনি রচনা করেন।আধ্যাত্মিক আদর্শকে  উপজীব্য করলেও তিনি বাস্তব জীবনকে বাদ দেননি।রামপ্রসাদের প্রায় তিনশো গান পাওয়া যায়।আনুমানিক 1781 খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়।

@@রামপ্রসাদের গানগুলি চারটি স্তরে বিভক্ত— ১. উমা বিষয়ক (আগমনী-বিজয়া),২. সাধন বিষয়ক( তন্ত্রোক্ত সাধনা), ৩. দেবীর বিরাট স্বরূপ বিষয়ক, এবং ৪. তত্ত্বদর্শন ও নীতি বিষয়ক।

@@রামপ্রসাদ সেন সম্পর্কে কিছু তথ্য :
1)ড. সেন অনুমান করেছেন যে, "বিদ্যাসুন্দর" কাব্য রামপ্রসাদের প্রথম রচনা ।
2) মহারাজ রাজেন্দ্র কিশোরের পৃষ্ঠপোষকতায় রামপ্রসাদ 'বিদ্যাসুন্দর' কাব্যটি রচনা করেন।
3)"কালিকামঙ্গল" ও  বিদ্যাসুন্দর"-এ তিনি যৎসামান্য আত্মপরিচয় দিয়েছেন।
4) তিনি তাঁর নিজের গানে যে সহজ সাদামাটা সুর দিতেন তাই 'প্রসাদী সুর' নামে প্রচলিত।
5)তিনি" কালীকীর্তন" ও" কৃষ্ণকীর্তন" নামে দুখানি ক্ষুদ্র কাব্য লিখেছেন।  6)প্রথম গান হল, " আমায় দাও মা তবিলদারি"।
7)"কৃষ্ণকীর্তন"-এ উমাকে কৃষ্ণরূপে উপস্থাপিত করতে গিয়ে কৃষ্ণের মতো উমার মাঠে গিয়ে গরু চরানোর চিত্র উপস্থাপিত করেছেন। আজু গোঁসাই নামে কবির এক প্রতিবেশী তাই ব্যঙ্গ করে কবিকে বলেছেন, "কাঁঠালের আমসত্ত্ব" - "না জানে পরম তত্ত্ব, কাঁঠালের আমসত্ত্ব, মেয়ে হয়ে ধেনু কি চরায় রে। "
8)ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে রামপ্রসাদ শ্রেষ্ঠ।
9)রামপ্রসাদ সেনের কথা প্রথম তুলে ধরেন ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর "কবিবর রামপ্রসাদ সেনের কালীকীর্তন" (1893 খ্রিস্টাব্দ) রচনায় ।
10)বুদ্ধদেব বসু রামপ্রসাদের ভক্তিকে কড়াপাকের বলেছেন।
11) মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে'কবিরঞ্জন' উপাধি দেন।
12)সিরাজদ্দৌলা রামপ্রসাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিল।
১৩) রামপ্রসাদ সেন ছিলেন রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের প্রিয় কবি। তিনি রামপ্রসাদী গান গাইতেন। তাঁর সে গানগুলি 'শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণকথামৃত' গ্ৰন্থে মুদ্রিত হয়েছে।
১৪) ভগিনী নিবেদিতা রামপ্রসাদ সেনের সঙ্গে ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের তুলনা করেছেন।
১৫) বর্তমান বা আধুনিক সময়ের কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পি যারা রামপ্রসাদী গান গেয়েছেন— ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়, অজয় চক্রবর্তী প্রমুখ।
১৬) রামপ্রসাদী সুরে পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের মতো বহু সঙ্গীতকার গীতি রচনা করেছেন।

##শাক্ত পদকর্তা কমলাকান্ত ভট্টাচার্য##

শাক্ত পদকর্তা হিসেবে রামপ্রসাদ সেনের পরই কমলাকান্তের স্থান। বর্ধমান জেলার অম্বিকা কালনায় জন্মগ্ৰহন করেন।বর্ধমানের অম্বিকা কালনা হল বাসভূমি। তাঁর পিতার নাম মহেশ্বর এবং মাতা হলেন মহামায়া। তাঁর কৌশিক পদবী ছিল বন্দোপাধ্যায়। বাল্যকালে পিতা মারা গেলে তিনি বর্ধমানের খানা জংশনের নিকট তাঁর মাতুলালয় চান্না গ্ৰামে চলে আসেন। বর্ধমানের কোটালহাটে কমলাকান্তের সাধনপীঠ রয়েছে।

