বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্য




বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্য
................................................... 
     মানব সভ্যতার ইতিহাসে গোয়েন্দা গল্পের ধারা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মতো স্বাভাবিক ভাবেই বহমান ছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দা গল্পের প্রকৃতি পাল্টাচ্ছে। আমাদের দেশজ সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্পের সৃষ্টিকর্তা কে তা বলা কঠিন,আশ্চর্যের বিষয় প্রাচীন বৈদিক যুগ ঋগবেদের দশম মন্ডলের সূত্রতে প্রথম গোয়েন্দার সন্ধান পাওয়া যায়। আমার আলোচনার বিষয় বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা গল্প সৃষ্টিকারী লেখক ও গোয়েন্দা চরিত্র। কালানুক্রমিক ভাবে এই বিষয়টি উপস্থাপন করা হল–
1) ১৮৯২ সাল থেকে সরকারী ডিটেকটিভ বিভাগে কর্মরত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের গল্পে সিরিজ প্রথম বের হতে থাকে  'দারোগার দপ্তর' নামে।প্রথম  বই 'বনমালী দাসের হত্যা '।
2)ভুবন চন্দ্র মুখোপাধ্যায় কেলেঙ্কারি ও অপরাধ মূলক ঘটনা নিয়ে লেখেন 'হরিদাসের গুপ্তকথা'যা ১৮৯৬ এ ছয় খন্ডে 'মার্কিন পুলিশ কমিশনার নামে'প্রকাশিত হয়।
3) কালীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৬ এ 'বাঁকাউল্লার দপ্তর' প্রকাশ করেন।
5) গিরিশ চন্দ্র বসু লেখেন 'সেকালের দারগা কাহিনি' (১৮৯৩-৯৪) নবজীবন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
6) 'ভারতী' পত্রিকায় প্রকাশিত গোয়েন্দা গল্প গুলি হল-নগেন্দ্রনাথ গুপ্তের ('চুরি না বাহাদুরি', ১২৯৮),হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের ('হত্যাকারী কে', ১২৯৭) প্রমুখ। হরিসাধনের 'আশ্চর্য হত্যাকান্ড'(সখা ও সাথী)তে প্রকাশিত গল্পটি গবেষকদের মতে প্রথম বাংলা কিশোর থ্রিলার।
7) দীনেন্দ্র কুমার রায় এর প্রথম মৌলিক রচনা 'উদোর ঘিরে বুদোর বোঝা' (১২৯৯)।'নন্দন কানন' পত্রিকায় অন্য নামে তিনি লিখতেন। তাঁর বিখ্যাত গল্প গুলি 'আয়েষা,' 'শী,' 'চীনের ড্রাগন' প্রভৃতি ।তিনি 'রহস্য লহরী 'নামে গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ প্রকাশ করে থাকেন।
8) বাংলা গোয়েন্দা গল্পের বাঁক বদল করলেন পাঁচকড়ি দে। ইনিই প্রথম বাংলা গল্পের দুটি ডিটেকটিভ চরিত্র সৃষ্টি করলেন -দেবেন্দ্রবিজয় ও তার সহকারী অরিন্দম। তাঁর 'নীলবাসনা', 'মায়াবিনী', 'রহস্য বিপ্লব 'ইত্যাদি।
9) ত্রিশের দশকে রোমাঞ্চ পত্রিকার হাত ধরে প্রণব রায় আনলেন গোয়েন্দা প্রতুল লাহিড়ীকে।
10)সুরেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন। সেই গুলি হলো-'দুই দারোগা', 'নকল রানী,'ধরিবাজ চোর ইত্যাদি।
11)বাংলা সাহিত্যে সরলাবালা দাসী গোয়েন্দা কাহিনির প্রথম মহিলা লেখিকা। তাছাড়া বাংলা সাহিত্যে মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র প্রথম কল্পনা করেচ্ছেন প্রভাবতী দেবী সরস্বতী।তাঁর প্রথম উপন্যাস 'গুপ্তঘাতক' (১৯৫২)।
