বাংলা মঙ্গলকাব্যের ধারায়- মনসামঙ্গল


@@ মনসামঙ্গল কাব্য @@

মঙ্গলকাব্যের ধারায় সবচেয়ে প্রাচীন এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য হলো মনসামঙ্গল কাব্য। কাহিনির সরলতা,এর মানবীয় আবেদন সহ বেশ কিছু কারন মনসামঙ্গল 'কে পাঠক-শ্রোতার মনোন্তঃপুরে স্থান পেতে সাহায্য করেছে। মনসামঙ্গল - এর  'মনসা' শব্দের উৎপত্তি নিয়ে সংশয় আছে। 'মঞ্চ' থেকে 'মনসা' নামের উৎপত্তি বলে অনুমিত। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে, ছোটনাগপুরের সিংভূম, মানভূম, বীরভূম ইত্যাদি জেলা থেকে 'মনসা' বাংলায় সম্প্রসারিত হয়েছিল। শব্দটির মৌলিক অর্থ মনের তীব্র বাসনা, কাম। মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা। তিনি মূলত অনার্য দেবী। মূলত এই সর্পদেবী মনসার মাহাত্ম্য নিয়ে মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের ধারায় যে সমস্ত কাব্য রচিত হয়েছিল তাই মনসামঙ্গল কাব্য নামে পরিচিত। মনসামঙ্গল কাব্য রায়ানী নামেও পরিচিত ।রায়ানী শব্দটি রজনী থেকে জাত। সুকুমার সেনের মতে রাত জেগে মনসামঙ্গল কাব্য গাওয়া হতো, তাই এর আর এক নাম রায়ানী।

@@@অঞ্চলভেদে মনসামঙ্গল কাব্যের বিভিন্ন নাম :
1)ভাসান =দক্ষিণবঙ্গে ।
2)ঝাপান =রাঢ়বঙ্গে ।
3)সাইটোল বিষহরির গান /ডগজিয়ানী বা মড়াজিয়ানী পালা =উত্তরবঙ্গে।
4)রায়ানী =পূর্ববঙ্গে।
5)মঞ্চাম্মা= দক্ষিণ ভারতে।

@@একনজরে সময়কাল অনুযায়ী মনসামঙ্গলের কয়েকজন বিশিষ্ট কবি :
           || চতুর্দশ শতক মতান্তরে পঞ্চদশ শতক ||
             কানাহরি দত্ত ।

            ||পঞ্চদশ শতক ||
বিজয় গুপ্ত, বিপ্রদাস পিপলাই, নারায়ণ দেব ।

             ||সপ্তদশ শতক ||
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, তন্ত্রবিভূতি জগজ্জীবন ঘোষাল ।

              ||অষ্টাদশ শতক ||
বিষ্ণু পাল, জীবন মৈত্র, ষষ্ঠীবর দত্ত ।

              ||উনিশ শতক ||
জগমোহন মিত্র, রাধানাথ।

@মনসামঙ্গল কাব্যের কিছু চরিত্র ও তাঁদের পরিচয় :

ক) চাঁদ সদাগর - কেন্দ্রীয় চরিত্র, চম্পকনগরের বণিক।
খ) সনকা-চাঁদ সদাগরের পত্নী ।
গ) লখিন্দর (অনিরুদ্ধ) - চাঁদ সদাগরের পুত্র।
ঘ) বেহুলা (ঊষা) - লখিন্দরের পত্নী।
ঙ)বিজয় সাধু - চাঁদ সদাগরের পিতা।
চ) সায় বেনে - বেহুলার পিতা।
ছ) অমলা - বেহুলার মাতা।
               এবং
             মনসা।

