বিংশ শতাব্দীর কয়েকজন মহিলা কবি

বিংশ শতাব্দীর কয়েকজন মহিলা কবি
••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••••

♦♦ ১) রাধারাণী দেবী (১৯০৩-১৯৮৯) ♦♦
           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রাধারাণী দেবী ১৯০৩ সালের ১০ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন কুচবিহার জেলায়। তাঁর পিতা আশুতোষ ঘোষ ছিলেন কোচবিহার প্রদেশের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। কবির কৈশোরের প্রারম্ভ পর্যন্ত কাটে কোচবিহারেই। বাড়ীতেই গৃহশিক্ষকের কাছে এবং বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। পড়াশুনায় তাঁর বিশেষ উৎসাহ ও আগ্রহ ছিল। বাল্যকাল থেকেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি, বিশেষ করে কাব্যের প্রতি তাঁর ঐকান্তিক অনুরাগ ছিল। কোচবিহারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁর কবি প্রকৃতিকে উৎসাহিত করেছিল কবিতা লেখার জন্য। কৈশোর শেষ হবার আগেই তাঁর বিয়ে দেওয়া হয় রামপুর রাজ্যের স্টেট ইঞ্জিনিয়ার সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গে। বিয়ের অল্পকাল পরেই, তাঁর বালিকা অবস্থাতেই, তাঁর স্বামীর মৃত্যু হয় ইনফ্লুয়েঞ্জায়। এই দুর্ঘটনার
পরেই পিতৃকূল ও শ্বশুরকূলের অভিভাবকেরা তাঁর পুনর্বিবাহের জন্য প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু রাধারাণী
দেবী তা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেন। দীর্ঘকাল বৈধব্য অবস্থা কাটান তাঁর শশুরবাড়ীতেই। পরে তাঁর বিয়ে হয় কবি নরেন্দ্র দেব-এর সঙ্গে। বিখ্যাত সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন এঁদের কন্যা।

                  ১৯২৩ সাল থেকে তাঁর রচনা প্রকাশিত হতে শুরু করে “ভারতবর্ষ”, “বসুমতী”, “মানসী”, “মর্ম্মবাণী” প্রভৃতি পত্র-পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। স্বনামে তিনি চারটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। যথা : (১) "লীলাকমল" (১৯২৯), (২) "সীথিমৌর" (১৯৩২), (৩) "বনবিহাগী" (১৯৩৭), (৪) "মিলনের মন্ত্রমালা" (১৯৪৪)।
                   ছোটদের জন্য তাঁর লেখা গ্রন্থ হল - "গল্পের আলপনা" (১৯৫৫)। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ হল : "শরৎচন্দ্র মানুষ ও শিল্প"। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং প্রমথ চৌধুরীর তিনি ছিলেন খুব স্নেহের পাত্রী। শরৎচন্দ্রের অসম্পূর্ণ উপন্যাস "শেষের পরিচয়" (১৯৩৯) তিনি সম্পূর্ণ করেন।
                      "অপরাজিত দেবী" ছদ্মনামে তিনি চারটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "লীলাকমল" প্রকাশিত হলে স্বর্ণকুমারী দেবীর বাসায় মহিলা সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রমথ চৌধুরী বললেন, "মেয়েদের কোনো নিজস্ব ভাষা নেই, নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি নেই, তারা শুধু পুরুষের অনুকরণে লেখে।" এই কথায় রাধারাণী দেবী খুব ব্যথা পেলেন। তারপর প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি পুরুষদের কাছে পরাজয় বরণ করবেন না। শুরু হল নতুন সাহিত্য জীবন। পুরনো নাম ফেলে দিয়ে নতুন নাম গ্রহণ করলেন অপরাজিতা দেবী। তেরো বছর বয়সে বিধবা হয়েছিলেন। সাতাশ বছর বয়সে কবি নরেন্দ্রনাথকে বিবাহ করেন। রাধারাণী জীবন বদলালেন, সাহিত্যের ধ্যান-ধারণা বদলালেন।

