রমাপদ চৌধুরী : একালের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক

Δ রমাপদ চৌধুরী : একালের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক Δ
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
         ( ২৮ ডিসেম্বর ১৯২২ - এখনও জীবিত)

 ¤ পরিচয় ও উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম :-
একালের বিখ্যাত ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হলেন রমাপদ চৌধুরী। 'প্রথম প্রহর' (১৯৫৪), 'বনপলাশির পদাবলী' (১৯৬২), 'লালবাঈ' (১৯৬৩), 'এখনই' (১৯৬৯), 'হৃদয়' (১৯৭৬), 'বাড়ি বদলে যায়' (১৯৮৪) ইত্যাদি তাঁর স্মরণীয় উপন্যাস। 'স্বর্ণমারীচ' (১৯৪৯), 'দরবারী' (১৯৫৩), 'কথাকলি' (১৯৫৯), 'ভারতবর্ষ এবং অন্যান্য গল্প' (১৯৬৯), 'পোস্টমর্টেম' (১৯৮২) ইত্যাদি ছোটগল্পগ্রন্থও তাঁর স্মরণীয় হয়ে আছে। আধুনিক মানুষের জীবনযন্ত্রণা ও জটিল মানসিকতাকে তিনি যথাযথভাবে রূপায়িত করেছেন তাঁর কথাসাহিত্যে।

¤ জন্ম ও জন্মস্থান :-
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ২৮ ডিসেম্বর তিনি বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার খড়গপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

¤ পেশা :-
ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, ভ্রমণ সাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও সম্পাদক।

¤ শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন :-
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে তিনি এম. এ. পাস করেন। দীর্ঘদিন তিনি 'আনন্দবাজার' পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। মূলত তিনি 'আনন্দবাজার' পত্রিকার রবিবারের 'রবিবাসয়িকি'র সম্পাদক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখা শুরু করেন। তাঁর অনেক গল্প নিয়ে অনেক চলচ্চিত্র হয়েছে। তাঁর মধ্যে 'বনপালাশির পদাবলী', 'এখনই', 'খারিজ', 'একদিন অচানক', 'সুন্দরী' উল্লেখযোগ্য।

¤ সাহিত্যজগতে আত্মপ্রকাশ :-
মাত্র ১৮ বছর বয়সে 'আনন্দবাজার' সাপ্তাহিক পত্রিকায় 'ট্র্যাজেডি' (১৯৪০) নামক গল্পের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন। তারপর ২২ বছর বয়সে 'যুগান্তর' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর ‘উদয়াস্ত’ (১৯৪৪) গল্প। তার কিছুদিন পরে 'আনন্দবাজার' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর 'বারো ঘোড়ার আস্তাবল' গল্প৷

¤ উন্মেষ কাল :-
রমাপদ চৌধুরীর প্রথম লেখা গল্পের নাম ‘ট্রাজেডি’। কিন্তু সেটি প্রথম প্রকাশিত হয়নি। ১৯৪০ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র। বয়স আঠারো বছর। কলেজ পালানো এক দুপুরে কলেজ স্ট্রিটের ওয়াই. এমসি. এ-র নীচের রেস্তোরাঁয় বসে লেখেন গল্পটি। দুই হবু-সাহিত্যিক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে লেখা। গল্পটি ছাপা হয় ‘আজকাল’ সাপ্তাহিকে। সেই শুরু। তার পর সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’ ও হুমায়ুন কবীরের ‘চতুরঙ্গ’ ত্রৈমাসিকের নিয়মিত লেখক তিনি। পঁচিশ বছর বয়স থেকেই তিনি সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও শারদীয় আনন্দবাজারের স্থায়ী লেখক হয়ে যান। সময়টা তখন চল্লিশের দশকের দ্বিতীয়ার্ধ, ১৯৪৭-৫০। এটাই গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর উন্মেষ কাল। তখন নিজেই ‘ইদানিং’ ও পরে ‘রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা’ নামে পত্রিকার সম্পাদনা করছেন। এ সময়ের মধ্যেই লিখে ফেলেছেন বেশ কিছু সার্থক গল্প।

¤ ছদ্মনাম :-
তিনি মূলত দুটি ছদ্মনামে তাঁর উপন্যাস ও ছোটগল্পগুলি রচনা করেছেন। সেগুলি হল :-
১) 'পত্রনবীশ'
২) 'রূপচাঁদ'