## মনসামঙ্গল থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :

1) সর্পমাতা হলেন কৃশ্যপের পত্নী কদ্রু।
2)বৌদ্ধ সাধনমালা গ্রন্থে মনসাকে বলা হয় জাঙ্গুলীতারা।
3)প্রাচীনকালে সাপের ওঝাকে জাঙ্গুলিক বলা হতো।
4)দুটি বৌদ্ধ গ্রন্থ যেখানে সর্পদেবীর কথা আছে - বিনয়বস্তু, সাধনমালা ।
5)জৈনদের সর্পদেবীর নাম হলো - পদ্মাবতী।
6)হিন্দুদের স্নানের তর্পণ মন্ত্রে নাগ ও সর্পকে আলাদা করে দেখানো হয়েছে।
7)মনসামঙ্গলের কাহিনিকে কেন্দ্র করে একটি নাটক হলো - শম্ভু মিত্র রচিত "চাঁদ বণিকের পালা"।
8) 1954 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আশুতোষ ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় বাইশ জন কবির মনসামঙ্গলের যে সংকলন গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাকে বাইশা বলা হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকেও 1301 বঙ্গাব্দে একটি বাইশা প্রকাশিত হয়।
একইভাবে মনসামঙ্গল কাব্যের ছয় কবির কাব্য সংকলন ষট্ কবি নামে পরিচিত।
9)লখিন্দরের জন্ম হয় চম্পকনগরের এবং বেহুলার জন্ম হয় নিছনিনগরে।
10)একমাত্র মনসামঙ্গল কাব্যে যুদ্ধের উল্লেখ নেই।
11) সর্পপূজা প্রথমে ভারতের বাইরে তুরানীয়  জাতির মধ্যে দেখা যায় - এমন মন্তব্য করেন ফার্গুসন।
12)"দক্ষিণ ভারতের 'পঞ্চামা' বাংলায় মনসা রূপে পরিচিত"-ক্ষিতিমোহন সেন ।
13)মনসার অপর নাম পদ্মা পিছনে পদ্মানদীর প্রভাব জড়িত রয়েছে বলে মনে করেন মুহম্মদ শহীদুল্লাহ।
14)নলিনীকান্ত ভট্টশালী মনসার সঙ্গে সরস্বতীর সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন।
15)মনসামঙ্গলের তিনটি ধারা - ক) রাঢ়ের ধারা(বিপ্রদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ, সীতারামদাস, রসিক মিশ্র প্রমুখ) খ) পূর্ববঙ্গের ধারা(নারায়ণ দেব, বিজয় গুপ্ত প্রমুখ) গ) উঃবঙ্গ ও কামরূপের ধারা(তন্ত্রবিভূতি, জগজ্জীবন ঘোষাল প্রমুখ) ।
16)মঙ্গলকাব্যের সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র হলো সনকা।
17)চাঁদ সদাগরের একজন একজন তান্ত্রিক বন্ধুর নাম - ধন্বন্তরি ওঝা।
18) মঙ্গলকাব্যের গবেষক নামে পরিচিত আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয়।
19)সীতারাম দাস, মানিক দত্তের কাব্যে ধর্মমঙ্গলের প্রভাব আছে।
20)রসিক মিশ্রের কাব্যের নাম - 'জগতীমঙ্গল '।
21)স্বর্গের নর্তকী ঊষা এবং তার স্বামী অনিরুদ্ধ শাপগ্রস্থ হয়ে যথাক্রমে বেহুলা এবং লখিন্দর রূপে মর্ত্যে জন্মগ্রহণ করেন।
22)মধ‍্যযুগের এক ব্যতিক্রমী চরিত্র চাঁদ সদাগর, যে প্রথম দেবতার বিরুদ্ধে তাঁর সর্বস্ব দিয়ে প্রতিবাদ করেছিল।

           

