নবেন্দু ঘোষ : ফিয়ার্স লেনের লেখক

♣ নবেন্দু ঘোষ : ফিয়ার্স লেনের লেখক ♣
•••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••
      (২৭ মার্চ, ১৯১৭ --- ১৫ ডিসেম্বর, ২০০৭)

তিনি হলেন একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক। যিনি অভিনেতা ও পরিচালক, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখক হিসেবেও বাংলা কথাসাহিত্য রচনায় যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

¤ জন্ম ও জন্মস্থান :-
১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মার্চ ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে (বর্তমান বাংলাদেশে) জন্মগ্রহণ করেন।

¤ পেশা :- 
ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অভিনেতা, পরিচালক, সম্পাদক, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখক।

¤ অন্যান্য নাম :-
মুকুল, নবেন্দু ভূষণ ঘোষ।

¤ পারিবারিক পরিচয় :-
তাঁর দুজন পুত্র, দীপঙ্কর ঘোষ এবং সুভঙ্কর ঘোষ, যিনি পরিচালক ছিলেন। কন্যা রত্নোত্তমা সেনগুপ্ত ছিলেন লেখক এবং 'The Times of India' পত্রিকার জার্নালিস্ট। তাঁর স্ত্রীর নাম কনকলতা ঘোষ, যাঁর মৃত্যু হয় ১৯৯৯ সালে। ভাইঝি সোমা ঘোষ ছিলেন একজন ক্লাসিক্যাল ভোকালিস্ট। যিনি ২০১৬ সালে 'পদ্মশ্রী পুরস্কার' লাভ করেন। তাঁর বড়ো নাতির নাম দেবোত্তম সেনগুপ্ত, যিনি ছিলেন লেখক।

¤ সংক্ষিপ্ত জীবন :-
মাত্র ১২ বছর বয়সে নবেন্দু ঘোষ মঞ্চের বিখ্যাত অভিনেতা হয়ে ওঠেন। তিনি উদয় শঙ্করজীর মতো রীতিতে নৃত্য করতেন। তিনি ১৯৩৯-১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অনেক পুরস্কার জিতেছেন। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে সরকারী চাকরী হারান 'ডাক দিয়ে যাই' (প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে) উপন্যাস লেখার জন্য। তিনি এই উপন্যাসে ভারতীয়দের সামাজিক গতি-প্রকৃতির (ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের) বিরুদ্ধে লিখেছিলেন। তারপর ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় চলে আসেন। তিনি নিজেকে আধুনিক যুগের একজন শক্তিশালী লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর ২৬ টি উপন্যাস এবং ১৪ টি ছোটগল্প সংকলন প্রকাশের খোঁজ মিলেছে।

¤ আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ :-
তাঁর একমাত্র আত্মজীবনী মূলক উপন্যাসটি হল :-
'একা নৌকার যাত্রী'। এটি প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালের মার্চ মাসে।

¤ স্মৃতিচারণ মূলক গ্রন্থ :-
তিনি যে গ্রন্থটিতে তাঁর জীবনের স্মৃতিচারণা করেছেন, সেটি হল :- 'স্মৃতিকথা'।

¤ উপন্যাস সম্পর্কিত তথ্যাদি :-
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে 'প্রভাতী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে উপন্যাস 'নায়ক ও লেখক' প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি গুণীজনের প্রশংসা লাভ করে। এই পত্রিকাতেই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় 'ভগ্নস্তূপ' উপন্যাস। ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পটভূমিকায় রচিত হয়েছে 'ফিয়ার্স লেন' উপন্যাস। 'ডাক দিয়ে যাই' (১৯৪৬) উপন্যাসের পটভূমি প্রসঙ্গে লেখক জানিয়েছেন --- '১৯৪২ সালের আগস্ট মাসের রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রথম দিনের কতকগুলি বিভিন্ন মতাবলম্বীদের জীবন ও কর্মকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস রচিত।'

¤ উপন্যাস :- তাঁর বেশ কয়েকটি স্মরণীয় উপন্যাস হল :-
১) 'নায়ক ও লেখক' (১৯৪০ /১৩৪৭)
২) 'ভগ্নস্তূপ'
৩) 'ফিয়ার্স লেন'
৪) 'ডাক দিয়ে যাই' (১৯৪৬ /১৩৫৩)
৫) 'পঞ্চম রাগ' (১৯৬০)
৬) 'সুখনামে শুকপাখী' (১৩৭০)
৭) 'কায়াহিনের কাহিনী' (১৩৭২)
৮) 'আমি ও আমি' (১৯৯৯)
৯) 'চাঁদ দেখেছিল' (২০০৫)
১০) 'একা নৌকার যাত্রী' (মার্চ, ২০০৮)
১১) 'বাতাসে বারুদ'
১২) 'প্রথম বসন্ত'
১৩) 'বসন্ত বাহার'
১৪) 'জীবনের স্বাদ'
১৫) 'পৃথিবী সবার'
১৬) 'কদম কদম'

