বাংলার বহুরূপী - লুপ্তপ্রায় এক সংস্কৃতি

'বাংলার বহুরূপী---লুপ্তপ্রায় এক সংস্কৃতি।'
---------------------------------
নিত্যদিনের মতোই বেরিয়েছি কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ততাকে সঙ্গী করে বাস ধরার ইঁদুর দৌড় প্রতিযোগিতায় ,পাশে অভ্যাসের মতোই উৎসাহী কর্মহীন জনগণের তাড়না , দাদা,আরও জোরে,পেয়ে যাবেন। তাদের কথা মাথায় রেখে হৃদপিন্ড আর ফুসফুস টাকে কিছুক্ষনের জন্য পকেটে পুরে শরীরের শেষ প্রয়াস টুকু দিয়ে বাসের কাছে পৌঁছাতেই হটাৎ থমকে গেলাম কয়েক সেকেন্ডের জন্য । দেখি একজন আমার জামা ধরে টানছে। পিছন ফিরে দেখি স্বয়ং মা কালির আবির্ভাব। তার হাত টি পেতে আমায় বলছে , "আমায় কিছু দাও গো"। ভাবলাম মা, তোমার দয়ায়ই তো আমার সব পাওয়া, আজ তুমি আমার কাছে হাত পাতছো !একি তোমার দৈন্যদশা! " তোমার কি বা অভাব আছে ভিখারি ভিক্ষুকের কাছে, এ কেবল কৌতুকের বশে আমায় প্রবঞ্চনা" ।এদিকে চলমান বাস আমায় ফেলে দিয়েই তার জোর গর্জন তুলে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে,অগত্যা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে পড়লাম বাসে।সঙ্গীদের রাখা জানলার ধারে সিট তে বসে পড়ে দেখলাম মা কালি তখনও হাতটি পেতে ব্যর্থভাবে দাঁড়িয়ে আছে। চলমান বাস থেকে তার উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়েই "ঝুলি হতে দিলাম তুলে একটি ছোট কণা "
যতক্ষণ সে চোখের বাইরে বেরিয়ে গেল দেখতে থাকলাম অবাক হয়ে তাকে। হাত পেতে চলেছে সবার কাছে।কারোর কাছে পাচ্ছে একটা আধুলি বা কারোর কাছে জুটছে মুখ ঝামটা ।
চলমান চোখের বাইরে সে যেতেই মনে পরে গেল শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীনাথ (ছিনাথ) বহুরূপীর কথা।মেজদার, “দি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার!” অথবা পিসিমার সেই উক্তি, “রেখে দাও,ওটা তোমার অনেক কাজে লাগবে!” আমাকে বহুরূপীদের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে ছিল এরকমই একটি বাঘ।বাবার কোলে চেপে রক্ত হিম হয়ে গেছিলো ,হয়তো সেদিন কিছুক্ষনের জন্য আত্মারামও খাঁচা ছাড়া হয়ে গেছিলো আমার ,যখন সেই বাঘ রূপী বহুরূপীটি বাবার কথায় আমার ভয় ভাঙাতে আমার গায়ে হাত রেখেছিল।
আজকের এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই লিখতে একটু ইচ্ছে করলো এই বহুরূপীদের দের সম্পর্কে। তাই আজ আলোচনার বিষয়:-- 'বহুরূপী---হারি
য়ে যাওয়া এক সংস্কৃতি।'
দশম শ্রেণীর পাঠ্য একটি গল্প সুবোধ ঘোষের 'বহুরূপী' তেও আমরা এক বহুরূপী র সন্ধান পাই---হরিদা, যার পেশা ও নেশা বহুরূপী সেজে মানুষকে বিনোদন দেওয়া। এই হরিদা কে আমরা গল্পে দেখি বিভিন্ন সময় হরেক সাজে মানুষকে অবাক করা সাজে হতবাক ও বিস্মিত করতে।হয়তো এতে তার পেট ভরে না ঠিকমতো,জ্বলে না ভালো করে উনুনের আঁচও,তবুও হরি দা এই সাজে বেরোয় শুধু তার এই পেশার প্রতি ভালোবাসা আর মানুষকে একটু মজা দেওয়ার টানে।
