বিনয় মজুমদার : ইঞ্জিনিয়ার কবি

♦বিনয় মজুমদার : ইঞ্জিনিয়ার কবি♦
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
 (১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ - ১১ ডিসেম্বর ২০০৬)

¤ জন্ম ও জন্মস্থান :
১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ সেপ্টেম্বর (১৩৪১ বঙ্গাব্দের ১৩ ভাদ্র) রাত ১২টা ২০ মিনিটে বার্মার মিকটিলা জেলার তেডো শহরের নমঃশূদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

¤ পেশা :-
ইঞ্জিনিয়ার, কবি, সহসম্পাদক। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কবি, ইঞ্জিনিয়ার ও সহসম্পাদক।

¤ সময়কাল : পঞ্চাশ দশক। ইঞ্জিনিয়ার কবি বিনয় মজুমদার বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে কবিতা লিখে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।

¤ উপাধায় আখ্যায়িত / উপাধায় ভূষিত :-
১) 'ইঞ্জিনিয়ার কবি'।
২) 'কালের কবি'।
৩) 'কালান্তরের কবি'।
৪) 'কবিদের কবি'।

¤ পারিবারিক জীবন :-
তাঁর পিতার নাম বিপিনবিহারী মজুমদার এবং মাতার নাম বিনোদিনী দেবী। জন্মাবার পর বিনয়কে নিয়ে তাঁর পিতা-মাতা চলে আসেন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশের) ফরিদপুরে। তারা ছিলেন ছয় ভাই-বোন এবং তিনি ছিলেন সবার ছোট। তাঁর ডাক নাম মংটু।

¤ শিক্ষা জীবন :-
পাঁচ বছর বয়সে বিনয়কে তাঁর পিতা আবার নিয়ে চলে আসেন বার্মায়। এখানে শুরু হয় তাঁর লেখাপড়া। বারো বছর বয়সে বিনয়কে তাঁর পিতা তারাইল গ্রামে নিয়ে এসে বাড়ির পাঠশালায় ভর্তি করে দেন ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম বিভাগে ছাত্রবৃত্তিকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গোপালগঞ্জ শহরের বৌলতলী উচ্চবিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণিতে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বিনয়কে ভর্তি করা হয়। দেশভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে বিনয়কে নিয়ে তাঁর পিতা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন এবং উত্তর চব্বিশ পরগণার বনগ্রাম মহকুমার গাইঘাটা থানার শিমুলপুর গ্রামে বসবাস শুরু করেন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে বিনয়কে ক্রিকরো-র বউবাজার ব্রাঞ্চের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউটে অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নকুল রায় তাঁর অসাধারণ মেধা দেখে বছরের মাঝামাঝি সময়ে মেধা পরীক্ষা নিয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। বই পড়া তখন থেকেই ছিল তাঁর ভীষণ নেশা। এই সময় থেকেই শুরু হয় তাঁর কবিতা লেখা। প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে গণিতে আই. এস. সি পড়ার জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন। থাকতে শুরু করেন ইডেনে হিন্দু হোস্টেলে। এখানেই হিন্দু হোস্টেলের সুপারিটেনডেন্টের কন্যা গায়ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। এই গায়ত্রীই ক্রমে বিনয়ের কবিতায় 'ঈশ্বরী' হয়ে ওঠেন। প্রথম বিভাগে আই. এস. সি পাশ করে বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন। শোনা যায়, তার পাওয়া নম্বর আজও কেউ নাকি ভাঙতে পারেন নি।

¤ কর্মজীবন :-
১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কাব্য ও অনুবাদ গ্রন্থ। ১৯৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে, অর্থাৎ ছাত্রজীবন সমাপ্ত হবার কয়েকমাস পরেই এন.বি.এ থেকে প্রকাশিত হয় "অতীতের পৃথিবী" নামক একটি অনুবাদ গ্রন্থ। এই বছরেই গ্রন্থজগৎ থেকে বের হয় তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ 'নক্ষত্রের আলোয়'। চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে তিনি বই পড়তে থাকেন আর কবিতা লেখেন। কিছুদিন 'হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড' ও 'যুগান্তর' পত্রিকার সহসম্পাদক ছিলেন। দুর্গাপুর আয়রণ অ্যান্ড স্টিল প্ল্যান্টে সুপারভাইজারের কাজ কিছুদিন করেন। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর 'গায়ত্রী'কে নিয়ে কবিতা সংকলন প্রকাশিত হয়। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় 'ফিরে এসো চাকা' কাব্যগ্রন্থ। এটি ছিল তাঁর অতি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পিতা-মাতার কাছে তিনি শিমুলপুরে চলে আসেন।

¤ আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ :- 
তিনি কবিতার বিষয়বস্তু তুলে ধরেছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন তাঁর একটি মাত্র আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ - "আত্মপরিচয়"-তে।

