বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে চণ্ডীদাস সমস্যা ও সমাধান


     মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যকে অনুধাবন করা অনেকটাই অন্ধের হস্তীদর্শনের মতোই অনিশ্চিত, অনির্দিষ্ট এবং ভ্রান্তিমূলক। তবুও আমাদের পরম ভাগ্য যে,আমরা অর্বাচীন যুগে এমন কয়েকজন অনিসন্ধিৎসু,বিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তিকে পেয়েছি; যাঁদের নিরলস কর্মপন্থায় মধ্যযুগীয় যুক্তিহীন কূজ্ঝটিকা অনেকটাই লাঘব হয়েছে আধুনিকতার মুক্তাকাশে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি সত্যিই কিছুটা নড়বড়ে, অথচ গুণগতভাবে সমৃদ্ধিতে ভরপুর।
     আধুনিককালে নানা জিজ্ঞাসা মানুষকে বহুমুখী প্রশ্ন করতে শিখিয়েছে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের পঠন ও বিশ্লেষণে চণ্ডীদাস সম্পর্কিত প্রথম সারির কয়েকটি জিজ্ঞাসা হল--
★ আচ্ছা, বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস কতজন?
★ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কোন চণ্ডীদাস রচনা করেছেন?
★ বৈষ্ণব পদাবলীর চণ্ডীদাস আর শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রচয়িতা কি একজন ব্যক্তিই?
★ অনন্ত, বড়ু, দ্বিজ, দীন এই উপাধি গুলি কি একই ব্যক্তির, না কি পৃথক পৃথক?
ইত্যাদি ইত্যাদি।
■ বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে ১৯১৬ খ্রী. শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য প্রকাশিত হয়। প্রসঙ্গত বলছি; 'কীর্তন' কথাটির যে আলংকারিক সংজ্ঞা হয়,তার সঙ্গে কাব্যটির কোনো সাযুজ্য নেই।
(ড.বিমানবিহারী মজুমদার তাঁর 'ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য'[পৃ.২৩৪] গ্রন্থে এই কাব্যটির নাম 'রাধাকৃষ্ণের ধামালী' হওয়াটাই বাঞ্ছনীয় মনে করেছেন।) এছাড়াও কাব্যটির বিষয়গত বিচারে এর নাম যে 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ' হওয়া উচিৎ ছিল, তা শুধু ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নন,ড.অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়,ড.বিজনবিহারী মজুমদার এবং ড.অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য প্রত্যেকেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন।
 শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের কবি আসলে কে ??
আমরা জেনে অভ্যস্ত যে, এই কাব্যের কবি বড়ু চণ্ডীদাস। কিন্তু সমস্যা হল, 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ' পুথিটির মোট ৪০৩টি ভণিতার মধ্যে ২৮৯ টিতে 'বড়ু চণ্ডীদাস', ১০৭ টিতে শুধু 'চণ্ডীদাস' এবং ৭টিতে 'অনন্ত' বা 'অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস' নাম রয়েছে। এছাড়াও নামহীন ভণিতার সংখ্যা ৫টি।
তাহলে প্রশ্ন হল এঁদের মধ্যে কে 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যে'র প্রকৃত কবি?
ড.শহীদুল্লাহ মনে করেন, 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে'র কবির নাম 'অনন্ত'। তাঁর কৌলিক উপাধি 'বড়ু'। আর 'চণ্ডীদাস' তাঁর দীক্ষাগুরুর নাম। ড. সু,সেন বলেন, পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলে গোয়ালা,কৈবর্ত প্রভৃতি জাতির মধ্যে 'বড়ু' পদবী প্রচলিত ছিল। আবার এমনটাও হতে পারে যে, নীচু জাতির নারীর সঙ্গে প্রেম করে সমাজে পতিত হয়ে কবি 'বটু' বা 'বড়ু' হয়েছেন। (প্রবন্ধ বিচিত্রা,৪র্থ সংস্করণ)
■ এছাড়াও সাম্প্রতিক কালে প্রমাণিত হয়েছে যে, 'বাশুলী' ও 'চণ্ডী' আসলে এক ও অভিন্ন দেবী। কবি জানিয়েছেন, তিনি 'বাশুলী'র সেবক ছিলেন, অর্থাৎ দাস। সেই সূত্র ধরে তাঁর নাম 'চণ্ডীদাস' হওয়া অস্বাভাবিক বিষয় নয়। আর সঙ্গত কারণেই হয়তো তৎকালীন অনেক মানুষের নাম ছিল চণ্ডীদাস, এই অনুমানও অযৈক্তিক নয়।
উপরিক্ত দুজন পণ্ডিতের মন্তব্য বিশ্লেষণে এটা অন্তত স্পষ্ট যে, 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্যের কবি 'বড়ু চণ্ডীদাস'। অর্থাৎ কবির নাম 'অনন্ত চণ্ডীদাস' অথবা 'বড়ু চণ্ডীদাস' যাইহোক না কেন তিনি একক ও অভিন্ন ব্যক্তি।
     মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে আমরা চণ্ডীদাস নামে অন্ততপক্ষে পাঁচজন কবির নাম পাই। তাঁরা হলেন- বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস, দ্বিজ চণ্ডীদাস এবং একই নামের শেষ কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস(ইনি চট্টগ্রামের)। এঁদের মধ্যে..
