সাহিত্য তত্ত্ব:: উপনিবেশিকতা ও উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ





সাহিত্য তত্ত্ব::উপনিবেশিকতা ও উত্তর উপেনিবেশিকতাবাদ

       সাহিত্যতত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় উপনিবেশিকতা ও উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ। 
Post Colonialism বা উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ সাম্প্রতিক কালে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ও বিচিত্র বিষয়ে ব্যাবহৃত। এই পরিভাষাটি তাত্ত্বিক সমালোচনার ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে সাড়া জাগিয়েছে।সাহিত্যের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যে সব মানবগোষ্ঠী বা দেশ উপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়েছে সেই সব দেশের সংস্কৃতির ক্ষেত্রেই এই পরিভাষাটি ব্যবহার করা হচ্ছে।
         Post Colonialism  বা উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ কথাটি শুনলে এর বক্তব্য সম্পর্কে একটা ক্ষীন আভাস পাওয়া যায়।উত্তর উপনিবেশিকতা হলো উপনিবেশিকতা বা Colonialism কে চেনা বা উপলব্ধি করা এবং তার থেকে বেড়িয়ে আসার প্রয়াস।এপ্রসঙ্গে আমরা জেনে নিই উপনিবেশিকতা কী?
           "Colni" শব্দটি থেকে Colonialism কথাটি এসেছে।সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা মানুষের রক্তে বহমান সর্ব ক্ষেত্রে।এই সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা থেকেই Colni গড়ে উঠেছে।প্রাচীন কালে মানুষ যখন গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে জীবনযাপন করতো তখন থেকেই মানুষের মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের একটা প্রবনতা ছিল।তবে এর উদ্দেশ্য ছিল বাহুবল প্রদর্শন।কিন্তু ধনতন্ত্রের উদ্ভবের পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদের উদ্দেশ্য পাল্টে যায়।এই সময় পৃথিবীর কয়েটি তথাকথিত শক্তিশালী দেশ অন্যান্য ভূখণ্ড গুলো অধিকার করে শাসন ও শোষণ চালাতে থাকে।মূলত বানিজ্যের জন্য যে বাজার  প্রয়োজন তার থেকেই গড়ে উঠেছিল এই Colni গুলো।প্রায় সমগ্র পৃথিবীতে একসময় ইংল্যান্ড এর উপনিবেশ ছিল।
         ইংল্যান্ডের উপনিবেশ গুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল ভারতবর্ষ।প্রথম দিকে বানিজ্যের উদ্দেশ্যে বাজার দখল করার জন্য Colni গড়ে তোলে,এর পর ক্রমে ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার তাঁদের মূল লক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।মূল উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক শোষণ।যা তাঁরা ভারতের মতো সারা পৃথিবীতেই করেছে। এর পর থেকেই উপনিবেশিকতা শাখা প্রশাখা বিস্তার করতে থাকে।অর্থনৈতিক শোষণের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব কে প্রচার করতে থাকে।ভারতের স্বল্প শিক্ষিত মানুষের কাছে তাঁরা প্রচার করতে থাকে যে ভারতবাসীর পক্ষে নিজেদের শাসন করা সম্ভব নয়।তাই তাঁরা তাঁদের শাসন করতে এসেছে। এরপর তাঁরা  তাঁদের জাতির সাথে ধর্ম কেও শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করতে লাগলো বিভিন্ন গ্রন্থ  রচনা ও অনুবাদের মধ্যে দিয়ে।এরপর একে একে তাঁদের ভাষা ও সংস্কৃতি কে ভারতবাসীর কাছে উন্নত বলে তুলে ধরলো।আমরাও সেদিন তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব দ্রুত মেনে নিয়েছিলাম।যাঁর দৃষ্টান্ত ইংরেজি শিক্ষা ও তাঁদের রীতিনীতি চালচলনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া এবং তার অনুকরণ।যা আজও বর্তমান।এভাবে দীর্ঘদিন প্রচারের ফলে এদেশের মানুষের মনে ইংরেজদের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত হয়।এই বিষয়টিকে বলে মানসিক আগ্রাসন।তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব কে আমাদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া কে বলে উপনিবেশিকতা। 
        ইংরেজদের এই উপনিবেশিকতার প্রভাব আমরা স্বাধীনতার এতবছর পরেও কাটিয়ে উঠতে পারিনি।এখন প্রশ্ন হলো এই শ্রেষ্ঠত্ব কে আমরা কেন মেনে নিচ্ছি।এর কারণ হিসেবে বলা যায় এটা একটা কমন সাইকোলজি।এটা আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে আছে যে তাঁরা সববিষয়ে আমাদের থেকে এগিয়ে।তাঁরা সমাজের উপর তলার মানুষ।সবথেকে বড়ো কথা অর্থনৈতিক আধিপত্য।এই কমন সাইকোলজির বশবর্তী হয়ে ইংরেজ চলে যাওয়ার এতবছর পরেও তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব কে মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না।
     Post Colonialism হলো এই বিষয়গুলো জেনে এর থেকে বেড়িয়ে আসা।উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ এ বিশ্ববাসী ইংরেজ জাতির এই আগ্রাসন নীতির বিরোধী। স্পষ্ট করে বলতে গেলে সমাজ , সাহিত্য, সংস্কৃতির উপর উপনিবেশিক প্রভাবকে অনেকেই মেনে নেননি।তাঁরা এই প্রভাব থেকে মুক্তির পথ অন্বষণে প্রয়াসী।মানুষের উপনিবেশিক মনস্কতার দর্শন ও মনস্তত্বকে চিনিয়ে দেওয়া এবং তার থেকে টেনে বের করা Post Colonialism বাদীদের লক্ষ।
       সমাজ সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের সাহিত্যের ক্ষেত্রেও উপনিবেশিকতার প্রভাব লক্ষ করা যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য জোতিরিন্দ্র নন্দীর "চোর" গল্পে আমরা দেখি বড়োলোক বাড়ির কাজের লোক মদন সেই বাড়ির ঐশ্বর্যের মোহে বাধা পড়ে থাকে।তা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে না।এখানেই উপনিবেশিকতা কাজ করেছে। কিন্তু মিন্টু প্রথম দিকে সেই মোহে বাধা পড়লেও শেষ পর্যন্ত বেড়িয়ে আসতে পেরেছে সেই মানসিক আগ্রাসন থেকে;যা Post Colonialism এর দৃষ্টান্ত।
   পরিশেষে তাই বলা যায় উপনিবেশিকতা একটি জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়।সমাজ ,সংস্কৃতি, শিল্প,সাহিত্য চেতনার যে স্বাভাবিক গতি তা ধীরে ধীরে কৃত্রিমতা দিয়ে ঢেকে দেয়।উনিশ শতকে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ এরকম ভাবে বাঙালির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেবার চেষ্টা করেছিল ।সে সময় অগ্রসর বাঙালি বুদ্ধিজীবীগন উপনিবেশিকতার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি।এর থেকে বেড়িয়ে এসে নতুন ধারা প্রবর্তনের চেষ্টা করেছে।যা উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ নামে পরিচিত। কিন্তু উত্তর উপনিবেশিকতাবাদ বাংলা সাহিত্যের বাইরের আবরণেই সীমাবদ্ধ থেকেছে অনেক ক্ষেত্রে।ভেতরে ভেতরে কাজ করে চলেছে উপনিবেশিকতা।আজকের বাংলা সাহিত্য এর থেকে মুক্ত হয়নি।

  ধন্যবাদ
Success বাংলা
সুশান্ত সরকার।

Share this