¤ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ :- তিনি অনেক কাব্যগ্রন্থ রচনা করলেও, তাঁর খুব বেশি কাব্যগ্রন্থ সবার কাছে পরিচিত হয়নি বা খ্যাতি অর্জন করেনি। তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল :-
১) 'নক্ষত্রের আলোয়' (১৯৫৮)
২) 'গায়ত্রীকে' (১৯৬১)
৩) 'ফিরে এসো, চাকা' (১৯৬২)
৪) 'ঈশ্বরীর' (১৯৬৪)
৫) 'অধিকন্তু' (১৯৭২)
৬) 'অঘ্রাণের অনুভূতিমালা' (১৯৭৪)
৭) 'বাল্মীকির কবিতা' (১৯৭৬)
৮) 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' (১৯৮২)
৯) 'আমাদের বাগানে' (১৯৮৫)
১০) 'আমি এই সভায়' (১৯৮৫)
১১) 'এক পঙক্তির কবিতা' (১৯৮৮)
১২) 'কাব্যসমগ্র (১ম)' [১৯৯৩]
১৩) 'আমাদের মনে রেখো' (১৯৯৫)
১৪) 'আমিই গণিতের শূন্য' (১৯৯৬)
১৫) 'স্বনির্বাচিত ১৬' (১৯৯৭)
১৬) 'এখন দ্বিতীয় শৈশবে' (১৯৯৯)
১৭) 'কবিতা বুঝিনি আমি' (২০০১)
১৮) 'কাব্যসমগ্র (২য়)' [২০০২]
১৯) 'হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ' (২০০৩)
২০) 'সমান সমগ্র সীমাহীন' (২০০৪)
২১) 'শিমুলপুরে লেখা কবিতা' (২০০৫)
২২) 'পৃথিবীর মানচিত্র' (২০০৬)
২৩) 'বিনোদিনী কুঠী' (২০০৬)
২৪) 'একা একা কথা বলি' (২০০৬)
২৫) 'নির্বাচিত কবিতা' (২০০৬)
২৬) 'ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য' (২০০৬)
২৭) 'আকাশে চাঁদ নেই অথচ আজিকে পূর্ণিমা' [যুগ্ম প্রেমের কবিতা গ্রন্থ] (২০০৬)
২৮) 'দুপুরে রচিত কবিতা' (২০০৬)

¤ কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা :- 
তিনি অনেকানেক কবিতা রচনা করলেও, তাঁর এই কয়েকটি বিখ্যাত কবিতার নাম না জানালেই নয়। তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত কবিতার নাম হল :-
১) 'মুকুরে প্রতিফলিত'
২) 'ভালোবাসা দিতে পারি'
৩) 'আমার আশ্চর্য ফুল'
৪) 'কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে'
৫) 'আমরা দুজনে মিলে'
৬) 'আমাকেও মনে রেখো'
৭) 'আমার বাড়ির থেকে'
৮) 'আমিই তো চিকিৎসক'
৯) 'এরূপ বিরহ ভালো'
১০) 'কুঁড়ি'
১১) 'ঘুমোবার আগে'
১২) 'মুকুট'
১৩) 'সন্তপ্ত কুসুম ফুটে'
১৪) 'সময়ের সাথে এক বাজি ধরে'
১৫) 'একটি উজ্জ্বল মাছ'
১৬) 'তুমি যেন ফিরে'
১৭) 'কবিতা বুঝিনি আমি'
১৮) 'করবী তরুতে'
১৯) 'অনেক কিছুই তবে'
২০) 'আমার শোবার ঘর ছেড়ে'
২১) 'তুমি যেন ফিরে এসে'
২২) 'করবী তরুতে সেই আকাঙ্খিত গোলাপ'
২৩) 'চাঁদের গুহার দিকে'
২৪) 'শিমুল গাছের নিচে'
২৫) 'আর যদি নাই আসো'
২৬) 'একটি গান'
২৭) 'বর্ষাকালে'
২৮) 'মানুষ'
২৯) 'পাখি'
৩০) 'সৃষ্টির উপায়'
৩১) 'মাঝে-মাঝেই আমি'
৩২) 'ফিরে এসো, চাকা - ৩৩'
৩৩) 'ফিরে এসো, চাকা - ৫৫'
৩৪) '৮ মার্চ, ১৯৬০ - ফিরে এসো চাকা'
৩৫) '২৬ অগাষ্ট, ১৯৬০ - ফিরে এসো চাকা'
৩৬) '২১ জুন, ১৯৬১ - ফিরে এসো, চাকা'
৩৭) '২২ জুন, ১৯৬২ - ফিরে এসো চাকা'
৩৮) '২৭ জুন, ১৯৬২ - ফিরে এসো চাকা'
৩৯) '২৯ জুন, ১৯৬২ - ফিরে এসো চাকা (প্রথম)'
৪০) '২৯ জুন, ১৯৬২ - ফিরে এসো চাকা (দ্বিতীয়)'

¤ কবিতার বিষয়বস্তু :-
বিনয় তাঁর কবিতায় মানুষ, পৃথিবী, সময়, আর প্রেমকেই নতুনভাবে অন্বেষণ করেছেন। আমাদের শুভ প্রবৃত্তিকে 'আমি'-র কারাগার ভেঙে আমাদের মধ্যে তিনি ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন কবিতায়। বিনয়ের কবিতায় আধুনিক সমাজজীবন, হতাশা, যন্ত্রণার চিত্র বারে বারে এসেছে। বিনয় নিঃসঙ্গ জীবনের কথা বলেছেন, নিজেই ঈশ্বরীরূপে কথা বলেছেন, ---
                    'আকাশে চলতে হলে মানুষের মতো নয় কবিতার মতো হতে হয়, বাজপাখিদের মতো হতে হয় একেবারে আকাশের মতো জায়গায়।'

¤ কবিতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ বর্ণনা :-
১) নারীকে কোন ফাঁদে ফেলে কিংবা তাঁর চলার পথ রুদ্ধ করে প্রেমময় আখ্যান গড়া বিনয়ের মোটেও কাম্য নয় বলে ধরা যায়। এখানে তাঁর কাব্যবোধ প্রেমিকসত্তাকে প্রজ্ঞাবান করার পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতায় জারিত করে। এটাও বিনয়-অভিজ্ঞানে এক ধরনের ডিসকোর্স। তাঁর কবিতা থেকে নেওয়া যায় :-

'আমার সৃষ্টিরা আজ কাগজের ভগ্নাংশে
নিহিত কিছু ছন্দে, ভীরু মিলে আলোড়িত
কাব্যের কণিকা এখন বিক্ষিপ্ত নানা বায়ুপথে,
ঝড়ের সম্মুখে।
আমাকে ডাকে না কেউ নিরলস
প্রেমের বিস্তারে।'