     প্রথম চণ্ডীদাস হলেন 'শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ' গীতিনাট্যের রচয়িতা এবং এই নামের সর্বপ্রাচীন কবি অনন্ত বড়ু চণ্ডীদাস। আনুমানিক তিনি ১৪২৫ খ্রী. আগেই তাঁর কাব্য রচনা করেন।
     দ্বিতীয় চণ্ডীদাস হলেন চৈতন্য পূর্ববর্তী কালের বৈষ্ণব পদ রচয়িতা জনপ্রিয় কবি। স্বয়ং চৈতন্যদেব পর্যন্ত তাঁর পদের রসমাধুর্য আস্বাদন করতেন। ইনি আনুমানিক ১৪৫০-১৫০০ খ্রী. পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
     তৃতীয় চণ্ডীদাস হলেন দীন চণ্ডীদাস। ইনি কৃষ্ণলীলার আখ্যানকাব্য তথা পালা গানের রচয়িতা। তিনি খুব একটা বিখ্যাত বা উচ্চাঙ্গের কবি নন। সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের কবি ছিলেন দীন চণ্ডীদাস।
     চতুর্থ চণ্ডীদাস হলেন সহজিয়া সাধকদের মনগড়া কবি দ্বিজ চণ্ডীদাস। প্রকৃতপক্ষে এই কবির কোনো বাস্তব অস্তিত্ব ছিল না। ড.আহমদ শরীফ স্যারও মন্তব্য করেছেন,
 এই দ্বিজ চণ্ডীদাস বলে আদৌ কোন কবি ছিলেন কি-না বলা যাবে না।  
 (বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, পৃ.২৭৮)
    অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে লিপিকৃত দুটি পুথিতে দ্বিজ চণ্ডীদাসের কিছু পরিচয় পাওয়া গেলেও তার নির্ভর যোগ্য কোনো প্রমাণ মেলে না। তাই এই কবির অস্তিত্ব অস্বীকার্য।
     পঞ্চম চণ্ডীদাস, এই কবির নামও হল দ্বিজ চণ্ডীদাস। অর্থাৎ হুবহু এক নামে দুজন কবির পরিচয় পাওয়া যায়। তবে পূর্ববর্তী কবি দ্বিজ চণ্ডীদাসের অস্তিত্ব অস্বীকার্য হলেও এঁর অস্তিত্ব স্বীকার্য। আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ চট্টগ্রাম থেকে 'কলঙ্কভঞ্জন' নামে দ্বিজ চণ্ডীদাসের একটি পুথি আবিস্কার করেন। এই পুথির লিপিকাল ১৮২০ খ্রী.। ইনি সম্ভবতঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের চট্টগ্রামবাসী একজন সাধারণ কবি।
      সমস্যার সমাধানের জন্য  চণ্ডীদাসী তালিকা থেকে যদি দ্বিজ চণ্ডীদাস নামটি বাদ দিই, তবে আমরা তিনজন চণ্ডীদাসকে পাব। যথা- বড়ু চণ্ডীদাস, চণ্ডীদাস এবং দীন চণ্ডীদাস। এঁরা প্রত্যেকেই রাঢ় অঞ্চলের লোক। খগেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর 'বাংলা সাহিত্যের আলোচনা' গ্রন্থে একথা প্রমাণ করেছেন। আর এক অঞ্চলের লোক হওয়ায় শুরু হয়েছে নানা বিভ্রাট। তাছাড়াও পদাবলীর চণ্ডীদাস আর বড়ু চণ্ডীদাসের মধ্যে সময়ের পার্থক্যও ততটা প্রকট নয়। চণ্ডীদাস সংক্রান্ত দুরূহ সমস্যার সমাধান করার একটি নির্ভরযোগ্য পথ হল, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন ও বৈষ্ণব পদাবলী এই দুই পর্যায়ের ভাব,ভাষা এবং চরিত্রবিচার। অর্থাৎ একই কবির রচনাতে এইসব প্রভেদ থাকতে পারেনা।
 শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য সম্পর্কে ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহের সুচিন্তিত অভিমতকে নিজের ভাষ্যে উপস্থাপন করছি - - -