প্রাচীন সাহিত্যে বহুরূপীদের উল্লেখ আছে বিভিন্ন জায়গায়। যদি আমরা রামায়ণ মহাকাব্যর কথাই ধরি, সেখানে সোনার হরিণ সেজে সীতাকে প্রলুব্ধ করা মারীচ রাক্ষসকে বহুরূপীদের পূর্বসূরী হিসেবে ধরা যেতেই পারে।
বহুরূপী দের জীবন সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদের জানতে হবে প্রথমে বহুরূপী কী এবং কী তাদের পরিচয়। বহুরূপী শব্দটি এসেছে দুটি সংস্কৃত শব্দের মেলবন্ধন থেকে প্রথমটি হচ্ছে ‘বহু’ যা কিনা আমাদের বাংলাতেও ব্যবহৃত শব্দ মানে ‘নানাপ্রকার’ আর ‘রুপ’ যেটির মানে চেহারা, সেই নানাপ্রকার চেহারা যারা ধারন করতে পারেন আর সেই ধারন করা রুপের চাল চলন আচার আচরণের একটু উচ্চকিত প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের মনরঞ্জনের চেষ্টা করে থাকেন তাঁরাই বহুরূপী। এ শুধু বাংলার নয় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের এক প্রচলিত লোকশিল্প। যার মাধ্যমে একসময় বহু মানুষ তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করতেন, বর্তমানে যদিও সে সংখ্যা ক্ষীয়মাণ তবুও তাঁরা আছেন, সময়ের সাথে বদলান রুচির সাথে হয়ত আপোস করতে হয়েছে তবুও এই লোকশিল্প এখনও অতীত নয়। এঁরা বর্তমানে শহরের পথে পথে বিভিন্ন দেব দেবীর বেশ বা রুপ ধারন করে যেটি করে থাকেন সেটিকে আমরা ভিক্ষার সাথে গুলিয়ে ফেলি বটে কিন্তু সেটা আমাদের একান্ত নিজস্ব সমস্যা। এই শিল্পের প্রাচীনত্ব এর বহু মাধ্যমে প্রয়োগ ইত্যাদির ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকাই তবে তা আমাদের শুধু অবাকই করে না, লজ্জিতও করে। নিজেদের উদাসীনতার ফলে কি ভাবে আমরা আরো একটি লোকশিল্পকে নষ্ট করে চলেছি সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে।
একটা সময় ছিল যখন এই বহুরূপীর সাজে মানুষ সারাবছর তাদের জীবিকা নির্বাহ করার তাগিদে গ্রাম থেকে গ্রামে গঞ্জে হাটে তাদের দর্শককুল কে খুঁজে নিয়ে তাঁদের মনরঞ্জনের জন্য বহু প্রকার প্রদর্শন করে থাকতেন নিত্যদিন। তখন ঘরে ঘরে টেলিভিষন বা শহরে খুব বেশী সিনেমা হল বা ভিডিও হল ছিল না। বিনোদনের উপায় ও ছিল বেশ সীমিত। প্রতিদানে বাড়ীর গৃহিনীর দেওয়া চাল ডাল ও জুটে যেত গঞ্জের হাটের হাটুরেদের দেওয়া টাকা পয়সাও জুটত, কিন্তু সেটাকে উভয়পক্ষের কেউই ভিক্ষা বলে ধরতেন না, কারন একটা বাড়ীর মহিলা শিশুদের দল কে বা হাটের একদল মানুষ কে একটা নির্দিষ্ট ধরনের বিনোদনের মাধ্যমেই তাঁরা এই উপার্জন করে থাকতেন। শুধু সাজই নয় তার সাথে থাকত নাচ বা গান বা দৈহিক কসরত ইত্যাদি।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই দেওয়া বা পাওয়ার ধরন গেছে পালটে, এখন আর শুধু নির্দিষ্ট দেব দেবীর কাহিনী বা বাঘ ভাল্লুক ইত্যাদি সেজে লোকের মনোরঞ্জন করা যায় না গ্রামে বা শহরে তাই যখন যা জোটে তাই গ্রহণ করতে হয় বাধ্য হয়ে। বর্তমানে চাষের কাজের শেষে এই শিল্পিরা তাদের শিল্পের সাধনা বা প্রদর্শন করে থাকেন গ্রামে গঞ্জে আর বিভিন্ন গ্রামীন মেলায়, সেই মেলা মোটামুটি বন্ধ হয়ে যায় বর্ষার আগমনে, তখন আবার ফিরে যাওয়া অন্য জীবিকায়। কেউ মধুর চাক নামাতে যান, কেউ বা দিন মজুরের কাজে ফিরে যান।