২) বিনয় মজুমদার ‘দিকচক্রবাল’-এর ‘চক্র’ অর্থাৎ ‘চাকা’কে জীবনের সহায় ভেবেছেন। আর এই ‘চাকা যে চালায়, সে চক্রবর্তী, আমি সেই চক্রবর্তীকে ফিরে আসতে বলেছি - গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই একটা আস্ত চাকা বানিয়েছি।’ এই চক্রবর্তীই একাধারে বিনয়ের ‘প্রেম ও বিরহের’ মাঝে সমাসীন। তাঁর কবিতার পাঠ থেকে নেওয়া যায় :-

'ঝরে পুঁজ, ঝরে স্মৃতি, রহস্যনিলীনা অপসৃতা
কুমারীত্ব থেকে দূরে, আরো দূরে, অবরুদ্ধ নীড়ে।
আর আমি অর্ধমৃত ; বৃক্ষদের ব্যাপক অসুখে
শুশ্রূষা করার মতো অনাবিল প্রিয়জনও নেই।'

৩) বলাবাহুল্য, বিনয়ের কিছু কবিতা রয়েছে যেগুলোতে ‘কাম’ বিষয়ক চিন্তাভাষ্য চিত্রিত হয়েছে। তার ‘সন্তপ্ত কুসুম ফুটে’ কবিতাতেও কেউ কেউ কিছুতেই সেগুলোকে ‘অকবিতা’ বলার সুযোগ নেই। বিনয়কে মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর সে কবিতা গুলিরও গভীর পাঠ জরুরি। বিনয় ('হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা') নিজের ঠিকানা হারিয়ে গেছে বলে মনে করেছেন, মনে করেছেন ‘ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই’ ; এটা তাঁর জীবনসত্য কিন্তু কবিতার সত্য এর সম্পূর্ণ বিপরীতে। তিনি কবিতায় প্রেম ও বিরহের যে ভিন্ন দ্যোতনা ছুড়ে দিয়েছেন, তা কবিতার প্রকৃত পাঠক ঠিকই বুঝে নিতে সক্ষম হবেন। কবি বিনয় মজুমদার অন্ধকারে বসে আলোর তপস্যায় মগ্ন থেকেছেন। সরল গ্রাম্যজীবনের লোকবিশ্বাস বুকে লালন করে নিরন্তর হেঁটেছেন সত্যানুসন্ধানে। আশার জটিলতায় সামিল না হয়ে বুকের ভেতর গড়ে তুলেছেন মসৃণ শিল্পঘর। লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে তিনি শিল্প সুষমার নিখুঁত তুলিতে এঁকেছেন কবিতার প্রতিটি পঙ্‌ক্তি। মার্কিন কবি জিন গ্যারেজ বলেছেন, ‘একটি কবিতার প্রতিটি পঙক্তিই হলো এক আত্মজীবনী।’ এ মহান উক্তির সঙ্গেই জীবনের গাঁটছড়া বেঁধেছেন কবি বিনয় মজুমদার। তাঁর শাব্দিক কথামালা ও হার্দিক বর্ণমালা জুড়ে রয়েছে ধ্রুপদী সদগুণের সমন্বয়।
বিনয়ের কবিবন্ধু উৎপল কুমার বসুর বলেন :- ‘বিনয়ের অনেক কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আমরা বুঝি তেমন এক অন্তিম অবস্থায় পৌঁছে গেছি যেন এরপর আর কোন কবিতা হয় না।’ আর এর সূত্র ধরে বিনয়ের বহুল আলোচিত ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতা নিয়ে আমার এ ক্ষুদ্র ডিসকোর্স। বিনয়ের কবিতায় প্রেম-বিরহ বিষয়ক এ ডিসকোর্সটি তার ব্যক্তির সৃষ্টিকুশলতা থেকে সামষ্টিক গভীরতার দিকে বেগবান কি-না সেটি বিবেচনা করা দরকার। যেহেতু তাঁর কবিতার তাত্ত্বিক গুরুত্বের ; পাশাপাশি দর্শনের গুরুত্বও অস্বীকারের সুযোগ নেই। তবে নৃ-ঐতিহ্যে কবিতার বিস্তার শৈলী, কতটুকু গ্রহণীয় তার ব্যাখা দাঁড় করানো এ ডিসকোর্সের উদ্দেশ্য নয়। ফলে আলোচিত প্রেম-বিরহের ডিসকোর্সটি বিনয় অভিসন্দর্ভের সূচনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, অভিজ্ঞান শেষে এমনটি প্রত্যাশা করা যেতেই পারে।

৪) সামাজিকতার বন্ধুবৎসল অভিজ্ঞানে বিনয় মজুমদারও ব্যতিক্রমী নন। এরপরও তাঁর নির্জন স্বেচ্ছাবাস, যাপিত অভিজ্ঞতার নানামাত্রিকতা উঠে আসে বিরহ-কাতরতার আদলে। সমসাময়িকদের কাছে অপমানিত এবং প্রেমে ব্যর্থতা বিনয়ের মানবীয় উপলব্ধিতে সজোরে আঘাত করে। তাঁর নিজস্ব-দর্শন শ্রেণিসংগ্রামের দ্যোতকতা নিয়ে মানসলোক বিলড়িত করে। যার সুস্পষ্ট শৈলী কবিতায় উপস্থাপিত হতে দেখি বিচ্ছেদের নিরিখে। বস্তুত প্রেম-বিরহ বিষয়ক ভাবনা তাকে আচ্ছন্ন রাখে। সঙ্গত দৃষ্টিতে কাব্য-সাহিত্যের বিশ্ববীক্ষায় বিনয় প্রেমের মধু-বিস্বাদ প্রতিতুলনার দাবি করে। প্লাটোনিক প্রেমকে সংজ্ঞায় এনে কবির অভিজ্ঞান বহুমাত্রিক দৃষ্টিকোণে বিশ্লেষিত হতে পারে। কবিতায় অস্তিত্ববাদ, রিয়ালিজম, স্যুররিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম কিংবা প্রাচ্যবাদের ধারণায় বর্তমানের পরিপ্রেক্ষিতে বিনয়ের কবিতা বিশ্লেষণ বা বিস্তারিত পাঠোদ্ধার করা যেতে পারে। কিংবা, পাশ্চাত্য সাহিত্যের যেকোনো প্রেম বিষয়ক দ্বান্দ্বিকতা ডিসকোর্সের উপজীব্য হতে পারে।