## মনসামঙ্গল কাব্যের বিশিষ্ট কবিদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা ##

                  ||কানা হরিদত্ত ||

মনসামঙ্গলের আদি কবি হলেন কানা হরিদত্ত। বিজয়গুপ্ত এবং কবি পুরুষোত্তম তাঁদের কাব্যে কানা হরিদত্তের উল্লেখ করেছেন। যদিও বিজয়গুপ্ত আদি কবি সম্পর্কে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করেন নি। তিনি তাঁর "পদ্মাপুরাণ" - এ কানা হরিদত্ত সম্পর্কে বলেছেন, "মুর্খে রচিলা গীত না জানে মাহাত্ম্য"।কানা হরিদত্তের কাব্যের প্রকৃত নাম কী ছিল তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেন "পদ্মার সর্পসজ্জা" শীর্ষক কয়েকটি ছত্রকে কানা হরিদত্তের রচনা বলে গ্রহণ করেছেন। যদিও সমালোচকদের মতে এর ভাষা আদৌও পুরাতন নয়। কানা হরিদত্ত নামে অপেক্ষাকৃত কোনো নবীন কবির রচনা এটি।

                    || বিজয়গুপ্ত ||

পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বর্তমান বাংলাদেশের গৈলা গ্রামে (পূর্বে ফুল্লশ্রী) মনসামঙ্গলের সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি বিজয়গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সনাতন, মাতা রুক্মিনী দেবী। তিনি হোসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন।

                   তাঁর কাব্যের নাম "পদ্মাপুরাণ" ।কাব্যটি প্যারিমোহন দাশগুপ্তের সম্পাদনায় এবং অক্ষয়কুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রকাশনায় 1303 বঙ্গাব্দে বরিশাল থেকে সর্বপ্রথম প্রকাশিত হয়(অ. কু.ব.)। সুকুমার সেনের মতে ,"মনসামঙ্গল বা 'পদ্মাপুরাণ'(বিজয়গুপ্ত) সংগ্রহ করিয়াছিলেন প্যারিমোহন দাশগুপ্ত, প্রকাশ করিয়াছিলেন রামচরন শিরোরত্ন, ছাপা হইয়াছিল (1306)বরিশাল আদর্শ যন্ত্রে নন্দকুমার দাস কর্তৃক। রামচরন শিরোরত্ন গ্রন্থটির ভূমিকা লেখেন।" কাব্যটির রচনাকালজ্ঞাপক যে শ্লোকগুলি পাওয়া যায় সেগুলো হলো -
1)ঋতু শূন্য বেদ শশী পরিমিত শক ।
  সুলতান হুসেন শাহ নৃপতি তিলক ।।অর্থাৎ 1484 খ্রিস্টাব্দ।
2)ছায়াশূন্য বেদ শশী পরিমিত শক ।
  সনাতন হুসেন শাহ নৃপতি তিলক ।।
অর্থাৎ 1478 খ্রিস্টাব্দ।
3)ঋতু শশী বেদ শশী শক পরিমিত ।
অর্থাৎ 1494 খ্রিস্টাব্দ।
সুলতান হুসেন শাহ 1493 খ্রিস্টাব্দে বাংলার সিংহাসন অধিকার করেন। তাই এই যুক্তিতে আনুমানিক ভাবে 1494 খ্রিস্টাব্দ কাব্যটির রচনাকাল বলা যায়।
         অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে বিজয়গুপ্ত জনপ্রিয় কবি হলেও তাঁর কাব্যে সেভাবে কাব্যগুন ফুটে ওঠেনি। তিনি তাঁর কাব্যটিতে করুন রসের প্রাধান্য দিয়েছে। কিন্তু আশুতোষ ভট্টাচার্য তাঁর রচনার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে বলেছেন, "বিজয়গুপ্ত দেবতার মাহাত্ম্য রচনা করেন নাই, মানবেরই মঙ্গল গান গাহিয়াছেন।"

