বাংলা লিপির উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ



* বাংলা ভাষা উৎপত্তি সম্পর্কে আমরা বিস্তর আলোচনা করি কিন্তু, বাংলা লিপির উদ্ভব কিভাবে হল, বা এর বিবর্তনই বা হল কিভাবে, এ নিয়ে খুব একটা আলোচিত হয় না। আজ বাংলা লিপির উৎপত্তি ও তার ক্রমবিকাশের ধারণাটি স্পষ্ট করার চেষ্টা করব।
* বর্তমান কালে ভারতবর্ষে প্রচলিত সব লিপিরই মূল উৎস 'ব্রাহ্মীলিপি'। খ্রিঃ পূর্ব ৩য় শতকে অশোকের বিভিন্ন অনুশাসনে এইলিপির নিদর্শন পাওয়া যায়।ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব সম্বন্ধে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। ১)কেউ কেউ বলেন ফিনিসীয় লিপি থেকে এই লিপির উদ্ভব। ২) আবার অনেকে মনে করেন সিন্ধুলিপি থেকেই ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব হতে পারে, কিন্তু সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না ৩) আবার কেউ কেউ বলেন ব্রাহ্মীলিপি স্বতস্ফূর্ত ভাবে ভারতেই উৎপত্তি লাভ করেছে। এবং অশোকের শিলালিপিতে এর পূর্ণ বিকশিত রূপ পাওয়া গেছে।
* সে যাই হোক  ব্রাহ্মীলিপির উদ্ভব বিষয়ে যতই মতান্তর থাকুক বাংলা লিপির উদ্ভব বিষয়ে সকল পণ্ডিতের মত মোটামুটি একই। আজ থেকে খ্রিস্টপূর্ব পাঁচশত বছরের আশপাশে কোন এক সময়ে ব্রাহ্মী লিপি থেকেই  বাংলা লিপির উৎপত্তি হয়েছিল। শুধু তাই নয় বর্তমান কালে ভারতের সব প্রচলিত লিপির জননী হল ব্রাহ্মীলিপি।
* আধুনিক বাংলা লিপির যে রূপ আমরা বর্তমানে দেখতে পাই তা এক দিনে গড়ে উঠেনি। বাংলালিপির বিবর্তনেরও ঘটেছে সুদীর্ঘ কাল ধরে। ব্রাহ্মীলিপি কালক্রমে বিবর্তিত হয়ে যায়। এই বিবর্তিত ভারতীয় লিপিকে লিপি কে বিজ্ঞানীরা নাম দেন গুপ্তলিপি । এই গুপ্তলিপি আবার দুটি উপ-
আঞ্চলিক ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে পূর্ববর্তী লিপি ও পশ্চিমা লিপি নামে । পূর্ববর্তী লিপি পুনরায় দুটি উপধারায় বিভক্ত হয়ে স্থান বদলে আবারও পূর্বী ও পশ্চিমা- নাম ধারণ করে। প্রখ্যাত ভাষাবিদ ডঃ
সুকুমার সেন মনে করেন যে, "গুপ্তলিপির উপধারা পূর্ববর্তী ধারার পশ্চিমা উপ-আঞ্চলিক ধারা থেকে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে সিদ্ধমাতৃকা লিপির জন্ম হয়। এই সিদ্ধমাতৃকা লিপির একটি জটিলতর রূপ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে গড়ে ওঠে, তার নাম হয় কুটিল লিপি ।
গুপ্তযুগের পর সপ্তম শতক বাংলালিপি বিবর্তনের
একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। খ্রিষ্টিয় সপ্তম থেকে নবম শতকের মধ্যে অক্ষরের উপর মাত্রা দানের রীতি প্রবর্তিত হয়।এই বর্ণে বিশেষতঃ স্বরের বর্ণের বাঁক (কুটিল) নেওয়ার রীতি ছিল বলে এই লিপিকে কুটিল লিপি বলা হয়।আর এই কুটিল লিপি থেকেই বাংলা লিপির উদ্ভব ঘটে।তবে