'শুধু গান ভালোবাসো ; বিপদার্ত মিলনচিৎকারে
এমন আগ্রহীনা, চ’লে গেছো পার্কের আশ্রয়ে।'

কিংবা,

'অপূর্ণের ক্লেশ এই, যে-শাখাগ্রে ফাল্গুনে আমের
বোল মুকুলিত হয়, সে শাখায় নতুন পাতার
উদ্গমের পথ নেই; কোথায় মুকুলিত প্রেম?'

৫) বিনয় বলতেন : ‘আমি গণিতবিদ। আমার অধিকাংশ সময় কাটে গণিত চিন্তায়। আর কবিতা, মানুষ যেরকম কাজের অবসরে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান করে তেমনি।’ বিনয়ের চিন্তার ভেতর দিয়ে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, তিনি বস্তুত  যাপনের নানাবিধ বিষয় দেখতে ও দেখাতে চেষ্টা করেছেন গণিত সমীকরণ তত্ত্বের মধ্য দিয়ে। বিনয় বিশ্বাস করতেন - যেহেতু এই বিশ্বে কোনোকিছুই গণিতের বাইরে নয়, সে কারণে কবিতাও অবশ্যই গণিতহীন নয়। কিন্তু তিনি গাণিতিক বিশ্বাস ও সূত্রে প্রেমের সমীকরণ মেলাতে পেরেছেন এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না তার কবিতায়।
বিনয় মজুমদারের কবিতার প্রসঙ্গ এলে ‘গায়ত্রী চক্রবর্তী’ নামটি স্বাভাবিক ভাবেই সানে চলে আসে। যাকে তিনি ‘ঈশ্বরী’, ‘চাকা’, ‘মানুষী’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করেছেন। কল্পনার রঙে তাকে নিয়েই গড়ে তুলেছেন প্রেমের বিশ্ব। ‘কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে’ কবিতায় তিনি বলেন:-

'কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে।
কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ, দিকচক্রবাল।
সময়ে ভেবেছিলাম সম্মিলিত চায়ের ভাবনা,
বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু।
দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়
তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত।'

৬) প্রেমপর্বে তিনি নির্ণিমেষ জ্যোৎস্নার সন্ধানে ব্যস্ত থেকেছেন, শোকের ছায়াকে দেখেছেন প্রজ্ঞার অভাবিত শান্তি মূল্যায়নের সপক্ষে। প্রেম ও অ-প্রেমের মত তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণায় কবিমানস নির্বিবাদে ঘুরপাক খায় কবিতার বেলাভূমে। কাঙ্ক্ষিত নারী হৃদয়ের অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হয়েছেন বিনয় মজুমদার। তাই কাক্সক্ষার মনোজাগতিক জটিল ঘূর্ণন তাঁর কবিতায় যে আলো-আঁধারের চিত্রকল্পে, নৈঃশব্দ পরিক্রমণ করে তাঁকে কী আত্মবৈপরীত্য বলা যায়? এ প্রশ্ন এড়িয়েও সুলুক সন্ধানী পাঠক বোঝেন তাঁর কবিতা ছুঁয়ে যায় গোপন কাঙ্ক্ষার সব দরজা। তখন কবিতা হয়ে ওঠে হতাশ্বাস জীবনের পরিপূরক - ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় বলেন :-

'আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল -

আকাশের হৃদয়ের ; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
অথবা ফড়িঙ তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়।
উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে।
আমি রোগে মুগ্ধ হয়ে দৃশ্য দেখি, দেখি জানালায়
আকাশের লালা ঝরে বাতাসের আশ্রয়ে আশ্রয়ে।

আমি মুগ্ধ ; উড়ে গেছ ; ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো।
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন।'

৭) তখন বিনয়ের কবিতায় প্রেমের পারস্পরিক প্রজ্ঞা নিয়ে আর কথা থাকে না। কবিতা পাঠে মননের যে দরজা খুলে যায় তাতে শুধু প্রেমহীন হতাশা আর আকুতি তীব্রতর হয়।

কবিতার রস আস্বাদন করতে হবে সৌন্দর্যের মধ্য দিয়ে, দর্শন দিয়ে নয়। ফলে বিনয়ের কবিতায় দর্শন অন্বেষার তেমনি কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। বিনয়ের কবিতা কবিতার মধ্যেই, অন্য কিছুর মধ্যে নয়। তার কবিতায় সৌন্দর্যের অভিজ্ঞান শুধু ফুলকে ঘিরেই নয়, কাঁটা নিয়েও। এই দার্শনিক তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে ‘আত্মপরিচ’-এ লিখেছেন : ‘এইসব দার্শনিক বিষয় ভাবতে ভাবতে আমার সময় চলে যেতো মাসের পর মাস। এখনো আমি ভেবেই চলেছি। এই দর্শনের উপস্থিতি কবিতায় একেবারে প্রত্যক্ষ না হলেও চলে, হয়তো তার আভাস মাত্র থাকলেই হয়। কিন্তু আভাসই হোক আর যা-ই হোক উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন।’ তবু এ কথা স্বীকার্য যে দর্শনের জন্য কবিতা পাঠ নয়, কবিতার জন্যই কবিতা পাঠ। তিনি তাঁর "একটি উজ্জ্বল মাছ" কবিতায় বলেছেন :-

'একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো-এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনায় গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল।'

৮) বিনয়ের কবিতাকে ‘আধুনিক কামসূত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করার অপপ্রয়াস তাঁর সমকালে যেমন দেখা গেছে তেমনি তাঁর মৃত্যুর পরও এ অপচেষ্টা থেমে নেই। কিন্তু আমার এ ডিসকোর্সের উদ্দেশ্য নিন্দাভাষ্য রচনা নয়, বরং তাঁর কবিতার অন্তর্নিহিত প্রেম বিষয়ক মূল্যবোধকে তুলে ধরার চেষ্টা। ‘সন্তপ্ত কুসুম ফুটে’ কবিতায় তিনি নিজেকে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন, বলতে চেয়েছেন তার অন্তস্থিত বিরহের বিবরণ :-

'সন্তপ্ত কুসুম ফুটে পুনরায় ক্ষোভে ঝরে যায়।
দেখে কবিকুল এত ক্লেশ পায়, অথচ হে তরু,
তুমি নিজে নির্বিকার, এই প্রিয় বেদনা বোঝো না।

কে কোথায় নিভে গেছে তার গুপ্ত কাহিনী জানি।
নিজের অন্তর দেখি, কবিতার কোনো পঙ্ক্তি আর
মনে নেই গোধূলিতে ; ভালোবাসা অবশিষ্ট নেই।
অথবা গৃহের থেকে ভুল বহির্গত কোনো শিশু
হারিয়ে গিয়েছে পথে, জানে না সে নিজের ঠিকানা।'

৯) বিরহের জীবনকে বিনয় মজুমদার গাণিতিক সমীকরণে মেলাতে চেষ্টা করেছিলেন। এজন্য বারবারই বাস্তব আর বিরহকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে প্রেমের সত্যদর্শন বোঝার চেষ্টা করেছেন, গণিতের সূত্রে জীবনের মর্মার্থ অন্বেষণে ভিন্নমাত্রা যুক্ত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। যে কারণে কবিতায় ব্যক্তিক অভিনবত্ব, প্রেমের অভিভাষণ ভিন্নতর প্রকরণে উপস্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর কবিতার গভীর পাঠে এক ধরণের মনোবৈকল্য ধরা পড়ে। গ্রন্থটির শেষের কবিতাগুলোতে তাঁকে কামোন্মাদ হতে দেখি। নারীবাদী চিন্তায় তার জাগতিক সংকল্প প্রকাশিত হয় বিচ্ছেদের প্রজ্ঞারূপে। জৈবিক মিথুন-সত্তায় আক্রান্ত বিনয় মজুমদার না পাওয়ার তীব্রতর বেদনা শব্দমাধুর্যে উপস্থাপন করেন।

'রক্তের ভিতরে জ্যোৎস্না ; তবু বুঝি, আজ পরিশেষে
মাংসভোজনের উষ্ণ প্রয়োজন ; তা না-হলে নেই
মদিরার পূর্ণ তৃপ্তি; তোমার দেহের কথা ভাবি -
নির্বিকার কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে অন্ধকার, সুখ
এমন আশ্চর্যভাবে মিশে আছে ;'

কিংবা,

'কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে-ক্রমাগত
ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখো, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে।
আড়ালে যেও না যেন,'

১০) একজন কবিকে চিন্তার গভীরে নিয়ে যায় যে অন্তর্দাহ, তা টি. এস. এলিয়ট পাঠে যেমন পাওয়া যায়, তেমনি ফুটে ওঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। আবার একই প্রণোদনা স্পষ্ট হয় বিনয় মজুমদারের কবিতায়ও। ১৯৬২ সালে তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হলে সমসাময়িক কবিরা তাকে পাগল আখ্যা দেন। টি. এস. এলিয়টের ক্ষেত্রেও এমন অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছিল। অথচ, এলিয়ট-ই কাল পরিক্রমণে আধুনিক কাব্যের স্বর্ণশিখরে সমাসীন।
            কবিতা হৃদয়াবেগের সংরাগ থেকে সৃষ্টি না হলে কবিতার রসাস্বাদনে সৎ পাঠক মাত্রই বিভ্রান্ত হয়। অথচ ভাবালুতাসর্বস্ব কথামালা আর যা-ই হোক কবিতা পদবাচ্যে গৃহিত হয় না। প্রযত্ন-পরিশীলিত বোধের উপস্থিতি ও প্রকরণ স্বকীয়তা কবিতাকে সসীম থেকে অসীমের পথে ধাবিত করে। কবিতার গুণমুগ্ধ আলোচকদের কবিতাকেন্দ্রিক এসব প্রপঞ্চ বিবেচনায় ‘ফিরে এসো, চাকা’র পুনঃপাঠ অভিজ্ঞতার নিরিখে বলা যায়, বিনয়ের কবিতা নৃ-ঐতিহ্যে ব্যাপ্ত হৃদয়ের গভীরে জন্ম নেয়া প্রেম-অভিজ্ঞান বিষয়ক এক আলোকপর্বমূখী বোধ। যা সমকালিন প্রেক্ষাপটে প্রকরণগত বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র, প্রেম-বিরহের ডিসকোর্স হিসেবে অত্যুজ্জ্বল।
বিনয়ের ‘ভালবাসা দিতে পারি, তোমরা কী গ্রহণে সক্ষম’ পঙ্‌ক্তিটি বিফলতা নির্দেশক। বলা যায়, মানবজীবন ঘনিষ্ট হতাশা, বিষণ্নতা, প্রত্যাখ্যান, বিরহ-দাহ এক ধরনের মনোবিকারের জন্ম দেয়। এই মনোবিকারই প্রকৃত কবির সৃজনযন্ত্রণার সময়কাল। কবি দেশ-কাল, সময়, ইতিহাস-ঐতিহ্য, সংস্কৃতি-সভ্যতা ধারণ করে পথ পরিক্রমণে অগ্রবর্তী। মানুষ জন্ম থেকে পর্যায়ক্রমের দিকে চলিষ্ণু তেমনি, কবিতাকেও হতে হয় ‘বিন্দু থেকে সিন্ধু’ অভিমুখী। কবিমানসের প্রেম-বিরহের স্থুলতা অতিক্রম করে এ কাব্যের প্রতিটি পঙ্‌ক্তি পৌঁছে যায় ভাবনার তুরীয়লোকে। তখন প্রেমের ঐ অভিজ্ঞান অতিক্রম করে সকল মর্মচেতনা। স্বপ্নকল্পের প্রেম, বাস্তবতার ছেদন প্রক্রিয়ায় পাঠককে বিমোহিত করে। বিরহের সঙ্গে মানব হৃদয়ের যোগসূত্র কেবল প্রকাশ্য ব্যঞ্জনার স্মারক না হয়ে পৌঁছে যায় রক্তের প্রতিটি কণায়। তাঁর এই কবিতার এই লাইনগুলি তাই বিখ্যাত হয়েছে :-

