উৎপল দত্ত

                         ¤ উৎপল দত্ত ¤
         _______________________________

" আমি শিল্পী নই । নাট্যকার বা অন্য যে কোন আখ্যাও লোকে আমাকে দিতে পারে । তবে আমি মনে করি , আমি ' প্রোপ্যাগনিস্ট'।- এটাই আমার মূল পরিচয়।" - এমন স্পষ্ট কথাতে যিনি আজীবন অবিচল থেকেছিলেন তিনি উৎপল দত্ত । ব্রেখটীয় রীতিকে সাদরে গ্রহণ করে তিনি মার্কসবাদী দর্শনের প্রতি শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠা প্রকাশ করেন থিয়েটারে । জনগণের থিয়েটার গঠন ছিল তাঁর আজীবন সাধনা । তার সেই সাধনার পথেই মিলেছে গগনচুম্বী খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা।
১৯২৯ , ২৯ মার্চ অধুনা বাংলাদেশের বরিশালে উৎপল দত্ত জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু আভিজাত্যবোধের তাড়নাতে শৈশবের শিলং শহরকেই জন্মস্থান বলে নির্দেশ করতেন। আদিনিবাস কুমিল্লা। পিতা গিরিজারঞ্জন দত্ত, মাতা শৈলবালা দত্ত । পিতা গিরিজারঞ্জন দত্ত প্রথম জীবনে বঙ্গবাসী কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক , পরে ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদস্থ চাকরী গ্রহন করেন , যা ছিল বদলির । উৎপলরা পাঁচ ভাই , তিন বোন ; তিনি ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান । ডাকনাম শঙ্কর,  পিতা প্রদত্ত নাম ছিল উৎপলরঞ্জন দত্ত, তবে তিনি তা পরিবর্তন করে উৎপল নামটি গ্রহণ করেন ।
১৯৩৫ এ বালক উৎপলের বিদ্যালয় জীবনের সূচনা সেন্ট এডমন্ড স্কুলে  ( শিলং) ।
১৯৩৯ - ৪২এ দশ বছর বয়সে তিনি কলকাতার সেন্ট লরেন্স স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন ।
১৯৪৩ এ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে । এই স্কুলের উদ্যোগে সাঁ সুঁসি প্লেয়ার্স প্রযোজিত নাটক " হ্যামলেট "  এডিট দ্বিতীয় কবর খনকের ভূমিকায় অভিনয় করেন ।
১৯৪৪ এ ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেন ।
১৯৪৫ - ৪৬  এ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পঠন রত অবস্থাতে ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের প্রথম বর্ষে কলেজের পত্রিকাতে নিবন্ধ লেখেন - " A Glance at Modern Russian Literature" ও " বাস্তবতা ও বাংলা সাহিত্য"।
১৯৪৭ এ কলেজ ম্যাগাজিনে "Three Bengali Novelist "  এবং "Symphony"  লেখেন । প্রতাপ রায় ও সতীর্থ ইহুদী বন্ধু নিয়ে গড়ে তোলেন " দ্য অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস্ " প্রথম নাটক " রিচার্ড দ্য থার্ড "। প্রথম অভিনয় ১৫ আগস্ট । পরিচালক হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি লাভ করেন । এই অভিনয় দেখে ভারত ভ্রমণে আগত দ্য শেক্সপিয়ারানা ইন্টারন্যাশানাল কোম্পানি জেফ্রি কেন্ডাল আমন্ত্রণ জানান তাঁর পেশাদার টিমে অভিনেতা রূপে যোগ দেন । এ বছরেই " মার্চেন্ট অব ভেনিস " এ অ্যান্টেনিও চরিত্রে অভিনয় করে পেশাদার অভিনয় জীবন শুরু ।
১৯৪৮  তে পেশাদার অভিনয়ে কেন্ডাল সাহেবকে গুরু হিসেবে বরণ করেন, এই পর্বে অভিনয় -
জুলিয়াস সিজার - ডিসিয়াস চরিত্র
মার্চেন্ট অব ভেনিস - অ্যান্টোনিও
সি স্টুপস টু কঙ্কার - স্যার চার্লস
ওথেলো - রডেরিগো
গ্যাসলাইট - কনস্টেবল
এছাড়াও বহু নাটক ।
এই বছরে জুন মাসে দ্য অ্যামেচার শেক্সপিয়ারিয়ানস্ এর রোমিও জুলিয়েট প্রযোজনার স্মারক গ্রন্থে  রাজনৈতিক সংস্কৃতির গুরুত্ব বিষয়ে প্রোডাকশন ম্যানিফেস্টো প্রবন্ধ প্রকাশ করে দলের মধ্যে বিতর্ক হলঃ দলের নাম পরিবর্তন করে লিটল থিয়েটার গ্রুপ রাখা হয়। সম্পাদক এলান ডেভিড । এই ইংরেজি পর্বের অভিনীত তাঁর চরিত্র হল -
ওথেলো - নামভূমিকা
মিড সামার নাইটস ড্রিম - বটম
রোমিও জুলিয়েট - মারকুশিও ইত্যাদি ।
১৯৪৯ এ কলেজ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল প্রথম একাঙ্ক নাটক বেটি বেলসাজার । এই বছরেই স্নাতক হন তিনি । সাংবাদিক বৃত্তিগ্রহন " দ্য স্টেটসম্যান" পত্রিকাতে কোর্ট রিপোর্টার রূপে , কিছুকাল পর তা ত্যাগ করে চিত্র পরিচালক মধু বসুর আহ্বানে যান । পাশাপাশি তিনি এন্ড্রোক্লিস এন্ড লায়ন , ডিস্টিংসগুইশড গ্যাদারিং ,  ম্যাকবেথ অভিনয়ের সাথে বৈপ্লবিক পথে এগিয়ে যান।
১৯৫০ এ  কলেজের মঞ্চে জুলিয়াস সিজার এর আধুনিকিকরণে উচ্ছ্বসিত প্রশংসায়  স্টেটসম্যান লিন্ডসে এমার্সন তাঁর পক্ষপাতের পালাবদল ঘটান দ্য ক্যালকাটা ড্রামাটিক ক্লাবের পাল্লা থেকে এল টি জি র দিকে ; শিউলি মজুমদারের অনুবাদে ইবসেনের গোস্টস  প্রথম অভিনীত হল ।