                    কবি সমালোচক আনন্দ বাগচী "অপরাজিতা রাধারাণী দেবী" প্রবন্ধে লিখেছেন, "দৃষ্টিকোণ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বিষয় কল্পনা, আঙ্গিক এবং কৌতুক কটাক্ষ ভাষা ও ছন্দের নতুন চাল বাংলা সাহিত্যে এক নতুন স্বাদের চমক এনে দিল। কাল্পনিক অপরাজিতা চরিত্রের নিপুণ অভিনয় ভালোই জমেছে সেদিন।.....বস্তুত বাংলা সাহিত্যে ছদ্মবেশী নারীর বিদ্রোহের সূচনা, এদেশে ফেমিনিস্ট আন্দোলনের মুখবন্ধ তিনিই রচনা করে গিয়েছিলেন.....।"
                      অপরাজিতা দেবী ছদ্মনামে তিনি চারটি কাব্যগ্রন্থে তিপান্নটি কবিতা রচনা করেছেন, : (১) "বুকের বীণা" (১৯৩০), (২) "আঙিনার ফুল" (১৯৩৪), (৩) "পুরুবাসিনী" (১৯৩৫), (৪) "বিচিত্ররূপিণী" (১৯৩৭)।
                      শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অপরাজিতা দেবীর কবিতাগুলিকে অশ্লীল বললেও, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রমথ চৌধুরী প্রশংসা করেছেন। তাঁর লেখিকা হবার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, --- "সাহিত্যে ঠিক দেখতে পাওয়া, ঠিক বলতে পারা আর ঠিক জায়গায় থামা-তিনটে জিনিসই সমান কঠিন। থামার ব্যাপারটা আমি শিখেছি প্রমথ চৌধুরী আর শরৎচন্দ্রের কাছ থেকে।" রাধারাণী দেবীর কবিতার কিছু অংশ ---
     "জাগো ভুঁইচাপা সিক্ত সবুজ ঘাসে
     করতালি দিয়ে পাগলা বাতাস হাসে।" ("কেতকী")

                 রাধারাণী দেবীর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা হল : (১) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের "লীলা পুরস্কার", (২) "ভুবনমোহিনী পদক", (৩) "রবীন্দ্র পুরস্কার" পেয়েছেন ১৯৮৬ সালে "অপরাজিতা রচনাবলী" গ্রন্থের জন্য।
                তিনি ১৯৮৯ সালের ০৯ সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন।