ক) বড়ু চণ্ডীদাসের ভণিতায় কোনো স্থানে 'দ্বিজ চণ্ডীদাস' উল্লেখ নেই।
খ) এই কাব্যে 'চন্দ্রাবলী' রাধার নামান্তর।
গ) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে রাধিকা গোয়ালিনী মাত্র, রাজকন্যা নন।
ঘ) বড়ু চণ্ডীদাস মোটেই ব্রজবুলি ভাষা জানতেন না।
ঙ) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের বাইরে বড়ু চণ্ডীদাসের পদ নেই। অর্থাৎ তাঁর ভণিতায় কোনো বিক্ষিপ্ত পদ পাওয়া যায়নি।
চ) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ভাষার ব্যাকরণে এমন কতগুলি প্রাচীনত্বের লক্ষণ আছে, যা মধ্যযুগীয় পদাবলীতে দুষ্প্রাপ্য।
ছ) পদাবলীর চণ্ডীদাস 'বাশুলী' সেবক ছিলেন।কিন্তু বড়ু চণ্ডীদাস কোথাও 'বাশুলী আদেশে কহে' এইরকম ভণিতা ব্যবহার করেননি।
জ) শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে কবি স্থুলরুচির আদি রসের ধামালী রচনা করেছেন,কিন্তু পদাবলীর চণ্ডীদাস আবেগ অনুভূতিকে সহজ সরলভাবে মানবীয় জীবনরসে অতি উচ্চ ভাবানুভূতিতে প্রকাশ করেছেন।
   সুতরাং একথা অন্তত বলা আবশ্যক যে,চণ্ডীদাস নামের যে দুজন কবি অতি জনপ্রিয় ও লোককথিত, তাঁদের একজন লিখেছেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য; অপরজন পদাবলীর রচয়িতা। দ্বিজ চণ্ডীদাস নামের দুজন কবি এবং দীন চণ্ডীদাস এঁরা তেমন কোনো আলোচিত কবি নন। সাধারণ আলোচনায় এঁদের অবলীলায় বাদ দেওয়া যেতে পারে। ড.বিমানবিহারী মজুমদার বলেন,
বিশেষণ হীন একজন 'চণ্ডীদাস' ছিলেন বলিয়াই পরবর্তী কালে বড়ু চণ্ডীদাস,দ্বিজ চণ্ডীদাস, দীন চণ্ডীদাস, আদি চণ্ডীদাস প্রভৃতি চণ্ডীদাসকে চিহ্নিত করার প্রয়োজন হইয়াছিল। 
(ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য, পৃ.২৩১-২৩২)
     এই মন্তব্য থেকেও সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে শুধু 'চণ্ডীদাস' নামে বঙ্গদেশে একজনই কবি ছিলেন। তিনিই পদাবলীর চণ্ডীদাস, তিনিই পূর্বরাগ ও আক্ষেপানুরাগ পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ মননশীল কবি। বস্তুত: মধ্যযুগীয় বঙ্গদেশে 'চণ্ডীদাস' নামটি অনেকটা উপাধির মতো (যেহেতু 'বাশুলী' বা 'চণ্ডী'র সেবক অর্থে দাস।) ব্যবহৃত হতো বলেই এই ধরনের বিপত্তির সৃষ্টি হয়েছে। উক্ত পাঁচজন কবি ছাড়াও বাংলাদেশে আরো প্রচুর চণ্ডীদাস নামের লোক খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু;যেহেতু তাঁরা কোনো পদ বা কাব্য রচনা করেননি, তাই তাঁরা এই আলোচনায় ব্রাত্য। চণ্ডীদাসী গতিপথ বিচ্যুত।

গ্রন্থঋণ
সাহিত্যের ইতিহাস-সুকুমার সেন ,অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
 বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য- আহমদ শরীফ
 ষোড়শ শতাব্দীর পদাবলী সাহিত্য-বিমানবি
হারী মজুমদার
আলোচক ধনঞ্জয় চক্রবর্তী
অ্যাডমিন সাকসেস বাংলা

Share this