¤ ছোটগল্প সম্পর্কিত তথ্যাদি :-
সমকালীন জীবন উত্তাপের স্পর্শ লেগেছে তাঁর ছোটগল্পেও। দুর্ভিক্ষ, মন্বন্তর, দাঙ্গার ছবি এসেছে 'উলুখড়', 'কান্না', 'ত্রাণকর্তা' প্রভৃতি গল্পে। বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতার দিক আছে 'পলাতক' গল্পে।

¤ ছোটগল্প সংকলন :- তাঁর উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প সংকলন হল:-
১) 'এই সীমান্তে' (১৯৪৫)
২) 'পোস্টমর্টেম' (১৯৪৬ /১৩৫৩)
৩) 'কালো রক্ত' (১৩৫৩)
৪) 'প্রান্তরের গান' (১৩৫৩)
৫) 'ইস্পাত' (১৯৪৮)
৬) 'কান্না' (১৯৫০ /১৩৫৭)
৭) 'সিঁড়ি' (১৯৫৭ /১৩৬৪)
৮) 'রাতের গাড়ী' (১৩৭০)
৯) 'গল্প সংগ্রহ' (১৩৯১)
১০) 'বিচিত্র এক প্রেমগাথা'
১১) 'পরেশ মণ্ডলের লাশ'
১২) 'শ্রেষ্ঠ গল্প'
১৩) 'দ্বীপ'
১৪) 'পাপুই দ্বীপের কাহিনী'

¤ ছোটগল্প :- তাঁর বেশ কয়েকটি স্মরণীয় ছোটগল্প হল :-
১) 'উলুখড়'
২) 'কান্না'
৩) 'ত্রাণকর্তা'
৪) 'পলাতক'
৫) 'সিঁড়ি'

¤ চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য এবং সংলাপ রচনা :-
১) 'পরিণীতা' : ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় হিন্দি ভাষার নাট্য চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন বিমল রায়। কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত পরিণীতা গল্প অবলম্বনে ছবিটির চিত্রনাট্য লিখেছেন বিমল রায়, অসিত সেন, মনি ভট্টাচার্য, নবেন্দু ঘোষ এবং সংলাপ লিখেছেন ভ্রজেন্দ্র গৌর ও নবেন্দু ঘোষ। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন অশোক কুমার, মিনা কুমারী, মনোরমা, ও নাজির হুসেন।
২) 'বিরাজ বৌ' : ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে।
৩) 'বাদবান' : ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে।
৪) 'আর পার' : ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে।
৫) 'দেবদাস' : ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে।
৬) 'ইহুদি' : ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে।
৭) 'ইনসান যাগ উঠা' : ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে।
৮) 'সুজাতা' : ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে।
৯) 'বন্দিনী' : ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে।
১০) 'তিসরি কসম' : তাঁর চিত্রনাট্য থেকে সুব্রত মিত্রের আলোকচিত্রে তৈরি রাজ কাপুর ওয়াহিদা রেহমান অভিনীত বাসু ভট্টাচার্যের ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত হিন্দি চলচ্চিত্র 'তিসরি কসম' এবং ছবিটির প্রযোজক ও গীতিকার ছিলেন শৈলেন্দ্রর।
১১) 'মাঝলি দিদি' : ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে।
১২) 'সারাফাত' : ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে।
১৩) 'লাল পাত্থর' : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে।
১৪) 'অভিমান' : ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে।
১৫) 'ঝিল কে উস পার' : ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে।
১৬) 'দো আনজানে' : ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে।
১৭) 'গঙ্গা কি সুগন্ধ' : ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে।
১৮) 'চক্রাধী' : ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে।

