মানবধর্মের আরেক নাম লালন


মানবধর্মের আরেক নাম লালন
---------------------------------
    লালন কে জানতে হলে আগে জানতে হবে লালন কি? একটু অদ্ভুত শোনালেও লালন কি মনে 'বস্তু বিশেষ'  বোঝায়?  না লালন একটা ধর্মের নাম? না, এর প্রথাগত প্রচলন নেই, তবে দর্শন বিজ্ঞানে আমরা সবাই এই ধর্মের অনুসারী। এবার ব্যাক্তি লালনে আসি। কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী থানার ভাঁড়ার গ্রামে ১৭৭২ খ্রি. জন্ম হয় লালনের।  সর্বসাধারণের জীবন গাথার মতো তাঁর জীবনগাঁথা একসুতোই বাঁধা ছিল না। কৌতূহলী ছোটবেলা থেকেই ছিল ভিন্নচেতা প্রজাতির। স্থানীয় সনাতন পরিবারে জন্ম হলেও তাকে তা ছাড়তে হয়। তিনি ঈশ্বরতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না।কৈশোর ও যৌবনের অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন ভবঘুরের বেশে চিন্তা মগ্ন অবস্থায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করা সম্ভব না হলেও হিন্দু ও মুসলিম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন তিনি। সিরাজ সাই ছিলেন ওই সময়ের বিখ্যাত বাউল সাধক। ভবঘুরে অবস্থার একটা পর্যায়ে লালন সিরাজ সাই এর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান ।।তখন থেকেই মারমি, বাউল সাধনের ভিত্তি খুঁজে পান তিনি। বুঝতে থাকেন দর্শন ও বাস্তবের সচিত্র। একটা সময় তিনি 'লালন সাই' নামে পরিচিত লাভ করেন।।
         'সাই' কথাটার পরিবর্তন বিভিন্ন সময়ে হয়ে এসেছে। তখনকার আধ্যাত্মিক সাধনার মূলে ছিল 'মারমি সাধনা'। যেখান থেকে সাই এবং পরবর্তীতে সাইজি পদবিটার উদ্ভব যার প্রথাগত অর্থ হলো "ঈশ্বর"। বাউল সাধক ও বাউল সংগীত রচয়িতাদের মধ্যে লালনের দর্শনে বিশেষ ভাবে ফুটে উঠে অধ্যাত্মবাদ,মরমি রসব্যঞ্জনা, দেহতত্বের জৌলুস। অসাধারণ রচনা শৈলীর মাধ্যমে তিনি স্থান পান অগণিত ভক্তহৃদয়ে। পরবর্তীতে রবিঠাকুরের দৌলতে তার পরিচয় ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র।
    সারাজীবন অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে অবশেষে তিনি পান দিব্যজ্ঞানের সন্ধান।
       দর্শন:- দর্শনের কথা বলতে গেলে তিনি ছিলেন দেহতত্ত্বের এক গবেষক। ল্যাবরেটরিতে এই গবেষণা করতে হয়নি তাকে। সচেতন ও অবচেতন ভাবে  চিন্তা ও ব্যক্ত হতো তার গবেষণার ফল। দেহাতত্বের রহস্যকে বিভিন্ন রূপকের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন তিনি।
  গানের মূল রহস্য বাহ্যিক ধারাগত শব্দের মাঝে খুঁজলে তা নিতান্তই বোকামি হবে। লালন কে জানতে হলে নিজের সত্তার কর্মের সাথে মিলিয়ে নিতে হবে। তার গানে সমাজ ও মানুষের কর্মধারা ছিল মূল উপপাদ্য বিষয়। লালন বিশ্বাস করতেন মানুষের মানুষের মনের মাঝে বাস করে একজন মনপুত মানুষ। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের জাত, ধর্ম, সমাজ, কুল, লিঙ্গ নেই। মানুষের আত্মাকে তিনি বিবেচনা করেছেন অদৃশ্য এক সত্তা রূপে যেখানে ধর্মীয় প্রভাব নেই। তিনি ছিলেন ধর্মীয় কুসংস্কার, লোভ কামনা, আত্মকেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে। কাম কে তিনি দেখেছেন শিল্প হিসেবে।‌
‌    লালনের আত্মকেন্দ্রিক নিয়ে দর্শন:-  
‌"আত্মকেন্দ্রিক যে জেনেছে দিব্যজ্ঞানী সেই হয়েছে
কি বৃক্ষে সুফল পেয়েছে আমার মনের ঘোর গেল না/,,,অকর্মের ফল পাকায় লাল দেখে শুনে তার জ্ঞান হলো না।"