♦♦ ২) কবিতা সিংহ (১৯৩১-১৯৯৮) ♦♦
           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কবিতা সিংহ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ অক্টোবর কলকাতার ভবানীপুরে। মা অন্নপূর্ণা সিংহের অনুপ্রেরণাতে কৈশোরেই তাঁর কবিতা লেখা আর ছবি অাঁকতে শেখা। তিনি ছিলেন একজন বাঙ্গালী কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। জীবিকাসূত্রে তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা সাংবাদিক।
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সহপাঠী বিমল রায় চৌধুরীকে বিয়ে করেন কবিতা। বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে সক্রিয় এই কবি-সাংবাদিক ছিলেন আধুনিক কর্মজীবী সৃজনশীল নারীর মডেল। তিনি কখনো কখনো ছদ্মনাম "সুলতানা চৌধুরী" ব্যবহার করেছেন। তিনি ছিলেন একজন নারীবাদী লেখিকা। তিনি আকাশবাণীর "শ্রবণী' অনুষ্ঠানের প্রোডিউসার হিসেবে কাজ করেছেন।
              ১৯৪৬ সালে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তাঁর সম্পর্কে সমালোচকেরা বলেছেন, "তাঁর চিন্তা-চেতনা, জীবন দর্শন এবং ভাবনাভঙ্গী সমসময়ের থেকে অনেকখানি এগিয়ে ছিল। তাঁর স্বরে ও বক্তব্যে প্রতিধ্বনিত হতো সুগভীর আত্মপ্রত্যয়। সমাজের একপার্শ্বিকতাকে ভেঙে তিনি নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন ব্যক্ত করেছেন। তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে আত্ম-অন্বেষণের প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।"
             কবিতা সিংহ নারী স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন করেছেন, কবিতা লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "সহজ সুন্দরী" (১৯৬৫), (২) "কবিতা পরমেশ্বরী" (১৯৭৬), (৩) "হরিণাবৈরী" (১৯৮৫), (৪) "বিমল হাওয়ার হাত ধরে" ইত্যাদি।
             অধ্যাপিকা ও লেখিকা মঞ্জুশ্রী সেন সান্যাল "কবিতা সিংহের কবিতা" প্রবন্ধে লিখেছেন, --- "পঞ্চাশের দশকে নারী মাধুর্যের মোহাঞ্জন মুছে ফেলে সত্যেরপরাক্রমী উচ্চারণে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে দৃঢ় দ্রোহ নিয়ে কবিতার মঞ্চে যিনি আলোড়ন সৃষ্টি করলেন তিনিই কবিতা সিংহ। তাঁর এই প্রতিবাদমুখর কণ্ঠস্বর সেই যুগের কাব্যভূমিতে ছিল এক ব্যতিক্রমী নিদর্শন। তিনিই সেই প্রথমা যিনি পুরুষসর্বস্ব জগৎকে প্রত্যাখ্যান করে গড়ে তুললেন এক ঈপ্সিত জগতের বিকল্প ছবি, সমাজনির্দিষ্ট কোনো আদর্শায়িত ভূমিকার বাইরে দাঁড়িয়ে তৈরি করেন নারীর এক নিজস্ব সমৃদ্ধ কারা-ভুবন।" ("কবি সম্মেলন")।
                 "নারীর যন্ত্রণার চিত্র" তাঁর কবিতায় আমরা বারে বারে পাই, ---
      "তুমি কি জানবে নারী কিভাবে শরীরে তার
      ঘোরায় সিন্দুর স্রোত, রক্তগুঁড়া-রজস্বলা দিন?
       নিখুঁত বানায়ে ভাঙে, নিজেদের সৃজিত প্রাণ
       নিজ অভ্যন্তরে।
       তুমি কি জানবে নারী আপনার সঙ্গে অঙ্গে কত
       সম্মানিত!" ("ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা হলে / কবিতা
                                                            পরমেশ্বরী")

        কবিতা সিংহের কবিতায় প্রতিবাদী মেয়ের কণ্ঠস্বর বারে বারেই ধ্বনিত হয়। কবিতা সিংহের কবিতায় শোনা যায় সমাজের নানাধরনের পীড়নের বিরুদ্ধে স্বর। যেমন – দলিত সত্তার প্রতি অবিচারের প্রতিস্পর্ধী স্বর, যৌনতার রাজনীতি-অভিসন্ধির প্রত্যুত্তর, শ্রেণিবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বর। সমাজের নারী-পুরষের বৈষম্যের বিপক্ষে প্রতিবাদ স্পষ্টভাবে বলতে পারেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি দেখান – দলিত সমাজের মেয়েদের কীভাবে পুরুষদের থেকে দ্বিগুণ বেশি যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। শ্রেণি এবং লিঙ্গ – দুটি পরিচয়ই তাদের রক্তমজ্জায় সঞ্চারিত করে দেয় অশৌচ, জীবনের সহজ, স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তারা। তাদের চাওয়া-পাওয়া – সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা। তারা বোঝে – "নিজের আজন্ম পাপ জন্ম অস্পৃশ্যতা।"

          কণ্যা ভ্রূণ নষ্ট করা নিয়েও তিনি প্রতিবাদ জানান। তিনি লেখেন, ---
“আমরা ভ্রূণ না ভ্রূণা / জন্ম দিও না মা / মা আমার জেনে শুনে কখনো উদরে / ধরো না এ বৃথা মাংস“