                    ||বিপ্রদাস পিপলাই||

বিজয়গুপ্তের সমসাময়িক কালে 24 পরগনা জেলার বাদুড়িয়া বা নাদুড়্যা বটগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন কবি (মনসামঙ্গল কাব্যের) বিপ্রদাস পিপলাই জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুকুন্দ পন্ডিত। সুকুমার সেন তাঁকে মনসামঙ্গল কাব্যের সবচেয়ে পুরানো কবি বলেছেন এবং মনসার সম্পূর্ণ কাহিনি একমাত্র তাঁর কাব্যেই পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন। বিপ্রদাসের কাব্যটি 'মনসাবিজয়', 'মনসামঙ্গল' এবং 'মনসাচরিত ' এই তিন নামেই পরিচিত। পদ্মার আদেশে কবি এই কাব্য লিখেছেন বলে জানিয়েছেন। সুকুমার সেনের মতে কাব্যটি 13 টি পালায় বিভক্ত। কাব্যটির সময়কাল সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
"সিন্ধু ইন্দু বেদ মহী শক পরিমাণ।
নৃপতি হুসেন শাহ গৌড়ের প্রধান।।"
অর্থাৎ আ1417+78=1495 খ্রিস্টাব্দে তিনি কাব্যটি রচনা করেন।কাব্যটিতে কলকাতাসহ বিভিন্ন বিভিন্ন স্থানের পথ-ঘাটের বর্ণনা করেছেন।
সুকুমার সেন কাব্যটির যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন।কাব্যটির সম্পাদনাও করেছেন তিনি। যদিও অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্যটিকে মন্দ না বলেও জানিয়েছেন  "কবিকে অতিপ্রশংসার বিল্বদলে পূজা করবারও প্রয়োজন দেখি না"।

                        ||নারায়ণদেব||

মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম প্রতিনিধিস্থানীয় এক কবি হলেন নারায়ণদেব। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জের অন্তর্ভুক্ত বোরগ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। যদিও কবির পূর্বপুরুষের আদিনিবাস ছিল রাঢ়বঙ্গ। কবির পিতার নাম নরসিংহ, মাতা রুক্মিনী দেবী। তাঁর কোনো পুঁথিতে কালনির্ণয় সংক্রান্ত কোনো শ্লোকের ইঙ্গিত মেলে না । মোটামুটিভাবে অনুমান করা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিনি বর্তমান ছিলেন। তাঁর কাব্যের নাম 'পদ্মাপুরাণ' ।ভৈরবচন্দ্র শর্মার সম্পাদনায় কাব্যটি প্রকাশিত হয়।আলোচ্য গ্রন্থটি আসামে 'সুকন্নানি' নামে পরিচিত।এটা আসলে সুকবি নারায়ণী'র বিকৃত রূপ। তাঁর কাব্যটি তিনটি খন্ডে বিভক্ত, যথা :1)কবির আত্মপরিচয় ও দেববন্দনা, 2)পৌরাণিক আখ্যান, 3)চাঁদ সদাগরের কাহিনি। নারায়ণদেব তাঁর কাব্যের ভূমিকায় নিজের সম্পর্কে "সুকবিবল্লভ" কথাটি ব্যবহার করেছেন। ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর 'বাংলা সাহিত্য পরিচয়' গ্রন্থে বলেছেন, "নারায়ণদেব মনসামঙ্গল কাব্যের 'কবি সার্বভৌম' রূপে স্বীকৃত।"
         বিভিন্ন দিক থেকে নারায়ণদেবের 'পদ্মাপুরাণ' বিশেষ গুরুত্বের দাবী রাখে। তাঁর কাব্যেই দেখতে পাই চাঁদ সদাগর বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত বাম হাতে মুখ না ফিরিয়ে একটি ফুল দিয়ে পূজা করেছে মনসার। দেবী চন্ডীর সঙ্গে মনসার বিবাদ এবং কুশ দিয়ে দেবী চন্ডী কর্তৃক মনসার একচোখ কানা করে দেওয়ার কথা তাঁর কাব্যেই প্রথম উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়া শিবের দুর্দশার চিত্র তাঁর কাব্যেই সবচেয়ে বেশি করে ফুটে উঠেছে। সচেতন কবির এই কাব্যটিতে মহাভারত, কুমারসম্ভব, শিবপুরাণের প্রভাব রয়েছে।সমগ্র কাব্যটি পৌরাণিক কাহিনির সমাবেশে, বাস্তবধর্মী চরিত্রচিত্রনে, বিশেষ করে চাঁদ চরিত্রের মহনীয়তার রূপায়নে, বেহুলার বীরাঙ্গনার স্বরূপ উদঘাটনে মনসামঙ্গলের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি হলেন নারায়ণদেব ।ভূদেব চৌধুরী নারায়ণদেবকে আদিম মানবতার কবি বলেছেন।