¤ উপন্যাস :-
রমাপদ চৌধুরীর কয়েকটি উপন্যাসের নাম নীচে দেওয়া হল :-
১) 'প্রথম প্রহর' (১৯৫৪)
২) 'অরণ্য আদিম'(১৯৫৭)
৩) 'দ্বীপের নাম টিয়ারঙ'(১৯৫৭)
৪) 'বনপলাশির পদাবলী'(১৯৬২)
৫) 'লালবাঈ'(১৯৬৩)
৬) 'পরাজিত সম্রাট'(১৯৬৫)
৭) 'এখনই'(১৯৬৯)
৮) 'পিকনিক'(১৯৭০)
৯) 'খারিজ'(১৯৭৪)
১০) 'হৃদয়'(১৯৭৬)
১১) 'লজ্জা'(১৯৭৬)
১২) 'বীজ'(১৯৭৮)
১৩) 'অভিমন্যু'(১৯৮২)
১৪) 'বাড়ি বদলে যায়'(১৯৮৪)
১৫) 'আশ্রয়'(১৯৮৮)
১৬) 'রাজস্ব'(১৯৯২)
১৭) 'অংশ'(১৯৯৬)
১৮) 'মানুষের সংসার'(২০০১)
১৯) 'যে যেখানে দাঁড়িয়ে'
২০) 'স্বজন'
২১) 'অ্যালবামে কয়েকটি ছবি'
২২) 'রূপ'
২৩) 'চড়াই'
২৪) 'শেষের সীমানা'
২৫) 'আরো একজন'
২৬) 'ছাদ'
২৭) 'বাহিরি'
২৮) 'দাগ'
২৯) 'এই পৃথিবী পান্থনিবাস'
৩০) 'আকাশপ্রদীপ'
৩১) 'ডুবসাঁতার'
৩২) 'স্বার্থ'
৩৩) 'সাদা দেওয়াল'
৩৪) 'পাওয়া'
৩৫) 'অহঙ্কার'
৩৬) 'জৈব'
৩৭) 'জনৈক নায়কের জন্মান্তর'
৩৮) 'দ্বিতীয়া'

¤ উপন্যাস সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
লেখকের জীবন অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে 'প্রথম প্রহর'-এর অরণ্যবাসী দ্বীপের আখ্যান 'দ্বীপের নাম টিয়ারঙ', বর্ধমান-কাটোয়া রেলপথের বনপলাশি গ্রামের কথা, শিক্ষক গিরিজা প্রসাদের সংসার জীবনের কথা বিবৃত হয়েছে 'বনপলাশির পদাবলী'-তে।
                  শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর 'বনপলাশির পদাবলী' উপন্যাস সম্পর্কে বলেছেন, --- 'বনপলাশির অন্তর হইতে ঊর্ধ্বোৎক্ষিপ্ত কয়েকটি বিচ্ছিন্ন গীত মূর্ছনা পদাবলী সাহিত্যের দিব্য সঙ্গীতের ঐকতানে সুর মিলাইয়াছে।'
                  'খারিজ' উপন্যাসের জয়দীপ চরিত্র মধ্যবিত্ত জীবনের স্বরূপকেই পরিস্ফুট করেছে। 'অভিমন্যু'র ডাক্তার সুভাষের চিন্তা, 'বাড়ি বদলে যায়' উপন্যাসে বাড়িওলা ও ভাড়াটের সম্পর্ক আমাদের অনেক কিছু ভাবতে শেখায়।

¤ প্রথম প্রহর (১৯৫৪) উপন্যাস :-
রমাপদ চৌধুরীর বিখ্যাত উপন্যাস হল 'প্রথম প্রহর' (১৯৫৪)। এটি তাঁর প্রথম উপন্যাস। ১৮৫৩ সালে ইংরেজরা রেলের পত্তন ঘটান এদেশে। রেলের পত্তন ঘটার সঙ্গে সঙ্গে অনেক গ্রামই শহরতলীতে রূপান্তরিত হল। নাগরিক সভ্যতা গ্রামীণ প্রচলিত সংস্কারের ওপর এসে আছড়ে পড়ল। রমাপদ চৌধুরী বলেছেন, --- 'রেল লাইন, লেভেল ক্রশিং, ইঞ্জিনের শান্তিং, কয়লার ধোঁয়া, রেল কারখানা, শ্রমিক আন্দোলন, রেলকুঠি - এসবই তো অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে ছিল আমাদের প্রত্যুষের জীবনের সঙ্গে।.....কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতবর্ষে আধুনিক সভ্যতার তথা আধুনিক শিল্পোদ্যোগেরও শুরু রেলকে কেন্দ্র করেই। সেদিন ভারতবর্ষ নিশ্চয়ই রাতারাতি বদলে যাচ্ছিল।.....রেল দূরের মানুষকে কাছে নিয়ে এল, ভারতের নানা প্রদেশ পরস্পরকে চিনলো, কর্মজীবনে একত্রিত হল, পরস্পরকে বুঝতে শিখলো, রেল তো বিপ্লবও, সামাজিক বিপ্লব।.....অস্পৃশ্যতা আজও আছে, কিন্তু এক ধাক্কায় এই যন্ত্রদানব তার ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রাহ্মণ আর হরিজন রেলের কামরায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসতে বাধ্য হ'ল। সঙ্গে সঙ্গে এলো স্বাধীনতার আকাঙ্খা।.....রেলের জীবনে তো সে এক প্রথম প্রহর।'
          এই রেল শহরকে কেন্দ্রকরেই যাবতীয় কাহিনি-ঘটনা চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত। এই রেল শহরে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নানা ভাষা, নানা মত, নানা সংস্কৃতি, নানা পরিধান মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে। রেল শহর বাস্তবিকই হয়ে উঠেছে আধুনিকতার প্রথম প্রহর। এই রেল শহরের মধ্যেই তিমু খুঁজে পেয়েছে আধুনিক ভারতবর্ষের মুখ। তিমুর মধ্য দিয়ে রমাপদ জীবনদর্শনই প্রতিফলিত হয়েছে।
         