'অত্যন্ত নিপূণভাবে আমাকে আহত ক’রে রেখে
একটি মোটরকার পরিচ্ছন্নভাবে চ’লে গেলো।
থেমে ফিরে তাকালেই দেখে যেতো, অবাক আঘাতে
কী আশ্চর্য সূর্যদয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে কুয়াশা,
কী বিস্মিত বেদনায় একা-একা কেঁদে ফেরে শিশু।'

১১) বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতে ফার্নান্দো পাসোয়ার মতো বিনয়ের কবিতাও তাঁর আত্মজীবনীরই অংশ। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানে ৭৩ বছরের যে জীবন, তা জীবাশ্ম হয়ে আছে তাঁর কবিতার ভাঁজে ভাঁজে।


¤ তাঁর কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য :-
১) কবি জয় গোস্বামী বলেছেন, --- 'বিনয়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটি গত ২২ বছর ধরে অফুরান পাঠ্য আমার। সম্পূর্ণভাবে বিদ্বেষমুক্ত এঁর কাব্য। এই কবিতা বদাপি কোনো তিক্ততা প্রকাশ করে না। প্রতিহিংসার ছায়ামাত্র নেই, আজকের নতুন বাংলা কবিতাচর্চায় যুগধর্মোচিত স্তেষ ও ব্যক্তিহিংসার অবিরল যে গরলপাত ঘটে চলেছে সেই ভূমিতে দাঁড়িয়ে বিনয়ের কবিতার দিকে তাকালে দেখা যায়, এমন কী ব্যঙ্গবিদ্রূপের অতি প্রচলিত ছুরিফাটিও এ কবিতা হাতে তুলে নেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। বরং এ কবিতার পিছনের মন এক বিজ্ঞানীর মতো দূরগামী, গণিতজ্ঞের ন্যায় যুক্তিপথ মান্যকারী, আবার বালকসুলভ বিস্মিত অবুঝ এক জিজ্ঞাসুও এই মন। এই কাব্যের প্রণেতাকে নব্য সাহিত্য আন্দোলনকর্তা বলেও দাবি করা যাবে না।' ('আকাশ গঠন করা')

২) অধ্যাপক জোতির্ময় দত্ত বলেছেন, --- 'আমরা সবাই এই বিশাল পৃথিবীতে হারিয়ে-যাওয়া অনাত বালক, কিন্তু বিনয় মজুমদারের আয়া এই কথাটি কেউ আমাদের মনে করিয়ে দেননি।' ('কৃত্তিবাস' পত্রিকা, ১৯৬৫)

¤ কয়েকটি কুখ্যাত ছোটগল্প সংকলন :- তাঁর হাতে গোনা ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁকে কখনোই ছোটগল্পকার হিসাবে পরিচিতি দেয় না। তাঁর সেই ছোটগল্প সংকলনগুলি হল :-
১) 'বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প'
২) 'বিনয় মজুমদার'
৩) 'শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলন'

¤ কয়েকটি কুখ্যাত ছোটগল্প :-
বিনয় মজুমদারের অপরাহ্ণকালে লেখা গদ্য যা অধিকাংশই আসলে একপ্রকার দিনলিপি, সেসবই প্রকাশ করা হয়েছে ছোটগল্প নামে। তাঁর কয়েকটি ছোটগল্পের নাম হল :-
১) 'ফাঁস'
২) 'লেখা লিখন রচনা'
৩) 'বিশ্ববীক্ষা'
৪) 'দর্জিপাড়ার ইতিহাস'
৫) 'মনা আজ এসেছিলে আমার কাছে'
৬) 'মানচিত্র'
৭) 'ভারত'
৮) 'জমির দাম'
৯) 'কবির গল্প'
১০) 'আমার চাষিভাইয়েরা'
১১) 'খাদ্য'
১২) 'পৃথিবী বিখ্যাত'
১৩) 'জ্ঞানদান'

¤ প্রথম ছোটগল্প প্রকাশের তথ্যবহুল ঘটনা :-
১) ১৯৯৮ সালে উৎপল ভট্টাচার্য সম্পাদিত 'কবিতীর্থ সাহিত্য পত্রিকা'র উদ্যোগে তাঁর প্রথম গল্পের বইটি  প্রকাশিত হয় বারোটি গল্প নিয়ে। বারো বছর পর দ্বিতীয় সংস্করণে আরো আঠারোটি গল্প যুক্ত হয়।