12)বাংলা গোয়েন্দা কাহিনিতে নতুনত্ব নিয়ে আসেন হেমেন্দ্র কুমার রায়। তিনিই প্রথম ডিটেকটিভ ভাবনায় বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঞ্চার করেছিলেন। তাঁর 'জয়ন্তের কীর্তি,' 'শনি মঙ্গলের রহস্য', 'সাজাহানের ময়ূর 'ইত্যাদি বহু পরিচিত।
13) বাংলা গল্পের শক্তিশালী লেখকদের মধ্যে প্রথমেই মনে পড়ে নীহারঞ্জন গুপ্তের নাম। সাহেব গোয়েন্দা কিরীটি রায় তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি। তাঁর শ্রেষ্ঠ অপরাধী চরিত্র কালোভ্রমরকে ভোলা যায় না।
14)সুকুমার সেন বাংলা গোয়েন্দা কাহিনির শ্রেষ্ঠ লেখকের মর্যাদা দিয়েছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সী আমাদের সকলের কাছে প্রিয় চরিএ হয়ে উঠেছে। তাঁর কয়েকটি উপন্যাস হল – 'চিরিয়াখানা', 'মাকড়সার রস', 'চোরাবালি' ইত্যাদি।১৩৩৯ এ 'বসুমতী'পত্রিকার 'পথের কাঁটা' দিয়ে ব্যোমকেশ এ যাত্রা শুরু।
15)উপেন্দ্রকিশোর রায়ের নাতনী নলিনী দাস ষাটের দশকে বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে আনলেন মেয়ে গোয়েন্দার দল 'গন্ডালু'। সন্দেশ পত্রিকায় এই 'গান্ডালু' র আবির্ভাব। ২৯ টি নলিনী তাদের হাজির করেছেন।
16)সত্যজিৎ রায় ১৯৬৫ তে ফেলুদার গোয়েন্দা গিরি দিয়ে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর সৃষ্ট ফেলুদা অর্থাৎ প্রদোষ চন্দ্র মিত্র,তোপসে,লাল মোহন গাঙ্গুলী চরিত্র গুলি অনবদ্য।
17)মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য ১৯২৮ সালে রামধনু পত্রিকায় তাঁর জাপানি গোয়েন্দা হুকোকাশির আবির্ভাব ঘটালেন পদ্মরাগ উপন্যাসে।তাঁর সম্পাদিত 'রহস্যচক্র' নামে গোয়েন্দা সিরিজ প্রকাশ হতো। এখানে প্রথম গজেন্দ্র কুমার মিত্র লেখেন 'রেশমী ফাঁস' ।
18)পঞ্চাশের দশকে দেব সাহিত্য কুঠীরের হাত ধরেই স্বপন কুমার আনলেন 'বিশ্বচক্র সিরিজ'।

19)দেব সাহিত্য কুঠীর থেকে সৌরীন্দ্র মোহন মুখোপাধ্যায় ছদ্মনামে সব্যসাচী র আড়ালে লেখেন 'প্রহেলিকা' সিরিজ।
20)১৯৩৮ এ জেনারেল অ্যান্ড পাবলিশার্স লিমিটেড থেকে মিহির কুমার সিংহের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন 'বিচিত্র রহস্য' সিরিজ।
21)১৯৪২ সাল থেকে শশধর দত্তের মোহন সিরিজ প্রকাশিত হতো।
22)১৯৫৬ তে রোমাঞ্চ পত্রিকায় প্রেমেন্দ্র মিএ গোয়েন্দা পরাশর বর্মাকে পাঠকের কাছে হাজির করলেন। প্রথম লেখা 'গোয়েন্দা কবি পরাশর'।
23)গোয়েন্দ্র গল্পে যুক্তি বুদ্ধির দাপট দেখিয়েছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। তাঁর গোয়েন্দা গল্পে সৃষ্ট চরিএ কনেলকে।
24)নারায়ন সান্যাল এর 'কাঁটা সিরিজ' বেশ উল্লেখযোগ্য। তাঁর সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিএ গুলি হল পি.কে. বসু,শার্লক হেবো।
25)শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা চরিত্র বরদাচরণ। এই চরিএটি কিশোর পাঠ্য সাহিত্যে মজার চরিত্র। তাঁর সৃষ্ট আর একটি চরিত্র শবর দাশগুপ্ত পাঠকের কাছে খুবই জনপ্রিয়।