          অধ্যাপক অমিতাভ চক্রবর্তী বলেছেন, --- 'মূল কাহিনির সূত্রপাত তিমুর প্রথম স্কুলে ভর্তির সময় থেকে। ধরা যেতে পারে সেটা ১৯২৭-২৮ খ্রিস্টাব্দ। উপন্যাসের সময়সীমা তিমুর বয়ঃসন্ধির কাল পর্যন্ত। অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। এই সময় ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ক্রমশ দানা বাঁধছে। গান্ধিজির দ্বিতীয় অসহযোগ আন্দোলন, স্বরাজ না পূর্ণ স্বাধীনতা এই বিতর্ক, মুসলিমলিগের উত্থান, বিয়াল্লিশের ভারত ছাড়ো আন্দোলন। এই আবহে রেল শহরের সমাজ জীবনেও গভীর আলোড়ন। একদিকে ভাঙন, একদিকে নির্মাণ। বদলে যা যাচ্ছে পুরনো ছবি, তার জায়গায় নিচ্ছে নতুন চিত্রপট। বেহাগের পরেই আশাবরী, এই আবহে কাটছে তিমুর শৈশব, কৈশোর। তিমুর চোখ দিয়েই রেল শহরের আদ্যোপান্ত হাওয়া বদলের সমাচার শুনিয়েছেন লেখক।'

¤ 'এখনই' (১৯৬৯) উপন্যাস :-
লেখক জন্মগ্রহণ করে খড়গপুরে। কলেজে পড়ার সময় কলকাতার সঙ্গে যোগস্থাপিত হয়। তার পর চল্লিশের দশক থেকে কলকাতার বাসিন্দা হয়ে ওঠেন। তখনকার কথা জানাতে গিয়ে 'ঋষি দস্যু এক কিশোর বালক' প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, --- 'সে সব দিনের কথা ভোলা যায় না। তখনকার জীবনতো গল্পের মতো ছিল না, দিনে দিনে তখন দিন বদলাচ্ছে ; নাটক ঘটে চলেছে সারা দেশের বুকে, সমাজে, মানুষের মনের মধ্যে। খবরের কাগজে তখন বড়ো বড়ো হরফে যুদ্ধের খবর, বোমা, ইভাকুয়েশন, বিয়াল্লিশ, মন্বন্তর, একটার পর একটা।'

               উপন্যাসটি রচনার পটভূমির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লেখক জানিয়েছেন, '১৯৪৭-এ দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর 'এখনই' উপন্যাস লিখেছিলাম ১৯৬৮-তে।ঠিক একুশ বছর বয়েস তখন স্বাধীনতার এবং স্বাধীনতার মুহূর্তে যাদের জন্ম তাদের বয়েসও তখন একুশ। এই একুশ বাইশের তরুণ তরুণীরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের অবশ্যই। তারাই তো তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে দেখা দিয়েছে। তাদের মধ্যে দু-একজন টিকুলও। এখন মনে হয় এই একুশ বাইশের নতুন প্রজন্মের সঙ্গে কি 'এখনই' উপন্যাস লেখার কোনো সম্পর্ক ছিল?'
               লেখক জানিয়েছেন, --- 'আমার চোখে অনেক বেশি তাৎপর্যময় মনে হয়েছিল যুবক সমাজের খোলা হাওয়ার স্বাভাবিকতা যা সকলকে নাড়া দিয়ে গেল, আমূল বদলে দিয়ে গেল সমাজের চেহারাটাই।.....এরও প্রায় সিকি শতাব্দী আসা আমিও তো বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলাম, ছাত্রীরা সংখ্যায় কম ছিল না, তবু আড়ষ্টতা ছিল উভয় পক্ষেই, আলাপ মানেই প্রেমালাপ কিনা সন্দেহ, অধ্যাপকদের পিছনে পিছনে ঘাড় হেঁট করে ঢুকত মেয়েরা, অধ্যাপকদের পিছনে পিছনে দ্রুত নিজেদের কমনরুমে পৌঁছে গিয়ে যেন নিশ্চিত - ব্যতিক্রম ছিল তা নয়, কিন্তু এটাই সে যুগের প্রকৃত ছবি। অথচ আটষট্টির এই ছেলেরা আর এই মেয়েরা মনে হল একেবারেই অচেনা।'
                 
               অধ্যাপক বিনয় ঘোষ জানিয়েছেন, --- 'They were not angry young men. They want to find their in society as good and respectable citizens, to be a good husband, a good father and a good friend and neighbour'. শহুরে জীবনযাত্রা, বিচ্ছিন্নতা, একাকীত্ব এই প্রজন্মের মনে জন্ম দিয়েছে হতাশা।

               'এখনই' উপন্যাসে লেখক জানিয়েছেন, --- 'সুখের লোভে, হারানো ভয়ে। শুধু মানিয়ে চলা, মেনে নেওয়া। সেটাই বোধ হয় এযুগের ট্র্যাজেডি।' উপন্যাসে অরুণ ঊর্মির কাহিনি কিংবা বিরাম-নন্দিনী-টিকলুর কাহিনি একই ভাবব্যক্ত করেছে।