কোন কোন লিপিবিজ্ঞানী দ্বিমত পোষণ করে অভিমত প্রকাশ করেন যে, সিদ্ধমাতৃকা লিপির নাগরী শাখা থেকে বাংলা লিপির জন্ম হয়েছিল।
* যাই হোক, দ্বিমত সত্ত্বেও প্রত্ন-বাংলা লিপির নিজস্ব রূপটি যে খ্রিস্টীয় নবম-দশম শতাব্দীতেই গড়ে উঠেছিল তা ভারতের ইতিহাসের কালে গর্ভ থেকে প্রাপ্ত অনুশাসনগুলিই প্রমান দেয়। নবম শতাব্দিতে রচিত ' নারায়ণ পালের তাম্রশাসনে' বাংকা লিপির সর্বপ্রাচীন রূপের সন্ধান পাওয়া যায়। রাজা মহীপালের বাণগড় দানলিপি, রাজা বিজয়সেনের দেওলপাড়া লিপিতে  এবং রাজা লক্ষণ সেনের তর্পণদীঘীর দানপত্রে আধুনিক বাংলা অক্ষরের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। এদের মধ্য "এ,  খ, ঞ, ত, ম, র, ল, ষ " প্রভৃতি অক্ষর গুলো একালের মতই। অন্য গুলোতে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
* তবে বাংলা ভাষার ও সাহিত্যের অদি নিদর্শন চর্যাপদ হলেও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পান্ডুলিপিতেই বাংলা লিপির পূর্ণ বিকশিত রূপ ও আকার ধরা পড়েছে । এর পরে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলা
লিপির গঠন বৈচিত্র্যে আর কোনো বিশেষ পরিবর্তন লৰ্য করা যায় নি। অবশ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষভাগে বাংলা লিপির আর একবার পরিবর্তন-পরিমার্জন করা হয় মুদ্রণযন্ত্রের লিপি কাঠামো তৈরীর উদ্দেশ্যে।
* ড. অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন- জাপানের কোনো মন্দিরে খ্রিস্টীয় দশম একাদশ শতাব্দীতে বাংলা অক্ষর লিখিত গ্রন্থ রৰিত আছে এবং যবদ্বীপে খ্রি. দ্বাদশ শতাব্দীতে বাংলা অক্ষরে লিখিত প্রত্নলিপি পাওয়া গেছে। জনপ্রিয়তা থাকেলেও এগুলি ছিল বাংলা লিপির অতি প্রাচীন রূপ, সাধারণের বোধগম্য নয়। বাংলা লিপির মুদ্রিত রূপের প্রাচীনত নিদর্শন ১৬৯২ খ্রিঃ লিখিত একখানি পাওয়া যায় বলে ফাদার হস্টেন উল্লেখ করেন। ১৭২৫ খ্রিঃ জার্মানিতে মুদ্রিত Ureht Szeb নামক গ্রন্থে কয়েকটি বাংলা সংখ্যা এবং "শ্রীসরজন্ত বলপকাং মার" এই নামে বাংলা অক্ষরে মূদ্রিত আছে।

* মুদ্রণযন্ত্রের এই বাংলা লিপির কাঠামো তৈরীর পিছনে যাঁর
ভূমিকা সর্বাগ্রে গণ্য তিনি হলেন স্যার চার্লস উইলকিন্স তিনি ভারতবর্ষের ছাপাখানা ও মুদ্রণশিল্পেরও জনক। তাঁর ভূমিকা ছিল একাধারে ধাতু শিল্পবিদ, খোদাইকর, ছ্যাঁচ নির্মাতা ও মুদ্রণকুশলীর। এ-কাজে তাঁর সহকারি ছিলেন তাঁরই এক বাঙালি কর্মচারী পঞ্চানন কর্মকার ও তার জামাতা মনোহর কর্মকার। স্যার চার্লস উইলকিন্স প্রাচীন অক্ষরের সঙ্গে কালীকুমার রায় ও খুশমৎ মুন্সী দুই ব্যক্তির হস্তাক্ষর মিলিয়ে যে বাংলা অক্ষরের কাঠামো দেন, তাকেই আদর্শ রূপে গ্রহণ করে মুদ্রণের অক্ষর তৈরি হয়। বাংলা মুদ্রণাক্ষর নির্মাণের পর হ্যালহেডের ব্যাকরণগ্রন্থ "A