         কবিতা সিংহের কবিতায় প্রতিবাদী মেয়ের কণ্ঠস্বর বারে বারে খুঁজে পাই। পুরুষের পাশে "নিশ্চিত পুতুল" প্রতিমা হওয়াকে তিনি ঘৃণা করেছেন। আধুনিক যান্ত্রিক সময়ের আর্তনাদ আমরা শুনেছি "হরিণাবৈরী" কবিতায়, যার উৎস চর্যাকার ভুসুক পাদের বিখ্যাত পঙক্তি --- "আপনা মাসে হরিণাবৈরী। হরিণীর মাংস ত্বক মাংসের ঋণ।" এক এক দশকের ব্যবধানে কবিতার কাব্য প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৬৫ সালে "সহজ সুন্দরী", ১৯৭৬ সালে "কবিতা পরমেশ্বরী", ১৯৮৫ সালে "হরিণাবৈরী", নব্বই-এর দশকের শেষপ্রান্তে শেষ কাব্যগ্রন্থ "বিমল হাওয়ার হাত ধরে" প্রকাশিত হয়েছে। নবনীতা দেবসেন, --- "কবিতা সিংহ যে সকল দিক থেকে একমেবদ্বিতীয়ম, বাংলা সাহিত্যে তাঁর কোনো তুলনা নেই। আজকের নারীবাদিনীদের চেয়ে অনেক ক্লেশ বেশি পথ হাঁটতে হয়েছিল তাঁকে। আর এগিয়ে ছিলেন যোজন যোজন বেশি।" ("একান্তর" --- জানুয়ারি, ১৯৯৯)।
         এই মহান কবি ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন।
 
♦♦ ৩) সাধনা মুখোপাধ্যায় (১৯৩৪ ---) ♦
         ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কবি সাধনা মুখোপাধ্যায় ১৯৩৮ সালের ০৬ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এলাহাবাদে। পেশায় সাংবাদিক, তিনি কবিতা ছাড়াও ভূগোল, রান্নার বই ও শিশুসাহিত্য লিখেও খ্যাতি লাভ করেছেন।

        রোমান্টিক জীবনদৃষ্টি সাধনার কবিতার মূল সম্পদ। বাস্তবে না বলতে পারা কথাকে তিনি কবিতায় বলেছেন একান্তে মৃদু বাচনভঙ্গিতে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "আকাশে কন্যা" (১৯৫৯), (২) "তুমি আর আমি" (১৯৬৫), (৩) "দোপাটির ইচ্ছে" (১৯৭০), (৪) "কুন্দকদলী কৃষ্ণচূড়া" (১৯৭১), (৫) "একদা রাজধানী" (১৯৭২), (৬)"কবিতার আদালত" (১৯৭৩), (৭) "প্রত্যুষের ফুল" (১৯৭৪), (৮) "রমণী গোলাপ" (১৯৭৫), (৯) "ছুঁই মুই লজ্জাবতী" (১৯৮৪), (১০) "ক্যাপ্টেনের স্ত্রীর রবীন্দ্র সংগীত" (১৯৮৬), (১১) "চাঁপার সিন্দুক" (১৯৯০) ইত্যাদি।

      অন্তর জীবনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ---
       "মুখের কন্দরই যার অজস্র পদ্মফুল
       বুক তার কিসের তুলনা
       কুঞ্চিত রেশম রোমে গোপনীয় যে কামনা
       উত্তেজনা
       লিখতে লেখনী কাঁপে
       অপাঙ্গের বর্ণনায় ভাষা অকুলনা" ("দেহ-ফুল")

♦♦ ৪) বিজয়া মুখোপাধ্যায় (১৯৩৭ ---) ♦
          ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
বিজয়া মুখোপাধ্যায় বাঙালি কবি এবং লেখিকা।তিনি জন্মগ্রহণ করেন ১১ মার্চ ১৯৩৭ সালে ঢাকায়।
কবি একজন সংস্কৃত ভাষার স্কলার। এ বিষয়ে তাঁর খ্যাতি এতটাই ছিল যে কবি বুদ্ধদেব বসু তাঁর
"মহাভারতের কথা" লিখবার সময়ে, বিষয় অনুধাবন করার সুবিধের জন্য তাঁর কাছেই সংস্কৃত ভাষা
শিখিয়ে দেবার কথা বলেছিলেন।
                     অধ্যাপিকা বিজয়া মুখোপাধ্যায় কবি শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী। তিনি ছিলেন "বিভাষা" পত্রিকার সম্পাদিকা। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "আমার প্রভুর জন্য" (১৯৬৭), (২) "যদি শর্তহীন" (১৯৭১), (৩) "ভেঙে যায় অনন্ত বাদাম" (১৯৭৭), (৪) "উড়ন্ত নামাবলী" (১৯৭৯), (৫) "দাঁড়াও তর্জনী" (১৯৮৮), (৬) "শ্রেষ্ঠ কবিতা" (১৯৯০), (৭) "অশ্লেষা তিথির কন্যা" (১৯৯৩), (৮) "সামনে আপনারা" (২০০০), (৯) "ওই যে সৌধের চূড়া" (২০০১) ইত্যাদি।
                   