¤ গল্পগ্রন্থ ও গল্প সংকলন :-
'গল্প লেখার গল্প'-তে রমাপদ চৌধুরী জানিয়েছেন, --- 'ছোটবেলায় গল্প শুনতে শুনতে প্রথম যেদিন বক্তা চুপ করে যাওয়ায় আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তারপর? --- সেদিনই মনের পাতায় প্রথম গল্প উঁকি মেরেছিল।' সতেরো বছর বয়সে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তাঁর প্রথম গল্প 'ট্র্যাজেডি' প্রকাশিত হয়। তাঁর কয়েকটি গল্পগ্রন্থ ও গল্প সংকলন হল :-
১) 'তিনতারা' (১৯৮৪)
২) 'স্বর্ণমারীচ' (১৯৫০)
৩) 'অভিসার রঙ্গনটী' (১৯৫১)
৪) 'দরবারী' (১৯৫৪)
৫) 'পিয়াপসন্দ' (১৯৫৫)
৬) 'আপন প্রিয়' (১৯৫৭)
৭) 'কখনো আসে নি' (১৯৫৮)
৮) 'কথাকলি' (১৯৫৯)
৯) 'মুক্তবন্ধ' (১৯৫৯)
১০) 'চন্দন কুঙ্কুম' (১৯৬১)
১১) 'দেহলী দিগন্ত' (১৯৬২)
১২) 'যদিও সন্ধ্যা' (১৯৬৩)
১৩) 'সুখের পায়রা' (১৯৬৬)
১৪) 'রুমাবাঈ' (১৯৬৬)
১৫) 'লজ্জাবতী' (১৯৬৬)
১৬) 'ত্রয়োদশী' (১৯৬৭)
১৭) 'ভারতবর্ষ এবং অন্যান্য গল্প' (১৯৬৯)
১৮) 'দিনকাল' (১৯৭১)
১৯) 'স্বর্ণলতার প্রেমপত্র' (১৯৭৩)
২০) 'আমরা সবাই একসঙ্গে' (১৯৭৩)
২১) 'পোস্টমর্টেম' (১৯৮২)
২২) 'ঝুমরা বিবির মেলা'

¤ ছোটগল্প সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য :-
'দরবারী' গল্পের জোনাথন ও শোনিয়ার অকাল মৃত্যু লেখকের ভাষায় 'সমন্বয় স্বপ্নের মৃত্যু'। জোনাথন ভারতে এসে মুণ্ডা তরুণী শোনিয়াকে বিয়ে করেছিল, কিন্তু জোনাথনের ছেলে ম্যাক ইভাকে বিয়ে করতে চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। সেখান থেকে বিদ্রোহ, বিদ্রোহ থেকে তাদের মৃত্যু গল্পটিকে স্মরণীয় করেছে। 'ভারতবর্ষ' গল্পে এসেছে যুদ্ধ, দাঙ্গা, মানুষের অবস্থার চিত্র। যুদ্ধের পটভূমিকায় স্মৃতি উঠে এসেছে 'করুণ কন্যা', 'অঙ্গপালী' প্রভৃতি গল্পে। 'তিতির কান্নার মাঠ' গল্পে এসেছে অসীমেন্দু ও অরুণিমার অতীত জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দিনগুলি।

¤ প্রবন্ধগ্রন্থ :-
তিনি বেশি প্রবন্ধগ্রন্থের রচনা করেননি। তাঁর কয়েকটি প্রবন্ধগ্রন্থ হল :-
১) 'আমরা সবাই'
২) 'রূপযানী'

¤ আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ :-
তিনি তাঁর কয়েকটি গ্রন্থে নিজের জীবনের নানান কাহিনী তুলে ধরেছেন, সেগুলি হল :-
১) 'হারানো খাতা'
২) 'জীবনের স্মৃতিলেখা'

¤ স্মৃতিকথা :-
তিনি তাঁর যে গ্রন্থে স্মৃতিচারণা করেছেন, সেটি হল :-
'লেখালেখি'।

¤ উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রায়িত বই :-
১) 'বনপালাশির পদাবলী' (১৯৬২) উপন্যাস।
২) 'এখনই' (১৯৬৯) উপন্যাস।
৩) 'খারিজ' (১৯৭৪) উপন্যাস।
৪) 'একদিন অচানক'।
৫) 'সুন্দরী'।

¤ পত্রিকা সম্পাদনা :-
১) তিনি 'আনন্দবাজার পত্রিকা'র রবিবারের 'রবিবাসয়িকি'র সম্পাদক ছিলেন।
২) তিনি 'ইদানিং' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
৩) তিনি 'রমাপদ চৌধুরীর পত্রিকা'-এর সম্পাদক ছিলেন।

¤ সম্পাদিত গ্রন্থ :-
তিনি কয়েকটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন, সেগুলি হল :-
১) 'অচেনা এই কলকাতা' – 'সংবাদ' (প্রকাশিত হয়েছে)।
২) 'প্রেম' – 'সংবাদ' (প্রকাশিত হয়েছে)।

¤ ছোটগল্প, গল্পগ্রন্থ, ছোটগল্প সংকলন, উপন্যাস, প্রবন্ধ / গ্রন্থতালিকা :-

  * গ্রন্থতালিকা --- কোথা থেকে প্রকাশিত হয়েছে *
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

'অভিমন্যু' - 'আনন্দ'
'অরণ্য আদিম' – 'ডি এম লাইব্রেরী'
'অংশ' – 'আনন্দ'
'অহঙ্কার' – 'আনন্দ'
'অ্যালবামে কয়েকটি ছবি' - 'আনন্দ'


'আকাশ প্রদীপ' - 'আনন্দ'
'আজীবন' – 'আনন্দ'
'আপন প্রিয়' (গল্প সংকলন) – 'ত্রিবেণী প্রকাশন'
'আমরা সবাই' (প্রবন্ধ) – 'শৈব্যা'
'আমরা সবাই একসঙ্গে' (গল্প সংকলন) – 'রামায়ণী প্রকাশ ভবন'
'আরো একজন' - 'ডি এম লাইব্রেরী'
'আশ্রয়' - 'আনন্দ'
'আস্থা' - 'করুণা'