Grammer of the Bengali Language" হুগলীতে মাষ্টার এন্ডুজের ছাপাখানায় ১৭৭৮ খ্রীষ্টাব্দে মুদ্রিত হয়। এবং উইলকিন্স উদ্ভাবিত ধাতু নির্মিত চলনশীল বাংলা হরফের প্রথম নমুনা এ গ্রন্থেই পাওয়া যায়। তবে বিস্ময়ের বিষয় যে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুঁথির সময় থেকেই বাংলা লিপির যে আকার-আকৃতি গড়ে উঠেছিল তার ক্রমবিকশিত রূপটিকে সমনে রেখে উক্ত মূল পুঁথির লিপিকারদ্বয় কালীকুমার রায় ও খুসমৎ মুন্সীর হসত্দলেখার সঙ্গে মিল
রেখেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী স্যার চার্লস উইলকিন্স হ্যালহেডের ব্যাকরণের জন্য বাংলা ছাপা কাজে ব্যবহার্য ধাতু নির্মিত লিপির আদর্শ গড়ে দেন। স্যার চার্লস উইল্কিন্স নির্মিত বাংলা লিপিগুলি মোটামুটি দীর্ঘকাল পর্যন্ত বাংলা ছাপা লিপির আদর্শ হয়েছিল, কিন্তু আধুনাকালে
বাংলা বানান-সংস্কার ও ছাপার জগতে লিপির সৌন্দর্য্য বর্ধনে বিভিন্ন টাইপ প্রবর্তনের ফলে বাংলা লিপির সরলীকরণ হয়ে চলেছে। তবে এই আদর্শ গঠন হতে এখনও
বিচ্যুত হতে পারেনি। আজকের আমাদের বাংলা লিপির গঠন
চর্চার ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গেলে অন্তত পক্ষে এই টুকু অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয় যে, বাংলা লিপির উৎস ও পরিণতির ইতিহাসের পিছনে বহুকাল ব্যাপি বহু বিদ্ব্যৎসাহী মানুষের অক্লান্ত শ্রম ব্যয়িত হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলা লিপি
জটিলতর রূপ থেকে সরলীকরণ রূপটি পেতে বিচিত্র্য অভিজ্ঞতাও সঞ্চিত করেছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। যা বুঝে উঠা সত্যিই কঠিন।
* পরিশেষে বলা যেতে পারে বাংলা লিপি পূর্ব-ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপির সূদীর্ঘ আঞ্চলিক বিবর্তন ধারার চূড়ান্তরূপ। ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভব হলেও বর্তমানে ব্রাহ্মী হরফের সঙ্গে বাংলা লিপির তেমন কোন সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় না। আঞ্চলিক লিপিকারদের হাতে ক্রমশ পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা লিপি স্বতন্ত্র সত্ত্বা লাভ করেছে। স্বরবর্ণের চিহ্নগুলির আলংকারিক বাক নেওয়া রূপ (cursive ornamental medials)
বাংলার লিপিকারগণের নিজস্ব উদ্ভাবন। বাংলা লিপি থেকেই উদ্ভব হয়েছে নেপালী ও অসমীয়া বা অহম লিপির। বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের কাছাড় জেলায় বাংলা ভাষাভাষী জনগণের নিকট ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বাংলা লিপি বহুল প্রচলিত। বাংলা লিপি বাঙালীর গৌরবময় ঐতিহ্য। মায়ের ভাষার মত বাঙালীর আবেগ ও ভালবাসা জড়িয়ে আছে এই লিপির সঙ্গে।

আলোচক - সুশান্ত কর্মকার


Share this