লালন সংগীতের মধ্যেই লুকায়িত রহস্য আপন সত্তাতেই প্রতীয় মান হয়েছে। সময় নিয়ে লালনের উক্তি "সময় গেলে সাধন হবে না"। ঈশ্বর,সমাজ, পাপ-পুন্য, কাম, দেহ সত্তা রিপু এমন কোনো বিষয় নেই যেখানে লালনের ভাবনার  অন্ত ছিল না। সবকিছু কে তিনি দেখেছেন আধ্যাত্মিক চেতনার দ্বারা। মানুষকে বোঝাতে চেয়েছেন  শুধু চক্ষু দিয়ে দেখায় সবকিছু সত্য না। মানসিক শক্তি নামে একটা বড় শক্তি আছে যা ধ্যানের ও জ্ঞানের মধ্য দিয়ে সব কিছু দেখা সম্ভব। তিনি মানুষের মাঝেই ঈশ্বর দেখতে পেতেন।
তার কিছু গানের মধ্য দিয়ে জানা যায় তিনি ধর্ম, জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায় এগুলির প্রতি বিশেষ সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি মানুষের ভেদভেদে বিশ্বাসী ছিলেন না। তার প্রতিটি গানে নিজেকে লালন ফকির নামে ব্যক্ত করেছেন। লালন কে বাউল মত এবং গানের একজন অগ্রদূত হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তার অনুসারীরা মানবতার বাণী প্রচার করেন। তারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয় আত্মাকে। তাদের মতে আত্মাকে জানলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব জানা সম্ভব। তাদের মতবাদ কে তারা গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেন। লালনের গানে অনেক কবি, শিল্পী প্রভাবিত হয়ে এসেছেন। লালনে প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথ অগণিত গান লিখেছেন। এলেন প্রিন্সবাগ লিখেছেন, 'after lalon' নামে কবিতা। তার ধর্ম ও দর্শন তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা হয়েছে প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে। শওকত ওসমান লিখেছেন 'চলে মুসাফির', সৈয়দ ইমাম পরিচালনা করেন 'লালন ফকির' চলচ্চিত্র। নির্মিত হয় লালন কে নিয়ে তথ্য চিত্র 'দেখ কয়জনা' আর সদ্য নির্মিত সিনেমা 'মনের মানুষ'।।
      ১৯৬৩সালে কুষ্টিয়া ছেউড়াবালী তার আখড়া বাড়িতে লালন লোকসাহিত্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর১৯৭৯ সালে শিল্পকলা একাডেমীর আওতায় আনা হয় লালন একাডেমী। ২০১০ থেকে এখন নিয়মিত পালন হচ্ছে 'লালন উৎসব'। লালনের জনপ্রিয় কিছু গান--
জাত গেল জাত গেল বলে, মিলন হবে কত দিনে, খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, কানার হাট বাজার, বাড়ির কাছে আরশিনগর,লালন কি জাত সংসারে, অপার হয়ে বসে আছি ইত্যাদি।
    লালনের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার জন্য, সাম্প্রদায়িক মহলের সাথে তার বিতর্ক ও সমালোচনার অন্ত ছিল না। জীবদ্দশায় তিনি নিজের ধর্ম প্রচার করেনি তাই আজ ও তা রহস্যের বিষয়। এছাড়াও তার ধর্ম নিরপেক্ষতা, মানবতাবাদী দর্শন, ঈশ্বর ও ধর্ম বিষয়ে উত্থাপিত নানান প্রশ্নের কারণে ধর্মবাদীরা তাকে নাস্তিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। লালন ১৮৯০সালের ১৭ই আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন। তিনি বেঁচে আছেন তার গানে দর্শনে ,বাউল সাধনায়। তার অস্তিত্ব কে ধর্মের সাধনায় নিয়ে যায় তার দর্শন। খ্যাতি তাকে  এই সম্মানে সম্মানিত করেনি, করেছে তাঁর দর্শন। তিনি একজন সাধক, প্রজন্মের চোখ, যে কিনা ভাবতে শিক্ষায় ক্ষুদ্রতা আসলে কতটা বিশালতা বহন করে। ভাবতে শেখায়  মানুষ হবার আদর্শ পথটি।


আলোচনায়: শান্তনু
(বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ
সিধু কানু বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরুলিয়া)
Success  বাংলা

Share this