'উপন্যাস সমগ্র ১' – ('খারিজ', 'লজ্জা', 'হৃদয়', 'বীজ', 'যে যেখানে দাঁড়িয়ে', 'পরাজিত সম্রাট') - 'আনন্দ'।
'উপন্যাস সমগ্র ২' – ('প্রথম প্রহর', 'দ্বীপের নাম টিয়ারঙ', 'পিকনিক', 'স্বজন', 'অ্যালবামে কয়েকটি ছবি') - 'আনন্দ'।
'উপন্যাস সমগ্র ৩' – ('এখনই', 'অভিমন্যু', 'রূপ', 'চড়াই', 'শেষের সীমানা', 'আরো একজন') - 'আনন্দ'।
'উপন্যাস সমগ্র ৪' – ('বনপলাশির পদাবলী', 'ছাদ', 'বাহিরি', 'দাগ', 'আশ্রয়') - 'আনন্দ'।
'উপন্যাস সমগ্র ৫' – ('লালবাঈ', 'এই পৃথিবী পান্থনিবাস', 'আকাশপ্রদীপ', 'রাজস্ব', 'ডুবসাঁতার') - 'আনন্দ'
'উপন্যাস সমগ্র ৬' – ('বাড়ি বদলে যায়', 'স্বার্থ', 'সাদা দেওয়াল', 'পাওয়া', 'অহঙ্কার', 'জৈব') - 'আনন্দ'।


'এই পৃথিবী পান্থনিবাস' – 'ডি এম লাইব্রেরী'
'এখনই' – 'ডি এম লাইব্রেরী'


'কখনও আসেনি' (গল্প সংকলন) - 'ক্যালকাটা' পাবলিশার্স
'কথাকলি' (গল্পগ্রন্থ)
'কৈশোর যৌবন' – 'স্যাঙ্গুইন'


'খারিজ'– 'আনন্দ'


'গদ্যসংগ্রহ' – 'এবং মুশায়েরা'
'গল্পসমগ্র' – 'আনন্দ'


'চন্দন কুঙ্কুম' (গল্পগ্রন্থ)
'চড়াই' – 'দে’জ'
'চার দেওয়াল' – 'করুণা'


'ছাদ' – 'আনন্দ'


'জনৈক নায়কের জন্মান্তর' – 'ডি এম লাইব্রেরী'
'জৈব' – 'আনন্দ'


'ঝুমরা বিবির মেলা' (গল্প সংকলন) - 'সত্যব্রত লাইব্রেরী'


'ডুব সাঁতার' – 'আনন্দ'


'তিনকাল' – 'আনন্দ'


'দরবারী' – 'ক্যালকাটা পাবলিশার্স'
'দশটি উপন্যাস' –('অংশ', 'তিনকাল', 'আজীবন', 'বেঁচে থাকা', 'একা একজীবন', 'আলো আঁধার', 'অরণ্য আদিম', 'অন্বেষণ', 'জনৈক নায়কের জন্মান্তর', 'দ্বিতীয়া') - 'আনন্দ'
'দাগ' - 'আনন্দ'
'দুটি চোখ দুটি মন' - 'ত্রিবেণী ডি এম লাইব্রেরী'
'দ্বিতীয়া' – 'দে’জ'
'দ্বীপের নাম টিয়ারঙ' – 'আভেনির'
'দেহলি দিগন্ত' (গল্প সংকলন) – 'গ্রন্থপ্রকাশ'


'নীল নিঃশব্দ' - 'করুণা'


'পরাজিত সম্রাট' - 'আনন্দ'
'পশ্চাৎপট' – 'আনন্দ'
'পিকনিক' - 'আনন্দ'
'পিয়াপসন্দ' (গল্প সংকলন) – 'বেঙ্গল পাবলিশার্স'
'প্রথম প্রহর' – 'ডি এম লাইব্রেরী'
'পাওয়া' – 'করুণা' / 'আনন্দ'
'পোস্টমর্টেম' - 'সংবাদ'


'বনপলাশীর পদাবলী' - 'আনন্দ'
'বাড়ি বদলে যায়' – 'সাহিত্য কুটীর' / 'আনন্দ'
'বাহিরি' – 'আনন্দ পাবলিশার্স'
'বীজ' - 'আনন্দ'
'বেঁচে থাকা' – 'আনন্দ'


'ভারতবর্ষ ও অন্যান্য গল্প' – 'ডি এম লাইব্রেরী'


'মানুষের সংসার' – 'আনন্দ'
'মুক্তবন্ধ' (গল্প সংকলন) – 'বেঙ্গল পাবলিশার্স'


'যে যেখানে দাঁড়িয়ে' – 'আনন্দ'


'রাজস্ব' – 'আনন্দ'
'রূপ' – 'আনন্দ'
'রূপযানী' (প্রবন্ধ)


'লজ্জা' - 'আনন্দ'
'লালবাঈ' – 'ডি এম লাইব্রেরী' / 'আনন্দ'
'লেখালেখি' (স্মৃতিলেখা)


'শেষের সীমানা' – 'আনন্দ'