২) 'কবিতীর্থ'-এর বাংলা ১৪২৪ সালে প্রকাশিত সাড়ে পাঁচশো পৃষ্ঠার ‘বিনয় মজুমদার’ সংখ্যায় একটি আর ছোট কাগজ মাদুলি প্রকাশিত বিশেষ সংখ্যার ষাটটি লেখার ভেতর মাত্র তাঁর একটি লেখা পাওয়া যায় গদ্য-সম্পর্কিত।

¤ তাঁর ছোটগল্প সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
১) বিনয় মজুমদারের গল্পসংখ্যা যেমন সীমিত তেমনি আকারও। কোনো গল্পই হাজার দেড়েক শব্দও অতিক্রম করেনি, এক হাজার থেকে বারোশো শব্দে সীমিত। বহুমুখী ব্যঞ্জনা নিয়ে নয়, একমুখী হয়ে রচনা করেছেন। তবে তাতে মূল গল্পটি কোথাও বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। আর সেটি করেছেন যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্থান পেয়েছে বিশ্বের নিত্যসত্য।

২) কখনো কখনো বর্তমানকে প্রমাণ করতে তিনি অতীতের কোনো ঘটনা টেনেছেন বটে তবে তা গল্পের আকারে নয়। তাই বিনয়ের গল্পকে ৩-২-১ বা ২-১-৩ এমন কোনো ধারার বলা যাবে না। গল্পে ঘটনার ঘনঘটা নেই। সাসপেন্স তৈরি করেননি।

3) বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প আত্মমুখী হয়েও সমাজনির্ভর। যদিও সেস্নাগানমুখী নয়, কিন্তু প্রখরভাবে রাজনৈতিক। কবিতার মতোই তাঁর গদ্যের কণ্ঠস্বর স্বতন্ত্র, ভিন্ন ধারার। একটা ছোটগল্প শেষ করার পর পাঠকের যে-আত্মতৃপ্তি বা অতৃপ্তির বাসনা রয়ে যায়, তাঁর গদ্যে তা নেই। তিনি সফলভাবে তাঁর গল্পটিতে দর্শন নিয়েই আপনাকে ভাবতে বাধ্য করবে, চরিত্র নিয়ে নয়। বিনয় মজুমদারের গল্পে অংক এসেছে, জ্যামিতি অধিক আর অধিকাংশে রয়েছে প্রকৃতি, জড় বস্ত্ততে সন্নিবেশ। পাঠের পর মনে হয়, একটা দিনলিপি শেষ হলো।

¤ সাক্ষাৎকারে ছোটগল্প সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য :-
১) এক সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছেন, ‘একদিন ঘরে বসে আছি। জানালার কাছে একটি যুবক এসে বললো, ‘দরজা খুলুন, আমি কবিতীর্থ থেকে এসেছি।’ দরজা খুলে যুবকটিকে ঘরে আনলাম। যুবকটি হাতে দুকপি বই দিয়ে বলল, ‘এই আপনার ছোটগল্প। নিন’। দেখি যে, সত্যই তাই। বইয়ের মলাটেই মোটা ব্রাশ দিয়ে অাঁকা নাম – ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’। আমি আনন্দে আর কথাই বলতে পারলাম না কিছুক্ষণ।’

২) উপমা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘উপমা দেওয়া মানেও দর্শনকে হাজির করা।’

৩) বিনয় মজুমদার তাঁর অভিজ্ঞান নিয়ে বলেছেন - ‘সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত। এদের ভিতরে সূত্রগুলি পৃথক নয়, একই সূত্র তিনের ভিতরে বিদ্যমান। আর এই সত্য সম্বল করে ভেবে দেখলাম, জড়ের জীবনে যা সত্য মানুষের জীবনেও তাই সত্য। অতএব  জড় এবং উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করতে লাগলাম আমি। এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পদযাত্রা, আমার নিজস্বতা। এইভাবে সৃষ্টি হলো আমার সমস্ত রচনা।’

¤ তাঁর ছোটগল্প সম্পর্কে মন্তব্য :-
অভীক চট্টোপাধ্যায় বিনয়ের ছোটগল্প সম্পর্কে বলেছেন, ‘তিনি  যেন ডায়ালেকটিক পদ্ধতিতে সাবট্র্যাকশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো সত্যে উন্নীত হতে চাইছেন।’

¤ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি :-
১) সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, গণিতবিদ ওমর খৈয়াম, সালভাতোর কোয়াসিমিদো, এডওয়ার্ড লিয়র কবিতার সঙ্গে সখ্য করেছিলেন। কমলকুমার মজুমদার গণিত রসিক ছিলেন কিন্তু কবিতা লেখেননি। আর বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো কবি কিংবা সরদার ফজলুল করিমের মতো পণ্ডিত-সাহিত্যিকও গণিতের প্রতি তাদের ভয়ের কথা স্বীকার করেন সরলভাবেই। তবে বিনয় মজুমদার সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা এমন ৬০ দশকের শুরুতে বাংলার এককোণায় কবিতা ও গণিতের এমন এক সমাহার হয়েছিল যা হয়তো ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। গণিতের এই দুর্বোধ্যতার মিথ এবং কবিতা ও গণিতে একেবারে দুই বিপরীত মেরুর বিষয় এই মিথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনয় মজুমদার নামে একটি মিথের জন্ম। তিনি যেন এক মিথ হয়ে যাওয়া কবি। তাঁর কবিতা আর গণিতের সমাহার প্রসঙ্গে তাঁরই লেখা থেকে :-