একটা সময় ছিল যখন বহুরূপীদের সমস্ত প্রদর্শন এক একটা নির্দিষ্ট গল্প নির্ভর হত। সেই কাহিনী অনু্যায়ী বেশভুষাও তাঁরা যোগাড় করতেন। গ্রামে গঞ্জে যেখানেই একজন বহুরূপী যান না কেন তাঁর সাথে থাকে তার নিজস্ব বেশভুষার বাক্স, তাতে জিঙ্ক অক্সাইডের মত রং থেকে অরম্ভ করে বিভিন্ন মুখোশ, কাপড় জামা, শ্রীকৃষ্ণের সুদর্শন, বাঁশি, মা কালীর খাঁড়া বা রাবনের এক্সট্রা মাথা সবকিছুই মজুদ। শুধু যে বেশ ও সাজে তাঁরা পারদর্শী হতেন তা নয় সাথে থাকত শারীরিক পারদর্শীতা ও তাৎক্ষনিক অভিনয় শৈলীর প্রয়োগ বা পরিবর্তন। স্বরক্ষেপন শৈলীকেও তাঁদের আয়ত্বে রাখেতে হত যথাযত ভাবে। মুহুর্তের ভগ্নাংশে পুরুষ কন্ঠ থেকে মহিলা কন্ঠে যাওয়া -আসায় তাঁদের অনায়াস দক্ষতা ছিল দেখবার মতো। শুধু মনুষ্য কন্ঠ নয় তাঁদের পারদর্শী হতে হত হরবোলার স্বরক্ষেপণে, গান লেখায় সুর দেওয়ায় এবং অভিনয়ের মধ্যে একক ভাবে ঠিক সময় মত সেগুলো প্রয়োগ করায়। এত কিছুর পরেও মনেরাখা উচিত এই পুরো ব্যাপারটাই কিন্তু একটা একক প্রদর্শন।
তার জন্যে যে পরিমাণ সাধনা ও শারীরিক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় সেটাকে চালু রাখার জন্য একটা ন্যুনতম সহায়তাও তাঁরা পান না, সেটাও নিজেদের যোগাড় করতে হয়। যে কোন শিল্প মাধ্যম যদি রাজানুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হয় তবে তা অবলুপ্ত হতে বেশী দিন লাগে না, উদাহরণ স্বরুপ রাঢ় বঙ্গের ভাদু,বোলান গান, নাচনী ও ঘোড়া নাচ, ও কবিগানের উল্লেখ করা যেতেই পারে। বহুরূপী কে বাঁচানোর একটা সরকারি চেষ্টা শুরু হয়েছিল ২০০২ – ২০০৩ সালে আমার খুব কাছের এই বীরভুম জেলায়,বহুরূপীদের জন্য বিখ্যাত যে লাভপুরে। কিন্তু সেটাও ছিল তাঁদের সামাজিক মুল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা। যাতে করে তাঁরা আর পাঁচজন সাধারন মানুষ যে ভাবে সমাজে বাঁচেন তাঁরাও যেন সেভাবে বেঁচে থেকেন। তাঁদেরকেও সেই একই ছাঁচে ঢেলে দেওয়ার প্রচেষ্টামাত্র। শিল্পকে প্রসারিত করে শিল্পীকে তাঁর হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া বোধহয় একে বলে না। তবে সে প্রচেষ্টা ও যে কতখানি সফল হবে সে ব্যাপারে একটা প্রশ্ন চিহ্ন রয়েই যায়, কারন বহুরূপীদের মধ্যে এক ধরনের যাযাবর মানসিকতার সুক্ষ উপস্থিতি। যাঁর মনের মধ্যে বিভিন্ন স্বত্তা লুকিয়ে আছে প্রকাশের অপেক্ষায়। তারপরে যে মানুষ তার প্রয়োগশৈলীর তারিফ হাতেনাতে পান তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে গৃহস্থ বানানোর চেষ্টা যে সার্থক হবে এমন আশ্বাস বোধহয় দেওয়া যায় না।