¤ পরিচালিত চলচ্চিত্র :-
১) 'পরিণীতা' : ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে [সহকারী পরিচালক]। এটি কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'পরিণীতা' গল্প অবলম্বনে রচিত।
২) 'তৃষাগ্নি' : ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে। এটি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহাসিক গল্প 'মরু ও শঙ্ঘ'-এর ওপর কেন্দ্র করে নির্মিত।
৩) 'নেত্রহীন সাক্ষী' : ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে।
৪) 'আনমোল রতন : অশোক কুমার' : ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে [অশোক কুমারের জীবনী নিয়ে পরিচালিত চলচ্চিত্র]।
৫) লেডকিয়া' : ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে।

¤ সম্পাদিত গ্রন্থ :-
১) '১৩৫৩-র সেরা গল্প' [গল্প সংকলন]।

¤ তাঁকে নিয়ে নির্মিত সিনেমা :-
নবেন্দুবাবুকে নিয়ে একটি আঠারো মিনিটের ছবি ‘মুকুল’, তাঁরই পুত্র শুভঙ্কর ঘোষের তৈরি।

¤ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি :-
১) 'আত্মস্মৃতি' লেখার পর নবেন্দু ঘোষ হাত দিয়েছিলেন শেষ উপন্যাসে - ‘কদম কদম’। চলে যাওয়ার আগে নবেন্দু ঘোষ সেটি সম্পূর্ণ করে তুলে দিয়ে যান কন্যা রত্নোত্তমা ঘোষের হাতে।
২) হিন্দি ছবির বিশিষ্ট অভিনেতা নাজির হোসেনের স্বাধীনতার লড়াইয়ে আজাদ হিন্দ ফৌজে জড়ানো জীবন নিয়ে এই 'কদম কদম' উপন্যাস। উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি বাংলা আকাদেমিকে সংরক্ষণের জন্যে দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রত্নোত্তমা ঘোষ।
৩) নবেন্দু ঘোষের জন্ম শতবার্ষিকীতে তাঁর বড়ো নাতি দেবোত্তম সেনগুপ্ত তাঁর "আমি ও আমি" (১৯৯৯) উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন ২০১৭ সালের ২৫ মার্চ। তিনি এই অনূদিত গ্রন্থের নাম দিয়েছেন : 'মি এন্ড' (২৫ মার্চ, ২০১৭)।

¤ মৃত্যু ও মৃত্যুস্থান :-
২০০৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর তিনি কলকাতা শহরে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর।

¤ পুরস্কার ও সম্মাননা :-
১) 'চাঁদ দেখেছিল' (২০০৫) : এই উপন্যাসের জন্য তিনি 'পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার' কর্তৃক ২০০৫ সালে 'বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার' লাভ করেন।
২) 'বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ' থেকে পেয়েছেন 'হরপ্রসাদ ঘোষ মেডেল'।
৩) 'বিভূতিভূষণ সাহিত্য অর্ঘ্য'।
৪) 'বিমল মিত্র স্মৃতি পুরস্কার'।
৫) 'অমৃতা স্মৃতি পুরস্কার'।

¤ সিনেমার জন্য বিশেষ পুরস্কার :-
১) 'দো আনজানে' : 'পৃথিবীর সেরা ছবি পুরস্কার' - পর্দার সেরা অভিনয়ের জন্য।
২) 'তিসরি কসম' : 'বি. এফ. জে. এ পুরস্কার' (১৯৬৭) - পর্দার সেরা অভিনয়ের জন্য।
৩) 'মাঝলি দিদি' : 'বি. এফ. জে. এ পুরস্কার' (১৯৬৯) - পর্দার সেরা অভিনয়ের জন্য।
৪) 'মাঝলি দিদি' : 'পর্দার সেরা অভিনয় হিসেবে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার' (১৯৬৯) - পর্দার সেরা অভিনয়ের জন্য।
৫) 'তৃষাগ্নি' : 'জাতীয় ছবি পুরস্কার' (১৯৮৮) - সেরা ছবির পরিচালকের জন্য।
৬) 'Honoris Causa পুরস্কার' (১৯৯৭) - 'ভারতের সিনেমা এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউট'-এর পক্ষ থেকে, ভারতীয় সিনেমাজগতে তাঁর চমৎকার দক্ষতার জন্য।


¤ তথ্যঋণ :- 
১) 'আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস' - শ্রীতপন কুমার চট্টোপাধ্যায়।
২) 'উইকিপিডিয়া' (English Version to Bengali Version)।


  ★আলোচক : সৌম্য মাইতি 
(ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র, কিংসটন কলেজ, মেছেদা, পূর্ব মেদিনীপুর)

★ অ্যাডমিন -- সাকসেস বাংলা★

Share this