'প্রত্যেক শিশুই কিছু জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভে থাকে,
প্রত্যেক শিশুই এই জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়েছে,
        প্রমাণ : প্রত্যেক শিশু জন্মই মায়ের দুধ
                      পান করে চুষে চুষে, দেখি।'

২) ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়েন বামপন্থি ছাত্রসংগঠনে। ভাষায় পারদর্শিতা, গণিত, কবিতা এমনকি রাজনীতি নিয়েও যেন তার গভীরতার কমতি ছিল না। তিনি তার রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেন, 'আমি এক কমিউনিস্ট-এই কথা উচ্চারিত হোক/ দিকে দিকে পৃথিবীতে-এ আমার সঙ্গত কামনা।'

৩) তাঁর কাব্য চেতনায় ‘প্রেম-ভালোবাসার চিরায়ত বিষয়টিকে তিনি সাজিয়েছিলেন ভিন্নভাবে। তাঁর কবিতায় তিনি লিখেছেন সেইকথাই তবে তার প্রকাশটা ঠিক ওভাবে নয়। কাব্য ‘ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসা ভরে দিতে পারে মনে/শান্তি এনে দিতে। কেবল নারীর প্রতি পুরুষের কিম্বা কোনো পুরুষের প্রতি/কোনো নারীর প্রণয় ভালোবাসা...’। বিনয় মজুমদার ইঞ্জিনিয়ার অর্থাৎ যন্ত্রশিল্পী হয়েও নিজেকে বিস্তৃত করে হয়ে উঠলেন কথাশিল্পী। এরই মধ্যে কিছুদিন খবরের কাগজে চাকরি করেন আবার ছেড়েও দেন। তারপর কথাশিল্পীর কারখানা গড়ে তুলেছিলেন কলকাতার কফি হাউসে। সেখানে তার বন্ধু ছিল সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।

৪) তাঁর কবিতার টেক্সচার নির্মাণে সেসব বিষয় স্পষ্ট। তাঁর সম্পর্কে অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের মুল্যায়নও গুরুত্ববহ। কবি বিনয় মুখোপাধ্যায়কে কেউ স্বাভাবিক মেধাবী কবি ভাবেননি কখনও। 'কবিদের কবি' হিসেবেই তাঁর খ্যাতি। এ খ্যাতি কখন কার ভাগ্যে মেলে?

তিনি এসেছিলেন, ভালো বেসেছিলেন,
      প্রকৃতি, সারস, ফুল, বৃক্ষ-লতা, গাঁও-গেরাম, নদী,
মানুষের সত্য, মনুষ্যত্ব, অকপট আচরণ যেন নির্বোধের
তিনি নেই আর ঠাকুর পুকুরে, জলে-স্থলে-অনন্ত রোদসী আকাশে,
             পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোণে-ও আনাচে কানাচে।
ভালো ছাত্র। বিনয় ছিলেন না ঠিক টিপটপ, সামাজিক।        

৫) ওপার বাংলার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র তার এক লেখায় লিখেছিলেন - ‘কেচোর মায়ের পুত্রশোক মাত্র দু’দিনের। গরুর মায়ের আরেকটু বেশি। এই কমবেশী হওয়ার কারণ শুধুমাত্র ঘিলুর তারতম্য।’ এসব কথা এজন্যই বলা যে, বাজার অর্থনীতির পণ্য দস্যুতা। এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর ধাক্কা মননশীলতার ওপরও যেন আছড়ে পড়েছে। যার পরিণতির নাম ‘ডিজ্যুস সংস্কৃতি’। এই সংস্কৃতি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের বড় ধরনের সর্বনাশ করেছে। বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে যারা কবিতা সম্বন্ধে আলোচনার ধৃষ্টতা দেখায়। একবারে যেকোন কাউকে তারা অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু এই প্রবণতাকে তারা এমন জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছে যে, বিনয় মজুমদারের মতো কবির কবিতাকে তাঁরা অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট করে। তাঁর কবিতার সমালোচনা করার স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু সমালোচনা যেখানে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয় সেখানে আর বলার কী থাকে!

৬) বিনয় মজুমদার। 'কালের কবি', 'কালান্তরের কবি'। অনেকে তাঁকে ‘কবিদের কবি’ অভিধায়ও অভিযুক্ত করেন। কেউ কেউ তাঁর কবিতার বিভিন্ন প্রসঙ্গ পড়ে একবারেই বলে ফেলেছেন - বিনয় মজুমদারের কবিতা অশ্লীলতায় ভরা।

¤ শেষজীবন ও মৃত্যু :-
প্রেমে ব্যর্থতা বিনয়কে করে তোলে ছন্নছায়া। পরে তিনি মানসিক ব্যাধির শিকার হন। এক সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছেন, 'কেউ আমাকে সুখ দেয়নি, কেউ আমাকে ভালোও বাসেনি'। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর বিনয় ভীষণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাঁ কানে শুনতে পেতেন না, বাঁ চোখে দেখতে পেতেন না। অবশেষে ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে তিনি শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।

¤ উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা :-
১) "রবীন্দ্র পুরস্কার" (২০০৫) : তাঁর "কাব্যসমগ্র (২য়)" [২০০২] কাব্যগ্রন্থের জন্য।
২) "সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার" (২০০৫) : তাঁর "হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ" (২০০৩) কাব্যগ্রন্থের জন্য।


¤ তথ্যঋণ -
১) "আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস" - শ্রীতপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
২) "বিনয়ের 'ফিরে এসো চাকা'য় প্রেম" - অধ্যাপক বীরেন মুখার্জী।
৩) ইন্টারনেটের কয়েকটি পেজ।

★আলোচক : সৌম্য মাইতি 
(ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র, কিংসটন কলেজ, মেছেদা, পূর্ব মেদিনীপুর)

★ মডারেটর -- সাকসেস বাংলা★

Share this