'সব গল্পই প্রেম' – (সহ লেখক-সিদ্ধার্থ সিংহ) - 'প্রিয়া বুক হাউস'
'সাদা দেয়াল' – 'আনন্দ'
'সীমন্তির স্বপ্ন' - 'বিশ্ববাণী'
'সুখদুঃখ' – 'আনন্দ'
স্বজন – 'তুলি কলম' / 'দে’জ'
'স্বার্থ' – 'আনন্দ'


'হৃদয়' - 'আনন্দ'
'হারানো খাতা' – 'আনন্দ'

রমাপদ চৌধুরী ও সিদ্ধার্থ সিংহ যুগ্মভাবে
'সব গল্পই প্রেম' – 'প্রিয়া বুক হাউস'

রমাপদ চৌধুরী ও সুধীর মৈত্র যুগ্মভাবে
'ভূতগুলো সব গেল কোথায়' - 'আনন্দ'

¤ গল্প-উপন্যাসের বিষয়বস্তু :-
ইতিমধ্যে তিনি দেখছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের করুণ কঠিন দৃশ্য, যুদ্ধের পরের দাঙ্গা, দেশ বিভাগের ফলে বসতভিটা ফেলে অশ্রুসজল চোখে মানুষের চলে যাওয়া, চোখের জলে তাদের বিদায় দিতে দিতে চোখের সীমানায় উদ্বাস্তু, বাস্তুত্যাগী মানুষের আগমন। ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কলকাতার বুকে মন্বন্তরের বীভৎষ্যতা। স্বাধীনতার প্রাপ্তির উচ্ছ্বাস আর অসারতা। এর মধ্যে দিয়ে লতিয়ে উঠছে গণবিক্ষোভ, বামপন্থী রাজনীতির উত্থান। ঘটছে মধ্যবিত্তের বিকাশ। সমাজে মধ্যবিত্তের মানসিকতার প্রভাব-দোলাচল, অনিশ্চয়তা, হতাশা, প্রতারণা ইত্যাদি দেখা যায়। এসব কিছু গল্পকার রমাপদ চৌধুরীর মানসভূমে সাহিত্যের ভাষা ও বিষয়বস্তু তৈরি করছিল নিশ্চয়ই। তাঁর গল্প-উপন্যাসে এসব এসেছে বিভিন্ন ভাবে। কখনও সরাসরি, কখনও প্রতিক্রিয়া হিসেবে। তবে তাঁর গল্পে একটি যুগযন্ত্রণা প্রকাশ পায়। যে কারণে তিনি বিভিন্ন ভাবে সমাজের কপটতাতে আঘাত করেন। বিষয়বস্তু নির্বাচন করেন সে ভাবেই। গল্প দিয়েই রমাপদ চৌধুরীর সাহিত্য যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে তিনি সার্থক উপন্যাসও রচনা করেছেন একাধিক। তবে উপন্যাস ও গল্পের বিষয়বস্তু আলাদা। তিনি খুব সচেতন হিসেবে এর প্রকরণ করে থাকেন। ঔপন্যাসিকের কাছে গল্পকারের দৃষ্টিভঙ্গির কৃতিত্ব কোথায় তাও তিনি নির্ণয় করেছেন। তিনি একটি মহাযুদ্ধের দৃশ্যকল্প সামনে এনে বুঝিয়ে দেন সেই কৃতিত্ব। যুদ্ধের বিশাল-বিরাট আয়োজন, পুঙ্খানুপুঙ্খু বর্ণনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা ঔপন্যাসিকের কাজ। এখানে গল্পকারের কৃতিত্ব কোথায়?

             রমাপদ চৌধুরী লেখেন, --- ‘হঠাৎ তিনি ছোটগল্প-লেখককে দেখতে পাবেন বনের ধারে, একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে। এ কোন্ উন্নাসিক লেখক?-মনে মনে ভাবলেন ঔপন্যাসিক। কোনো মিনারের চূড়ায় উঠলো না দেখলো না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিলো না, এ কেমন ধারা সাহিত্যিক! হয়তো এমন কথা বলবেনও তিনি ছোটগল্প-লেখককে। আর তখন, অত্যন্ত দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ চেয়ে তাকাবেন ছোটগল্পের লেখক, বলবেন হয়তো, না বন্ধু, এ সব কিছুই আমি দেখিনি। কিছুই আমার দেখার নেই। শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। বনের ওপারে কোনো গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন তিনি, সেখানে একটি নারীর শঙ্কাকাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্ন তন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে, চোখের কোণে যার হতাশার বিন্দু ফুটে উঠেছে --- কে যেন ফেরেনি, কে একজন ফেরেনি। ছোটগল্পের লেখক সেই ব্যথাবিন্দুর, চোখের টলোমলো অশ্রুর ভেতর সমগ্র যুদ্ধের ছবি দেখতে পাবেন, বলবেন হয়তো, বন্ধু হে, ঐ অশ্রুবিন্দুর মধ্যেই আমার অনন্ত সিন্ধু।’('ভূমিকা'/রমাপদ চৌধুরী - 'গল্পসমগ্র')