                      লেখক মণীন্দ্র গুপ্ত জানিয়েছেন, --- "বিজয়া যেন হৃদয় থেকে, ইন্দ্রিয়ের ধমনী জালে বিস্তৃত না হয়ে সরাসরি পৌঁছে যান মেধায়। তাঁর জীবনের সমস্ত অভিজ্ঞতা অনুভূতি নিংড়ে ওঠে তত্ত্ব, তাঁর সত্য। বিজয়ার তত্ত্বান্বেষী মন শিল্পের পক্ষে কখনো কখনো ক্ষতিকর হলেও ওটি তাঁর সহজাত, অনেকের মতো ভাল নয়।" ("ষাট দশকের কবিতা")।
আধুনিক যান্ত্রিক জীবন ও সমস্যা তাঁকে ভাবিয়েছে। তিনি লিখেছেন, ---
               "ক্রমে গরম হয়ে উঠবে পৃথিবী
                গলতে থাকবে মেরু তুষার
                সমুদ্রের জল উপচে উঠবে আমাদের -
                তিনতলায়"

♦♦ ৫) নবনীতা দেবসেন (১৯৩৮ ---) ♦
         ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারী নবনীতা দেবসেন দক্ষিণ কলকাতায় হিন্দুস্থান পার্কে তাঁর বাবা-মা'র 'ভালবাসা'(এখনো সেখানেই বসবাস করেন) গৃহে জন্মগ্রহন করেন। পিতা নরেন্দ্র দেব ও মাতা রাধারানী দেবী সেযুগের বিশিষ্ট কবি দম্পতি। ছেলেবেলায় এক বিশেষ সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে তিনি বড় হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়া উনি হিন্দি, ওড়িয়া, অসমীয়া, ফরাসী, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাগুলি পড়তে পারেন। গোখলে মেমোরিয়াল গার্লস, লেডি ব্রেবোর্ণ ও প্রেসিডেন্সি কলেজ, যাদবপুর, হার্ভার্ড, ইণ্ডিয়ানা (ব্লুমিংটন) ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা করেছেন। ১৯৭৫-২০০২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ও বেশ কিছুকাল বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। এছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। তাকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট অথরিটি মানা হয়। যাদবপুরে তিনি কবি বুদ্ধদেব বসু ও সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্নেহধন্য ছাত্রী ছিলেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ (পরবর্তীকালে নোবেলজয়ী) অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে (১৯৫৮-১৯৭৬) আবদ্ধ হন ও তাদের দুই কন্যা সন্তান জন্ম হয়। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। জ্যেষ্ঠা অন্তরা সেন সাংবাদিক ও সম্পাদক এবং কনিষ্ঠা নন্দনা সেন অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী।
                 যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নবনীতা লেখিকা হিসাবেই বিশেষভাবে পরিচিতি লাভ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের স্নেহধন্যা রাধারানী দেবীর কন্যা নবনীতা। এই নামটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরই দেওয়া। নবনীতা দেবসেন বলেছেন, --- "এক কবির গর্ভে আরেক কবির ঔরসে আমার জন্ম। অক্ষরের জগৎটাই যার ভিটে-মাটি, ঘর-সংসার, সে আর কবিতা লিখবে না কেন! যেমন আমার গাছে-চড়া, বৃষ্টিতে ভেজা, কাগজের নৌকা গড়া, তেমনিই আমার কবিতা লেখা। কবিতা আমার জীবনে আক্ষরিক অর্থেই সহজ। একা বাড়ির একলা শিশু, কবিতা আমার স্বভাব-সঙ্গী। অশৈশব।" ("প্রথম প্রত্যয়")।
                 নবনীতার জীবনে মধ্যবর্তী বলে কোনো কথা নেই। "সবই তুমুল, সবই তীব্র। তীব্র সুখ, তুমুল যন্ত্রণা।" নবনীতা প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক হলেও কবিতার আয়নাতেই নিজেকে প্রথম দেখেছেন। কবি বলেছেন, "বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতাকেও আমি ভয় করি না, আমার একটা ভয়, কবিতা যেন আমাকে শেষদিনেও পরিত্যাগ না করে। সে নিঃসঙ্গতা পক্ষাঘাতের মতো সে বড় ভয়ানক হবে। কবিতা আমার অভিমান, আমার প্রার্থনা, আর নিঃসঙ্গতা আমার সঙ্গ, আমার পূর্ণতা, আমার অতৃপ্তি। কবিতাই সত্য অর্থে সেই 'বিজন জীবন বিহারী'। জীবনের গহনে যে-বিজন জীবন সেখানে যে ছায়াময় অনুভবের গোপন সঞ্চার, তার অনুরণটুকুও স্বচ্ছন্দে ধরে ফেলতে যে পারে, সেই পরম ফাঁদের নাম কবিতা। শূন্য গগনবিহারী ভাবকে ভাষার মোহন মরণে