আবারও চোখে ভেসে উঠছে সেই আমার প্রিয় উপন্যাসটির কথা, আর সেই পরিচিত দৃশ্যটির কথা----" বেশ করিয়া দেখিয়া ইন্দ্র কহিল, দ্বারিকবাবু এ বাঘ নয় বোধহয় | তাহার কথাটা শেষ হইতে না হইতে সেই রয়েল বেঙ্গল টাইগার দুই হাত জোর করিয়া মানুষের গলায় কাঁদিয়া উঠিল, পরিষ্কার বাংলা করিয়া কহিল, না বাবুমশায় না, আমি বাঘ ভালুক নই | ছিনাথ বহুরূপী | ইন্দ্র হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল | ভটচাজ মশাই খড়ম হাতে সর্বাগ্রে ছুটিয়া আসিলেন—-হারামজাদা তুমি ভয় দেখাবার জায়গা পাও না ? পিসেমশাই মহা ক্রোধে হুকুম দিলেন, শালাকো কান পাকাড়কে লাও | কিশোরী সিং তাহাকে সর্বাগ্রে দেখিয়াছিল | সুতরাং তাহার দাবি সর্বাপেক্ষা অধিক বলিয়া সে-ই গিয়া তাহার কান ধরিয়া হিড়হিড় করিয়া টানিয়া আনিল | ভটচাজ মশাই তাহার পিঠের উপর খড়মের এক ঘা বসাইয়া দিয়া রাগের মাথায় হিন্দি বলিতে লাগিল…
…ছিনাথের বাড়ি বারাসতে | সে প্রতিবছর এই সময়টা রোজগার করিতে আসে | কালও এ বাড়িতে সে নারদ সাজিয়া গান শোনাইয়া গেছিল | সে একবার ভটচাজ মশাই, একবার পিসেমশাইয়ের পায়ে পড়িতে লাগিল | কহিল, ছেলেরা অমন করিয়া ভয় পাইয়া প্রদীপ উল্টাইয়া মহামারী বাধাইয়া তোলায় সে নিজেও ভয় পাইয়া গাছের আড়ালে গিয়া লুকাইয়া ছিল | ভাবিয়াছিল একটু ঠান্ডা হইলে বাহির হইয়া তাহার সাজ দেখাইয়া যাবে | কিন্তু ব্যাপার উত্তরোত্তর এমন হইয়া উঠিল যে তাহার আর সাহস হইল না |"
(শ্রীকান্ত:শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
ছিনাথ বহুরূপীদের সাহস আজও হয়নি ,সাহস হয়নি অন্য পেশায় চলে যাওয়ার |তাই আজও তাদের মতো কয়েকজনের জন্য শিবরাত্রির সলতের মতো টিমটিম করে হলেও টিকে আছে বহুরূপী প্রথা | ১৯১৫ সালে লেখা শরৎ-উপন্যাসে নিজের পারিশ্রমিক তো ছিনাথ পায়ইনি | উল্টে শাস্তিস্বরূপ তার বাহারি খড়ের লেজ কেটে নেওয়া হয়েছিল |
কেউ বলতে পারে না, বহুরূপী প্রথার মতো লৌকিক আচার গ্রাম বাংলার জীবনের সঙ্গে কবে থেকে জড়িয়ে আছে | আগে মাঝেমধ্যেই তাদের দেখা যেত | কিন্তু এখন শহরে তো বটেই | গ্রামেও তাদের আনাগোনা আটকে গেছে ,এদের কিছু দেখা মেলে চড়ক পুজোর সময় | কখনও কখনও তাদের চোখে পড়ে গ্রামের ভাঙা মেলার শেষ দিনেও | তাদের রংবাহারি সাজের ভিতর অবশ্যই থাকে কালী প্রতিমা | সেই রূপ ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’-এ তুলে ধরেছিলেন সত্যজিৎ রায় | যেখানে রবি ঘোষের কালী সাজ প্রকট করে তোলে কুসংস্কারের ভণ্ডতাকে | বিশপ লেফ্রয় রোডের দীর্ঘদেহীর আগে ঋত্বিক ঘটকও উপজীব্য করেছিলেন বহুরূপীদের | ১৯৬৫ তে | তাঁর ‘সুবর্ণরেখা’য় | বলিউডেও এই ধারায় উদাহরণ বিরল নয় | নাগেশ কুকুনুরের ‘ডোর’ সিনেমাতে শ্রেয়শ তলপাড়ে বহুরূপী সেজে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন নায়িকার দিকে | পৌঁছে দিয়েছিলেন অভীষ্ট গন্তব্যে |
