বৈষ্ণব পদাবলী:রাধা তত্ত্ব



বৈষ্ণব পদাবলী--রাধা তত্ত্ব
    বৈষ্ণব পদাবলীকে অনেক সমালোচক বলেছেন বৈষ্ণব তত্ত্বের রসভাষ্য৷ কেউ আবার বলেছেন, বৈষ্ণব পদাবলী নাকি সমুদ্রগামী নদীর মতো প্রবাহমান ও গতিশীল৷যাইহোক, রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার আঁড়ালে বৈষ্ণব পদাবলীতে যে অনেক তত্ত্বকথা প্রকাশ পেয়েছে,একথা স্বীকার্য৷ এই তত্ত্বগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল - শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যতত্ত্ব,রাধাতত্ত্ব, সাধ্য-সাধন তত্ত্ব ও অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্ব৷
আমাদের আলোচ্য হল রাধাতত্ত্ব৷ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই এদেশে বৈষ্ণব পদ রচিত হয়েছে৷ মহাপ্রভূ নিজে অনেকসময় বিদ্যাপতি ও চন্ডীদাসের পদ শুনতে শুনতে মূর্চ্ছা (দিব্যজ্ঞান হারানো) যেতেন৷ বৈষ্ণব তাত্ত্বিকেরা চৈতন্যজীবনীকাব্যগুলি ও কিছু প্রামান্য সংস্কৃত গ্রন্থের ভিত্তিতে এই সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছেন যে, শ্রীচৈতন্যদেব রাধাকৃষ্ণের যুগল অবতার৷ তিনি বহিরঙ্গে রাধা ও অন্তরঙ্গে কৃষ্ণ৷ তত্ত্বমতে শ্রীকৃষ্ণই মনের তিনটি সাধ পূরণের জন্য শ্রীরাধার ভাবযুক্ত হয়ে শ্রীচৈতন্যরূপে আবির্ভূত হলেন৷ সেগুলি হল--
১)রাধার প্রেমের স্বরূপ কেমন,
২)রাধার প্রেমে কৃষ্ণ কেমন আনন্দ অনুভব করেন,
৩)কৃষ্ণপ্রেমের আনন্দ অনুভব করে রাধার মনে কিরূপ আনন্দ হয়,
এই সমস্ত কিছু উপলব্ধি করার জন্য প্রয়োজন ছিল রাধাকৃষ্ণের একই দেহে অবস্থান৷ রাধাকৃষ্ণ যে একত্মা ও অভেদ দেহ, সেই প্রসঙ্গের সঙ্গে এই চৈতন্যতত্ত্বটির যোগ আছে৷ 'চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থে কৃষ্ণদাস কবিরাজ বলেছেন--
"রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি৷
অন্যোন্যে বিলাসে রস আস্বাদন করি৷৷
সেই দুই এক এবে চৈতন্য গোঁসাঞি৷
ভাব আস্বাদিতে দোঁহে হৈল এক ঠাঞি৷৷"
এই দর্শনের উপর ভিত্তি করেই পরবর্তীকালে গৌরচন্দ্রিকা ও গোরাঙ্গ বিষয়ক পদগুলি রচিত হয়৷ চৈতন্যদেব আবির্ভাবের পর পূর্ববর্তী বৈষ্ণব পদাবলীর সঙ্গে চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়িয় দর্শন একস্রোতে মিশে যায়৷ তাই চৈতন্য পরবর্তী কবিরা আগে ভক্ত, পরে কবি৷ 
উল্লেখ্য, গৌড়িয় বৈষ্ণব পদকর্তারা শ্রীচৈতন্যের মতো প্রথমে রাধাভাবে ভাবিত হতেন এবং পড়ে কৃষ্ণসাধনা করতেন৷ বৈষ্ণবীয় রসশাস্ত্রে একেই বলা হয়েছে রাধা-তত্ত্ব৷ শ্রীচৈতন্যদেবও গুরু পরম্পরায় মাধবেন্দ্রপুরী, ঈশ্বরপুরীর কাছ থেকে রাধাভাবটি আত্মস্থ করেছিলেন৷ চৈতন্যজীবনীকাব্যে পাই -
"ইষ্টগোষ্ঠী কৃষ্ণকথা কহি কতোক্ষণ৷
প্রভুপদে ধরি রায় করে নিবেদন৷৷
কৃষ্ণতত্ত্ব, রাধাতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব সার৷ 
রসতত্ত্ব লীলাতত্ত্ব বিবিধ প্রকার৷৷" 
শ্রীমদ্ভাগবতে রাধা নামটির সেভাবে উল্লেখ না থাকলেও বিষ্ণুপুরাণ ও ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে রাধাতত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে৷ ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে শ্রীমতি রাধা শ্রীকৃষ্ণের অর্ধাংশস্বরূপা, আবার তিনিই মূল প্রকৃতি; তিনিই সৃষ্টির আধার৷ তাই এই পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং রাধাকে বলেছেন -- দুধে যেমন সাদা রঙ মিশে থাকে, অনলে যেমন দহিকা শক্তি বিরাজ করে, গন্ধ যেমন পৃথিবীকে আশ্রয় করে অবস্থান করে; আমিও তেমনি তোমার মধ্যে বিরাজ করছি৷ আমাদের কোনো ভেদ নেই৷ গৌড়ীয় বৈষ্ণব তাত্ত্বিকগণ মনে করেন, লীলারস আস্বাদনের জন্য কৃষ্ণ ও রাধা আলাদা দেহ স্বীকার করলেও চৈতন্যদেবের মধ্যে তাঁরা পুনরায় ঐক্য লাভ করেছেন৷ এই বিষয়টির সঙ্গে অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বের যোগ আছে৷ বৃন্দাবনের গোপিকাগণের প্রেম ছিল কামগন্ধহীন, তাঁদের মধ্যে আত্মেন্দ্রিয় প্রীতিবাঞ্ছা ছিল না,ছিল কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতিবাঞ্ছা৷ কবিরাজ গোস্বামী এই কাম ও প্রেমের পার্থক্য দিয়েছেন এভাবে--
"আত্মেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা তারে বলি কাম৷
কৃষ্ণেন্দ্রিয়-প্রীতি-ইচ্ছা ধরে প্রেম নাম৷৷"
আর গোপিদের মধ্যে রাধার শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করেছেন এভাবে ----
"সেই গোপীগণ মধ্যে উত্তমা রাধিকা৷
রূপে গুণে সৌভাগ্যে প্রেমে সর্বাধিকা৷৷"
রাধার প্রেম যে গোপিগণের প্রেমের থেকে আলাদা, তা গৌড়িয় বৈষ্ণবতত্ত্বে স্বীকার্য৷শ্রীমতি রাধা শ্রীকৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি৷ শ্রীকৃষ্ণ ও রাধার প্রেমের তীব্র প্রকাশ ঘটেছে শ্রীচৈতন্যের মধ্যে৷ এই বিষয়টিই গৌড়িয় বৈষ্ণবতত্ত্বে রাধাতত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত৷ শ্রীমন্মহাপ্রভুর কাছ থেকেই এই তত্ত্বটি পরবর্তীকালে বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী জানতে পেরেছিলেন৷


আলোচক - ধনঞ্জয় চক্রবর্তী
(বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, কোচবিহার।

Success বাংলা)


Share this