১৯৫২ তে মাত্র দশমাস গণনাট্য সংঘে থাকার পর থাকার পর উপলব্ধি ' গণনাট্যে আর থাকতে পারলাম না ' । এল টি জি - এ তখন তিনি মঞ্চাধ্যক্ষ হিসাবে যোগদান করেন । এছাড়াও যোগ দেন তরুণ রবি ঘোষ ও সত্য বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি বলেন " গণনাট্য সংঘ যে আদর্শ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছিল সে আদর্শকে আঁকড়ে ধরার বাসনা আমাদের প্রায় সবাইকে পেয়ে বসেছিল । মিটিং করে স্থির করা হলো লিটল থিয়েটার গ্রুপ সম্পূর্ণত বাংলা নাটকে মনোনিবেশ করবে ।"
১৯৬১ এ ২৯ শে মার্চ শোভা সেনের সঙ্গে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন ।
কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬২ খ্রী ।

☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆☆
এল টি জি সংঘের প্রযোজন, উৎপল দত্ত অভিনীত ও নির্দেশিত নাটক --

অভিনীত নাটক , সময়কাল এবং চরিত্র
ম্যাকবেথ           ১৯৫৪         ম্যাকবেথ ▪
নীচের মহল        ১৯৫৭         গগন▪
ছায়ানট             ১৯৫৮         বিনয়েন্দ্র▪
ওথেলো            ১৯৫৯           ওথেলো▪
বুড়ো সালিকের  ১৯৫৯         ভক্তপ্রসাদ▪
ঘাড়ে রোঁ
অঙ্গার               ১৯৫৯            গফুর▪
ফেরারি ফৌজ    ১৯৬১           নীলমণি ▪
ভি আই পি         ১৯৬২             পথচারী ▪
তিতাস একটি নদীর
নাম                     ১৯৬৩            কালোবরণ▪
রোমিও জুলিয়েট ১৯৬৪            মারকুশিও ▪
মিড সামার নাইটস ১৯৬৪            বটম▪
ড্রিম
ওথেলো                    ১৯৬৪         ওথেলো ▪
জুলিয়াস                ১৯৬৪           ব্রুটাস  ▪
সিজার
কল্লোল                 ১৯৬৫             র্র্যাটট্রে▪
প্রফেসর ম্যামলক ১৯৬৫             ম্যামলক▪
অজেয় ভিয়েতনাম ১৯৬৬               ফিৎস▪
তীর                         ১৯৬৭              ভীরসা▪
মানুষের অধিকার     ১৯৬৮        লিবফিৎস▪
যুদ্ধং দেহি                  ১৯৬৮           যোদ্ধা ▪
লেনিনের ডাক           ১৯৬৯     আফানসি▪
▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪▪
পি এল টি প্রযোজনা উৎপল দত্তের অভিনীত ও নির্দেশিত নাটক -