বহুরূপীরা বারবার চলচ্চিত্রের বিষয় হয়ে উঠছে কেন ? হয়তো তাদের নিজের জীবন-জীবিকাই অভিনয় বলে | কখনও শিব, কখনও কালী, অথবা পৌরাণিক নানা চরিত্র | মুখে রং মেখে ফুটিয়ে তুলতে হয় তাদের | থিয়েটারে স্টেজ বা নিদেন যাত্রাপালার মঞ্চ নয় | ধুলোমাখা মেঠো পথ,গৃহস্থের বাড়ি এই তাদের অভিনয়ের পোডিয়াম | অভিনয়ের পর কোনও বাহবা তো দূর অস্ত, পারিশ্রমিক হিসেবে মেলে সামান্য কিছু টাকা | কখনও এক মুঠো চাল , কখনও তাও নয় | কিন্তু এই পেশায় ভিক্ষা করা নিষিদ্ধ |
ছিনাথ বহুরূপীর সময় তাদের অন্যতম কাজ ছিল বাচ্চাদের ভয় দেখানো | আজকের বাচ্চাদের ভয় দেখানোর জন্য আছে বোকা বাক্স,বিনোদনের রঙিন পসরা কে গায়ে মেখে শিশুরা মেতেছে রিমোটের বোতামে ,ছোটা ভীম, মোটু পাতলু, বা জাঙ্গল বুকের নেশায় | তাই তাদের দুধ খাওয়ানোর সময় বহুরূপীদের প্রয়োজন ফুরিয়েছে | এত সবকিছুর পরেও ফুরিয়ে যায়নি এই পেশাটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তাদের প্যাশন | তাই আজও যত্ন করে মুখে রং মাখে তারা | ঝোলায় রাখে পরচুলা, ত্রিশূল, কুঠার, তির ধনুক, পিচবোর্ডের তৈরি নকল হাত,মানুষের মাথার খুলি, সুদর্শন চক্র, বাঁশি, রবারের সাপ,কাগজের বানানো বাঘ-ভাল্লুকের মুখোশ | কী জানি কখন কার বেশ ধরতে হয়!
মেক আপের জন্য ভরসা সস্তার জিঙ্ক অক্সাইড, ভেসলিন, নারকেল তেল, সিঁদুর আর আলতা | শুধু সাজলেও তো শেষ হয় না কাজ | শিখে রাখতে হয় গলা কাঁপিয়ে গানের কৌশল | জেনে রাখতে হয় নাচের ‘স্টেপ’| আয়ত্তে রখতে হয় হনুমানের লম্ফ ঝম্পও |
তীব্র অনটনের বিরুদ্ধে লড়াই করা এই মুখগুলো রং মেখে ঢেকে নেয় নিজেদের কষ্ট | শুধু পৌরাণিক চরিত্রে খুশি নয় শহুরে দর্শক | তাই সাজতে হয় চার্লি চ্যাপলিন অথবা মাদার টেরেসাও বা হালফিলের ছোটা ভীম ,শক্তিমান ও। পরিবর্তনের স্রোতের সঙ্গে যুঝতে না পেরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে নাচনি প্রথা | খেমটা নাচের গায়েও লেগে গেছে বাবু কালচারের তকমা | এই পরিণতি থেকে খুব একটা দূরে নেই বহুরূপীরা | হাজারবার আজকের মত এরকম কালী সাজলেও তাদের জীবনে এখনও অধরা দীপাবলীর রঙ্গিন আলো | বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের ঘরে আরো ঘন হচ্ছে অমাবস্যার অন্ধকার।
শরত্চন্দ্রের শ্রীনাথ , বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বাঘবাহাদুররা এখন অতীত৷ শিকড় ভুলে বাঙালি মজেছে পণ্যায়নের সংস্কৃতিতে৷ গ্রাম বাংলার আর সব লোকশিল্পীর মতো কাজের অভাবে ধুঁকছেন বহুরূপীরাও৷ পেটের জ্বালায় পেশা ছেড়েছেন অনেকে৷ অনেকেই আবার বাপ -ঠাকুরদার রেওয়াজ বজায় রাখতে মন্দার বাজারেও নেশার মতোই আগলে রেখেছেন পেশা৷ এইশিল্প কে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের কিছু করে দেখানো প্রয়োজন,সত্যিই এদের জন্য কিছু ভাবতে হবে।এরা নমস্য। বীরভূমের লাভপুরের সাথে বেঁচে থাকুক অন্য সব বহুরূপীরাও,আর এদের সাথে বেঁচে থাকুক আমাদের সংস্কৃতি, এই চাই,এটাই তো আমাদের পরিচয় ।

আলোচনায়---অমিয়তোষ ঘোষ
(মডারেটর, success বাংলা)
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ (বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়)

Share this