¤ একসঙ্গে উপন্যাস ও ছোটগল্প সম্পর্কিত তথ্য :-


এখন ৯৬ বছর। রমাপদ চৌধুরী রয়েছেন। সুস্থ আছেন। রমাপদ চৌধুরী না লিখেই লেখক। ঠিক এই কথাটাই শুনতাম সেই ৩২ বছর আগে। তখন তিনি ষাট উত্তীর্ণ। বছরে একটি উপন্যাস। সেই উপন্যাস কখনো 'খারিজ', কখনো 'রূপ', কখনো 'অভিমন্যু' বা 'বাড়ি বদলে যায়'। রমাপদ চৌধুরীই একমাত্র লেখক যিনি ঘোষণা করে লেখা থামিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি কোনো সভায় যান না। টেলিভিশনে তাঁর মুখ কেঁউ দেখেছে বলে জানি না। বিদেশ ভ্রমণের আমন্ত্রণ সযত্নে ফিরিয়েছেন। তরুণ লেখকদের পছন্দ করতেন। তাঁদের সঙ্গেই মিশতেন। আমি তাঁর দুর্লভ সঙ্গ পেয়েছি এক সময়।

              রমাপদ চৌধুরীর গল্পে, উপন্যাসে, মানুষের ভিতরের হাড় কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। সত্য উন্মোচনে তিনি অতি নির্মম। 'ভারতবর্ষ' গল্পে যে মাহাতো বুড়ো ভিক্ষা প্রত্যাখ্যান করতে করতে মাথা উঁচু রেখেছিল, সেই বুড়োই শেষ পযর্ন্ত, বকশিস বকশিস বলে চিৎকার করে ওঠে। যে মাহাতো বুড়োকে নিয়ে ভারতবর্ষ তার মাথা উঁচু করে রেখেছিল, সেই মাহাতো বুড়োই গোটা দেশটাকে ভিখিরি বানিয়ে দেয়। 'পোস্ট মরটেম' গল্পে গলায় দড়ি দিয়ে মরা ধনঞ্জয়বাবুর বাড়ির সামনে যাঁরা সক্কালে এসে দাঁড়িয়েছে, তারা নিরাপত্তার বৃত্তে থাকা মধ্যবয়স্ক পুরুষ, একটু করে খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে। তাদের ভিতরে এই মৃত্যুর কারণ খোঁজায় কাজ করছে এক ধরনের তৃপ্তি। তারা বেঁচে আছে, একটি লোক আত্মহত্যা করেছে, আত্মহত্যা আসলে লুনাসি ছাড়া কিছু নয়, ব্যানার্জির কথায় সতীশবাবু না করে। আসলে কার যে কী হয়, কোথায় লাগে কেউ জানে না। এদের কথা শুনতে শুনতে একটি যুবক বলে ওঠে, আসলে কারোর তো এই অভিজ্ঞতা নেই। সেই কথায় দুজনে চমকে ওঠে। সরে যায় যুবকটির কাছ থেকে। ব্যানার্জি গিয়ে দাঁড়ায় উচ্চপদের চাকুরে সুমন্তবাবুর সামনে। সে চুরুট হাতে এসে দাঁড়িয়েছে খোঁজ নিতে। তাকে ঠিক পছন্দ করে না সতীশ। অহঙ্কারী মনে হয় মানুষটিকে। সতীশ করে সামান্য চাকরি। নিজেকে গুটিয়ে রাখে। সুমন্ত জিজ্ঞেস করে, 'কী হতে পারে, ক্যান ইউ গেস?' ব্যানার্জি বলে, মনে হয় তো সুখী পরিবার। শুনে বাধো বাধো গলায় সতীশ বলে, ওসব কিছু নয়, ওর বাড়িতে সে গেছে, গতকালও ফুটপাথে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেছে। ব্যানার্জি শুনতে শুনতে বলে, 'নো ওয়ান ইজ হ্যাপি, তাই বলে কি সবাই সুইসাইড করে বসবে?'

          তখন সেই যুবকটি বলে, ‘কে কতখানি আন-হ্যাপি তার থার্মোমিটার তো আমাদের হাতে নেই।’ যুবকটি পিছু পিছু ঘুরছে যেন, তাদের কথা শুনছে। গল্পটি এই রকম। প্রতিবশীরা নানা ভাবে আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বের করতে গিয়ে যেন যুবকটির ব্যঙ্গের মুখে পড়ে বারবার। যুবকটি যেন তাদের প্রতিপক্ষ। তারা তাকে এড়াতে সরে যায়। খুঁজতে থাকে আত্মহত্যার কারণ। তাদের কৌতূহল অপরিসীম। 'কোনো চিঠি লিখে রেখে গেছে কি ধনঞ্জয়বাবু?' একজন বলেন, তেমন কান্নাকাটি তো শোনা যাচ্ছে না। সতীশ এই কথায় ক্ষুব্ধ হয়। একজন কেউ বলে, ‘এখন ওদের কত রকম ভয়, কত রকম ঝামেলা, এখন ওকে সন্তুষ্ট করার জন্য বউটাকে ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে হবে। নুইসেন্স।’ কথা শেষ করে সে আবার বলে, ‘ধনঞ্জয়বাবুর বউ তো কান্নাকাটির পার্টি নয়, স্লিভলেস ব্লাউজ পরে।’ এই রকম কথায় কথায় গল্প এগোয়। আসলে মৃতের নয়, জীবিতের ময়নাতদন্ত হয়ে যেতে থাকে। জীবিতের হাড়-কঙ্কালের ছবি দেখাতে থাকেন লেখক। গল্প কাহিনীনির্ভর নয়। এই গল্পে একটিই ঘটনা ঘটে, তা হলো ধনঞ্জয়বাবুর আত্মহত্যা। আর কিছুই নয়। বাকিটা হৃদয়হীন প্রতিবেশীর নিষ্ঠুরতা। নিষ্ঠুরতা তাদের কৌতূহল আর মন্তব্যে ক্রমশ ফুটে উঠতে থাকে। আরো হৃদয়হীনতার দিকে এগোয়। শুধু একবার ওবাড়ির কাজের মেয়েটি বেরিয়ে তার বাচ্চাটিকে সেই জটলার মধ্যে দেখে পিঠে চাপড় দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, 'কেন এয়েছিস, যা ঘরে যা, বাবুদের মতো হুজুগ দেখতে এয়েছেন…।'