26)সমরেশ বসুও লিখেছেন ছোটদের জন্য গোয়েন্দা কাহিনি। তাঁর গোয়েন্দা গল্পের নায়ক গোগোল ঠিক গোয়েন্দা না হয়েও প্রবল অনুসন্ধিৎসু ও কৌতূহল প্রবণ। এর দ্বারা সে দোষীদের ধরিয়ে দিত।
27)সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটু অন্য ধরনের অ্যাডভেঞ্চার চরিএ বানালেন রাজা রায়চৌধুরী অর্থাৎ কাকাবাবুকে।
28)'রহস্য রোমাঞ্চ' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বিমল কর ও কবি অরুণ ভট্টাচার্য। বিমল করের সৃষ্ট চরিএ ম্যাজিশিয়ান কিকিরা ও দুই সহযোগী ।তাদের লক্ষ্য সত্য উদ্ঘাটন।
29)রহস্য পত্রিকার সম্পাদক গোবিন্দলাল বন্দোপাধ্যায় বিভিন্ন নামে লিখতেন। তাঁর প্রধান গোয়েন্দা দিলীপ সান্যাল ও তার সহকারী ত্রিদিব চৌধুরী।
30)কবি আনন্দ বাগচীর গোয়েন্দা সত্যপ্রিয়। তাছাড়া তারাপদ রায়, রবীন দেব, শ্রীধর চৌধুরী এবং অমিত চট্টোপাধ্যায় এদের হাতে বাংলা সাহিত্যের নানা গোয়েন্দা চরিএ সৃষ্টি হল।
31)হীরেন চট্টোপাধ্যায় গোয়েন্দা সাহিত্যে আনলেন দুজন গোয়েন্দাকে ।তারা হলেন সুধাময় ও ম্যাক চৌধুরী।
32)হাসির গল্পকার হিমানীশ গোস্বামী হাস্যরস সহযোগে গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন।
33)অবাঙালি লেখক গুরুনেক সিং বাংলায় গোয়েন্দা গল্প লিখেছেন।
34)হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় সৃষ্টি করলেন গোয়েন্দা পারিজাত বক্সীকে।এই পারিজাত বক্সী কল্পিত হয়েছে ব্যোমকেশ বক্সীর ভাইপো হিসাবে।
35)এছাড়া পূর্ণেন্দু পত্রী নিয়ে ছিলেন তার গল্পের গোয়েন্দা চরিএ হিসাবে ব্যোমকেশ এর পুত্র জুনিয়ার ব্যোমকেশকে।
36)বাংলা সাহিত্যের কয়েকজন মহিলাকে উজ্জ্বল হতে দেখি। যেমন -প্রদীপ্ত রায়ের গোয়েন্দা জগদ্দলের জগাপিসি,মনোজ সেনের দময়ন্তী ।
37)সুচিত্রা ভট্টাচার্যের মিতিন মাসী বাংলা সাহিত্যের নামকরা গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিল।
38)শেখর বসু অল্পবয়সী গোয়েন্দা চিন্ময়কে সৃষ্টি করলেন।
39)'কিশোর ভারতী' পত্রিয়ায় দিলীপ কুমার চট্টোপাধ্যায় সৃষ্টি করলেন 'ব্ল্যাক ডায়মন্ড' সিরিজ।
40)বিখ্যাত লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'এসো নীপবনে' উপন্যাসে এক গোয়েন্দাকে আমরা পাই।
41)কিশোরদের জন্য ডিটেকটিভ গল্পের সিরিজ এনেছেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া গোয়েন্দা গল্প সৃষ্টিকারী অন্যান্য লেখকরা হলেন –ধীরেন্দ্রলাল ধর, সুকুমার সেন, প্রতুল চন্দ্র গুপ্ত প্রমুখ।
♢♢♢বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ইতিহাস সুদীর্ঘ। সুপ্রাচীন কাল থেকে এখনত্ত পর্যন্ত এই গোয়েন্দা গল্প আমাদের সকলের কাছে পছন্দের বিষয়। এই গোয়েন্দা গল্প নিয়ে নানান ধরনের চলচ্চিত্র তৈরি করা হচ্ছে। এই গোয়েন্দা গল্প আমার খুব প্রিয়। তাই আলোচনা করলাম।


আলোচনায় - সুপর্ণা রক্ষিত।
Success বাংলা

Share this