              ||কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ ||

সপ্তদশ শতকের মনসামঙ্গল কাব্যের ধারায় এক অনবদ্য সংযোজন কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যটি ।চৈতন্য পরবর্তী যুগের পশ্চিমবঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যধারার একজন শ্রেষ্ঠ কবি ক্ষেমানন্দ বর্ধমান জেলার অন্তর্গত কাঁদড়া গ্রামে এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শঙ্কর মন্ডল। তাঁর নাম এবং পদবী নিয়ে মতভেদ রয়েছে।সুকুমার সেন বলেছেন - কেতকাদাস নাম, ক্ষেমানন্দ ভনিতা ।আবার ক্ষেমানন্দ 'কেই আসল নাম বলেছেন দ্বিজ কবিচন্দ্র। রামগতি ন্যায়রত্ন আবার এই দুই মতের থেকে সরে এসে বলেছেন কেতকাদাস ও ক্ষেমানন্দ দুজন স্বতন্ত্র মানুষ। আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন, "ক্ষেমানন্দ নিজেকে কেতকাদাস অর্থাৎ মনসার দাস বলিয়া পরিচয় দিয়াছেন। তাঁহার কাব্যের কোনও কোনও স্থলে কেবল কেতকাদাস ভনিতা দেখিয়া তাহাকে স্বতন্ত্র লোক বলিয়া ভ্রম করিবার কোনো কারণ নেই।" নাম নিয়ে এহেন সমস্যা থাকলেও কাব্য নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তাঁর কাব্যের নাম 'ক্ষেমানন্দী' ।মুচিনীর ছদ্মবেশে মনসা কবিকে দেখা দিয়ে কাব্যরচনার নির্দেশ দেন বলে কবি জানিয়েছেন। কাব্যটিতে 14 টি পালা আছে। শ্রীরামপুর মিশনারীদের সহযোগিতায় 1844 খ্রিস্টাব্দে কেতকাদাসের মনসামঙ্গল সর্বপ্রথম মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করে। এদেশে মনসামঙ্গল কাব্যের মধ্যে তাঁর কাব্যই প্রথম মুদ্রিত হয়।পরবর্তী কালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্যের সম্পাদনায় ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল প্রকাশিত হয় ।কাব্যটিতে কাব্যরচনার সময়কালজ্ঞাপক শ্লোক, "শূন্য রস বান শশী শিয়রে মনসা আসি /আদেশিলা রচিতে মঙ্গল" - থেকে কাব্যটির রচনাকাল 1560 শকাব্দ বা 1638 খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি বলা যায়।
             ক্ষেমানন্দের কাব্যের মূল রস শান্ত হলেও, হাস্য রসেরও পরিচয় মেলে। কাহিনিবয়ন ও চরিত্রচিত্রনে কবির দক্ষতা প্রশংসনীয়। আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে- চরিত্রচিত্রনে বিশেষ করে চাঁদ চরিত্রের রূপায়ণে কবি দ্বিজ বংশীদাসের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন কেতকাদাস। এছাড়া আত্মপরিচয় অংশে কবিকঙ্কনের প্রভাব পড়েছে।কাব্যটির বহু জায়গায় শ্রীচৈতন্যদেবের নামের উল্লেখ আছে। ক্ষেমানন্দ তাঁর কাব্যে চন্ডীর বন্দনা করেন নি। মনসার কেয়াপাতায় জন্ম, বেহুলার মায়ের নাম চুহিলা এমনতর বেশ কিছু নতুন তথ্য তাঁর কাব্যটিতে পাওয়া যায়। সহায়তা ও সরলতা তাঁর রচনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গুন। সপ্তদশ শতকের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ তুলে ধরার মধ্য দিয়ে কাব্যটি অন্য এক গুরুত্ব পেয়েছে।