##কমলাকান্ত সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য##

১) কালিকানন্দ ব্রহ্মচারী তাঁকে মাতৃমন্ত্রে দীক্ষা দেন।
২) তিনি মহারাজ প্রতাপচাঁদের সবিশেষ অনুরাগী হন।
৩) মহাতাবচাঁদ কমলাকান্তের প্রায় ২৫০ টি মাতৃপদাবলী মুদ্রণ করে প্রকাশ করেন।
৪) বর্ধমান রাজবাটী প্রকাশিত কমলাকান্তের পদাবলী সংগ্ৰহে ২৬৯টি পদ ছিল।
৫) তিনি মহারাজ তেজশ্চন্দ্রের রাজকবি ছিলেন।
৬) প্রথম জীবনে ' সাধকরঞ্জন' নামে একখানি তন্ত্র সাধনার গ্ৰন্থ রচনা করেন। এখান থেকে কবির সামান্য পরিচয় পাওয়া যায়।
৭) আগমনী ও বিজয়া পর্যায়ের পদে তিনি শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছেন।
৮) কমলাকান্তের ভনিতায় প্রায় শ'তিনেক পদ পাওয়া গেছে।

জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী কমলাকান্ত সম্পর্কে বলেছেন— "কমলাকান্তের আগমনী গান ভরা ভাদরের নদীর মত বেগবতী, উচ্ছল, উদ্বেল, তাহার বিজয়া সঙ্গীত বিজয়ার সানাইয়ের মত করুন ও মর্মস্পর্শী।"

**কিছু গুরুত্বপূর্ণ শাক্তপদাবলী ও তার পদকর্তা**

১) বাছার নাই সে বরণ নাই আভরণ ... আগমনী - হরিশ্চন্দ্র মিত্র
২) কুস্বপন দেখেছি গিরি... আগমনী - গিরিশচন্দ্র
৩) গিরি গৌরী আমার এল কৈ? ... আগমনী - গোবিন্দ চৌধুরী
৪) ওহে গিরি কেমন কেমন করে প্রাণ... আগমনী - ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
৫) দেখে আয় তোরা হিমাচলে .. আগমনী - নবীন চন্দ্র সেন
৬) বসিলেন মা হেমবরণী... আগমনী - দাশরথী রায়
৭) যেয়ো না রজনী, আজি লয়ে তারা দলে... বিজয়া - মধুসূদন দত্ত
৮) মনেরি বাসনা শ্যামা শবাসনা শোন মা বলি... ভক্তের আকুতি - দাশরথি রায়
৯) এবার কালী তোমায় খাবো... রামদুলাল নন্দী - মনোদীক্ষা
১০) সকলি তোমারি ইচ্ছা... রামদুলাল নন্দী
১১) গিরি গৌরী আমার এসেছিল... আগমনী- দাশরথী রায়
১২) ছিলাম ভালো জননী.. আগমনী- অম্বিকাচরণ গুপ্ত
১৩)আনো আনো ত্বরায় গিরি... আগমনী- অন্ধচন্ডী
১৪) গিরি যায় সে লয়ে হর..বিজয়া- দাশরথী রায়।

###কয়েকটি শাক্তপদাবলী বিষয়ক আলোচনা গ্রন্থ :

1)ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য-ড.শশিভূষণ দাশগুপ্ত।
2).শাক্তপদাবলী-ত্রিপুরাশঙ্কর সেনশাস্ত্রী।
3).শাক্তপদাবলী-ধ্রুবকুমার মুখোপাধ্যায়।
4) শাক্তপদাবলি ভাব ও শিল্পসৌন্দর্য /অমরেন্দ্র গণাই।
5) শক্তিদর্শন ও শাক্ত কবি / দেবরঞ্জন মুখোপাধ্যায়।
6)শাক্ত পদাবলী / অরুনকুমার বসু।
7=প্রসঙ্গ শাক্ত পদাবলী / ড. ক্ষেত্রগুপ্ত।
8)শাক্ত পদাবলী / ড. ব্রজেন্দ্রচন্দ্র ভট্টাচার্য।
9). শাক্তপদাবলীঃভাব-রূপ-প্রতিমা / ড. রামজীবন আচার্য।
10)শাক্ত-পদাবলী পাঠের ভূমিকা / ড. সুশোভন মুখোপাধ্যায়।
11) বাংলার শাক্তভাবাপন্ন মুসলমান কবি /অমিয়শঙ্কর চৌধুরী।
12)শক্তিগীতি - প্রমথনাথ মন্ডল।

তথ্যসূত্র :
বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ।
বাংলা সাহিত্য পরিচয় - পার্থ চট্টোপাধ্যায় ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - দেবেশ কুমার আচার্য ।
এবং উইকিপিডিয়া।

♦আলোচনায় :  রিয়া ♦
♦অ্যাডমিন, সাকসেস বাংলা ♦

Share this