               রমাপদ চৌধুরীর একটি গল্প ‘ভারতবর্ষ’ তাঁকে চিনিয়ে দিয়েছিল তাঁর আরম্ভের দিনে, সেই অনেক  বছর আগে। খড়গপুর রেল কলোনিতে বড় হওয়া রমাপদ চৌধুরীর কাছে শুনেছি সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কথা, এই কলকাতা শহর, সেই রেল কলোনি, মার্কিন সোলজার, নিষ্প্রদীপ রাত্রির কথা। 'ভারতবর্ষ' গল্পটি একটি অখ্যাত হল্ট স্টেশন আন্ডা হল্টের কথা। সেইখানে মার্কিন সোলজারে ভর্তি ট্রেন এসে দাঁড়াত। তারা প্রাতরাশের জন্য নামত গাড়ি থেকে। আন্ডা দিয়ে ব্রেক ফাস্ট তাই আন্ডা হল্ট। কাঁটা তারের ওপারে ভারতবর্ষ। মাহাতোদের গ্রাম। তাদের খেত-খামার। ঋজু মেরুদণ্ডের মাহাতো পুরুষ রমনীরা চাষবাস আর ফসল নিয়ে বেঁচে থাকত। তাদের দুই একটা মুদ্রা দেওয়া শুরু করে সেনারা। এইভাবে মানুষগুলোকে ভিখিরি করে দেওয়ার গল্প 'ভারতবর্ষ'। অনুদান, সাহায্য যে কীভাবে একটি জনজাতি একটি দেশের মেরুদণ্ডকে বাঁকিয়ে দেয়, ভিখিরি করে দেয়, সেই গল্পই ভারতবর্ষ। সেই গল্পই বহুদিন ধরে টিকে থাকে যে গল্প সময় থেকে সময়ান্তরে গিয়েও প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকে। রমাপদ চৌধুরীর 'ভারতবর্ষ' গল্পটি তেমন।

            এই গল্পের নানা মাত্রা। দেশটা সেই যে আন্ডা হল্টের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল হাত বাড়িয়ে, সেই হাত তো নামে নি এখনো। নামবে না কখনো। উচ্ছিষ্টের লোভে মানুষ তো হাত বাড়িয়েই আছে। ভারতবর্ষ শুধু এই 'ভারতবর্ষে'র গল্প নয়, এই গল্প গোটা তৃতীয় বিশ্বের হয়ে গেছে। আমি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত গল্প ‘পোস্ট মরটেমে’র কথা বলছি। এই গল্প একটি আত্মহত্যার। সতীশবাবু নিপাট এক মধ্যবিত্ত মানুষ, সকালে শুনল প্রতিবেশী ধনঞ্জয়বাবু আত্মহত্যা করেছে। যে মানুষটির সঙ্গে গতকালও দেখা হয়েছে, দুদিন আগে দাঁড়িয়ে কথা বলেছে অনেক সময় ধরে, সেই মানুষটি গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে। আর এক প্রতিবেশী ব্যানার্জি বাবুকে ডেকে সতীশবাবু বেরোল। ধনঞ্জয়বাবুর লাল বাড়িটির সামনে স্বাভাবিক জটলা। আশপাশের কৌতূহলী মানুষজন, নানা প্রতিবেশী জড়ো হয়েছে, লোকটি কেন আত্মহত্যা করল তা খুঁজে বের করতেই যেন তার বাড়ির সামনে জটলা করা। একে অন্যকে নিজের অনুমানের কথা বলছে, মন্তব্যের উপর মন্তব্য নিয়েই এই গল্প। গল্প নয় মধ্যবিত্তের ভিতরের চেহারাটা একটু একটু করে উন্মোচন করা। একটি কঠিন মৃত্যুকে ঘিরে নানা রসের সন্ধান।

¤ পুরস্কার ও সম্মাননা :-
১) 'রবীন্দ্র পুরস্কার' (১৯৭১) - তাঁর 'এখনই' (১৯৬৯) উপন্যাসের জন্য।
২) 'সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার' (১৯৮৮) - তাঁর 'বাড়ি বদলে যায়' (১৯৮৪) উপন্যাসের জন্য।
৩) 'শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পুরস্কার ও পদক' - কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান।
৪) 'শ্রেষ্ঠকাহিনী'র জন্যও কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন।


¤ তথ্যঋণ :-
১) 'আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' - শ্রীতপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
২) 'বইবার্তা' - রমাপদ চৌধুরী।
৩) ইন্টারনেটের কয়েকটি পেজ।




★আলোচক : সৌম্য মাইতি 
(ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র, কিংসটন কলেজ, মেছেদা, পূর্ব মেদিনীপুর)

★ মডারেটর -- সাকসেস বাংলা★



Share this