###মনসামঙ্গল কাব্যের অপ্রধান কবিগন :

               ||তন্ত্রবিভূতি ||

*সপ্তদশ শতকের শেষভাগে উত্তরবঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যের কবি তন্ত্রবিভূতি।
*অধ্যাপক আশুতোষ দাস মালদহ থেকে তন্ত্রবিভূতির কাব্যের পুঁথি আবিস্কার করেন।
**কাব্যের নাম :'মনসাপুরাণ' ।
* জাতিকে তাতি হবার কারণেই ভনিতায় নিজেকে তন্ত্রবিভূতি বলছেন কবি - এমনটাই অনুমান করেছেন সুকুমার সেন।
*"উত্তরবঙ্গের মনসামঙ্গলে যে নতুনত্ব পরিলক্ষিত হয়, তাহার প্রথম সূচনা করেন তন্ত্রবিভূতি।" - অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ।

              ||  জগজ্জীবন ঘোষাল ||

* সপ্তদশ শতকের উত্তরবঙ্গীয় কবি। দিনাজপুর জেলার কুচিয়ামোড় গ্রামে ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
**দেবখন্ড ও বণিয়াখন্ড - এই দুই ভাগে বিভক্ত তাঁর কাব্য।
***আশুতোষ দাস ও সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য 1960 খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগজ্জীবন ঘোষালের পুঁথি প্রকাশ করেন।

                ||জীবন মৈত্র ||

*অষ্টাদশ শতাব্দীর উত্তরবঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যের অন্যতম কবি ।
**করতোয়া নদীর তীরে লাহিড়ীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
***কাব্যের নাম - 'পদ্মাপুরাণ'।**কাব্যটি দেবখন্ড ও বনিকখন্ডে বিন্যস্ত।
**রচনাকাল - 1744 খ্রিস্টাব্দ ।
*কবির উপাধি ছিল - কবিভূষণ।

               ||বিষ্ণু পাল ||

*অষ্টাদশ শতাব্দীর রাঢ়বঙ্গের মনসামঙ্গল কাব্যের কবি ।
**রাম উপাসক কবি জাতিতে কুম্ভকার ছিলেন।
**ববর্ধমান ও বীরভূমে কবির কাব্যের পুঁথি পাওয়া গেছে।
**কাব্যের নাম - 'অষ্টমঙ্গলা' ।

                   ||ষষ্ঠীবর দত্ত ||

*অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের কবি ।
*তিনি শ্রীহট্ট জেলার অধিবাসী ছিলেন।
*উপাধি - গুনরাজ খাঁ।
**কাব্যের নাম - 'পদ্মাপুরাণ' ।
*কাব্যটি দেবখন্ড, বানিজ্যখন্ড ও স্বর্গারোহন খন্ড - এই তিন খন্ডে বিভক্ত।
*1332 বঙ্গাব্দে বিরজাকান্ত ঘোষের সম্পাদনায় শ্রীহট্ট থেকে ষষ্ঠীবর দত্তের 'পদ্মাপুরাণ' প্রকাশিত হয় ।

**1343 বঙ্গাব্দে ফণীন্দ্রচন্দ্র দাস ও গিরিশচন্দ্র দাসের সম্পাদনায় শ্রীহট্ট থেকে ষষ্ঠীবর দত্তের 'পদ্মাপুরাণ' প্রকাশিত হয় ।
***ষষ্ঠীবর দত্ত তাঁর কাব্যে 'গরুড়পুরাণ', 'শিবপুরাণ', 'মহাভারত' ইত্যাদি থেকে উপাদান সংগ্রহ করেছেন।

তথ্যসূত্র :বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস - সুকুমার সেন।
বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ।
বাংলা সাহিত্য পরিচয় - পার্থ চট্টোপাধ্যায় ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - দেবেশকুমার আচার্য ।
        এবং
ইন্টারনেট।।

♦তথ্যসংগ্রহ ও উপস্থাপনায় : তাপস ঘোষ♦
(ছাত্র- বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়)
♦অ্যাডমিন- সাকসেস বাংলা গ্রুপ♦
                    

Share this