রাইফেল                  ১৯৬৯        সৈনিক ▪
শোন রে মালিক      ১৯৬৯          মজুতদার▪
ঠিকানা                   ১৯৭১          
টিনের তলোয়ার     ১৯৭১           বেনীমাধব▪
সূর্যশিকার              ১৯৭১         সমুদ্র গুপ্ত ▪
ব্যারিকেড               ১৯৭২            ব্রুনো▪
টোটা                       ১৯৭৩         শাহজাফর▪
বুড়ো সালিকের
ঘাড়ে রোঁ                    ১৯৭৩    ভক্তপ্রসাদ ▪
দুঃস্বপ্নের নগরী          ১৯৭৪          লক্ষণ▪
লেনিন কোথায়          ১৯৭৬          স্ট্যালিন▪
এবার রাজার পালা      ১৯৭৭    মাড়োয়ারি▪
তিতুমীর                      ১৯৭৮      পাইরন▪
স্ট্যালিন '৩৪              ১৯৭৯         স্ট্যালিন▪
দাঁড়াও পথিক বর       ১৯৮০         মধুসূদন ▪
পান্ডবের অজ্ঞাতবাস  ১৯৮২       কীচক▪
মালোপাড়ার মা           ১৯৮৩     মহাজন▪
শৃঙ্খল ছাড়া                ১৯৮৩        শ্রমিক▪
আজকের শাজাহান     ১৯৮৪  কুঞ্জবিহারী▪
কল্লোল                      ১৯৮৬     ▪▪▪
অগ্নিশয্যা                    ১৯৮৮     বেন্টিঙ্ক▪
নীচে মহল                    ১৯৮৮     গগন▪
দৈনিক বাজার পত্রিকা  ১৯৮৮  গোপীবল্লভ▪
নীল সাদা লাল            ১৯৮৯         দাঁতো▪
একলা চলো রে           ১৯৮৯         অনাথ
 এছাড়া আরও বহু পথ নাটক , পোস্টার নাটক তিনি রচনা করেন -
পার্শপোট                           ১৯৫৯
স্পেশাল ট্রেন                    ১৯৬১
সমাজতান্ত্রিক চাল             ১৯৬৫
জনতার কল্লোল              ১৯৬৫
মৃত্যুর অতীত                   ১৯৬৬
দিনবদলে পালা              ১৯৬৭
ময়না তদন্ত                     ১৯৬৮
▪▪▪☆▪▪▪▪☆▪▪▪▪☆▪▪▪▪☆▪▪▪▪
বর্গী এল দেশে                   ১৯৭০
দিন বদলের পালা              ১৯৭৭
কালো হাত                        ১৯৭৯
পেট্রোল বোম                 ১৯৮২
কাঁচের ঘর                       ১৯৮৫
 মুমূর্ষু নগরী                      ১৯৮৭
হামে দেখনা হ্যায়               ১৯৮৯

তিনি কেবল অভিনেতা রা পরিচালক, নির্দেশনা করেন নি । সমাজ সংস্কৃতির তথ্যবহুল কিছু গ্রন্থ তিনি রচনা করেন যা নাট্য পিপাসু  গবেষকের কাছে অমূল্য সম্পদ । তা হল -  শেক্সপিয়রের সমাজচেতনা [ ১৯৭৩] ,  স্তানিস্লাভস্কি র পথ ( ১৯৭৫) , চায়ের ধোঁয়া  ( ১৯৭৯) , গিরিশ মানস [১৯৮৩]  ইত্যাদি ।

ছদ্মনাম - ভাস্কর গুপ্ত, মনোরঞ্জন মাইতি, রফিকুল ইসলাম, অর্জুন গুপ্ত ।

যে সূর্য পুব আকাশে ওঠে তা যেমন মাঝে আকাশের রোদের কারণ ঠিক তেমনই আবার অস্ত চলে যায় নদীর বহমান স্রোতের মতো । ঠিক তেমনই ১৯৯০ এ তিনি গভীর ভাবে অসুস্থ হন । দীর্ঘ রোগ ভোগের পর অবশেষে "উৎপলও যায় ঝরে দিনের শেষে জলের সাথে মিশে"  ১৯৯৩ তে ১৮  আগস্ট ৩-৩০মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন । বাংলা থিয়েটারে এই সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব নিজস্ব প্রতিভা , দক্ষতা, পাণ্ডিত্যের জোরে আজ ও কেবল বাংলা বা ভারতীয় সাহিত্যে আলোচিত হন তা সতসত্য শ্লাঘার বিষয়।।

★বিশেষ ধন্যবাদ - M.R.Sir★

♦ অালোচক-- পায়েল ব্যানার্জী ♦
  (ছাত্রী-- বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়)
♦অ্যাডমিন -- সাকসেস বাংলা গ্রুপ♦

Share this