বিদ্ধ করে ফেলতে জানে যে-বিচিত্র ছলনা, তারই নাম কবিতা। সেই কবিতাকে কখনোই অবসন্ন করে ফেলা যায় না, অন্তরাল থেকে তাকে বসন যুগিয়ে যান স্বয়ং মহাকাল - কোনো দুঃশাসন কবি-সমালোচকের সাধ্য নেই যে সত্যিকারের কবিতাকে, আর জন্মসূত্র থেকে সম্পূর্ণ জন্মাচিত করে শেষ কথাটি বলে দেয়।" ছোটোবেলা থেকেই এক-একটা শব্দ ভীষণভাবে আকর্ষণ করে "দেখা না-দেখার নেশা" বোধের অতীতলোকে পৌঁছে যেতো, সংগীতের মতো ছড়িয়ে পড়তো। এম. এ পড়ার সময় অমিয় চক্রবর্তী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্তকে বন্ধু হিসাবে পান। তেরো-চোদ্দ বছর বয়সে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য শিখিয়েছেন সুদ্ধসত্ত্ব বসু। সুদ্ধসত্ত্ব বসুর উৎসাহে "একক" পত্রিকায় তিনি কবিতা লিখেছেন। বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নরেশ গুহ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের কাছে ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যের ক্লাস করেছেন। আমেরিকায় অমিয় চক্রবর্তীর কাছে পড়েছেন।
                 কাব্যগ্রন্থ, ছোটোগল্প, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনী ও উপন্যাস মিলে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা ৮০-এর মতো। নবনীতার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "প্রথম প্রত্যয়" (১৯৫৯) অমিয় চক্রবর্তী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের আগ্রহে প্রকাশিত হয় "দেশ" পত্রিকায়। বারো বছর পর বেরোয় তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ "স্বাগত দেবদূত" (১৯৬১) প্রকাশিত হয় প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অমিয় চক্রবর্তীর আগ্রহেই। তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস "আমি অনুপম" ১৯৭৬  খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় বিষ্ণু দের বড়ো মেয়ে ইরাকে পেয়েছিলেন বান্ধবী হিসাবে। বুদ্ধদেব বসুর ছোটো মেয়ে রুমি ছিল তাঁর পাড়ার বন্ধু। রুমির চেষ্টায় নবনীতার কবিতা চলে যায় বুদ্ধদেব বসুর কাছে এবং তা "কবিতা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। "দেশ" পত্রিকায় অবশ্য তার আগেই তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। লিখেছেন "পূর্বাশা", "উত্তরা", "শতভিষা" ইত্যাদি পত্রিকাতেও। তাঁর বাবাই তাঁকে পদ্য রচনা শিখিয়েছেন। মা রাধারাণী দেবীর "অপরাজিতা দেবী' ছদ্মনামে লেখা কবিতা পড়ে শিখেছেন "লঘু স্বরে গভীর কথা বলা।" নবনীতা বলেছেন, --- "কবিতা মানেই যুদ্ধ। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে অবশেষে যখন বিজয় এবং শান্তি, মাত্র তখনই প্রস্তুত হয় কবিতা। বুদ্ধের মধ্যে গুহায়িত হয়ে থাকে সেই কবিতা, প্রায় সে প্রঞ্জার স্বগোত্র সেখানে। কিন্তু প্রঞ্জাকে জীবন গুটি পাকিয়ে অনেক সময়ে আমাদের আঁচলে ছুঁড়েও দেয়। কবিতাকে নৈব নৈবচ। কবিতা তোমার শসীদৃক্ষ থেকে আনা অস্ত্রের পরীক্ষা নেয়। কবিতাকে অর্জন করে নিতে হয়।"
নবনীতা যখন কবিতা লিখতে শুরু করেছিলেন, তখন আধুনিক কবিতা লিখতেন যে তিনজন মেয়ে তাঁরা হলেন - রাজলক্ষ্মী দেবী, হেনা হালদার ও কবিতা সিংহ। এরপর কিছুদিন লিখেছেন শিপ্রা ঘোষ। ষাটের দশকে আবির্ভাব ঘটে বিজয়া মুখোপাধ্যায়ের। কবির কাছে কবিতা জীবনের আয়না।
              নবনীতার কথা দিয়ে বলা যায়, --- "কবিতা তো দর্পন, দেখতে জানলে ভালো কবিতায় জীবনের ছবি সম্পূর্ণই খুঁজে পাওয়া যাবে। সৎ কবিতা হলো টাইম ক্যাপসুল। তারমধ্যে অতি সংক্ষিপ্তসারে কবির অন্তর-বাহিরের সবটুকুই গুছিয়ে তোলা থাকে। সিসমোগ্রাফ যন্ত্রের মতো কবিতায় ধরা পড়ে যায় পারিপার্শ্বিক সূক্ষ্মতম কম্পনও - ইতিহাস, দর্শন, সমাজ, ধর্ম, মানুষের জীবন সত্য। তার জন্যে কবিকে আলাদা করে চেষ্টা করতে হয় না। একটা একটা কবিতায় নয়, কবির সমগ্র কবিতা থেকে এই সামগ্রিক ছবি ঠিক উঠে আসবে।" মূলত কাব্যগ্রন্থ ও উপন্যাস রচনার মধ্যদিয়েই তিনি সাহিত্যজগতে খ্যাতি অর্জন করেছেন।
 
              তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "প্রথম প্রত্যয়" (১৯৫৯), (২) "স্বাগত দেবদূত" (১৯৬১), (৩) "তিন ভুবনের পারে", (৪) "নারী তুমি অর্ধেক আকাশ" (৫) "ভালোবাসা কারে কয়", (৬) "মেদেয়া এবং", (৭) "সাত কন্যের দেশে", (৮) "শ্রেষ্ঠ কবিতা" ইত্যাদি।

               সাধারণ বিষয় তাঁর কবিতায় প্রকাশভঙ্গীর বৈশিষ্ট্যে অসাধারণ হয়ে উঠেছে। বর্তমানে সবকিছু ছোটো হয়ে যাওয়ায় কবি "একা" হয়ে বলেছেন 'কক্ষচ্যুত অনিকেত আমি"। পুরানের চাঁদ সদাগরকে নিয়ে লিখেছেন "মনসামঙ্গল" কবিতা। গভীর জীবন উপলব্ধির কথা জানাতে গিয়ে তিনি বলেছেন -
        "আসল কথাটা আর জানা হয় নি।
        জেনেছি এদিক সেদিক, আশপাশ, ছালবাকল
        জেনেছি পূর্ব এবং পশ্চাৎ
        আসল কথাটিই কেবল জানা হয়নি।"

              সাহিত্যের সকল শাখায় বিরাজ করেছেন অধ্যাপক নবনীতা দেবসেন। নিঃসঙ্গতা, যান্ত্রিক সমাজের যন্ত্রণা, অতীতের স্মৃতিচারণা তাঁর কবিতায় পরিস্ফুট হয়েছে। "আসল কথা" কবিতায় তিনি বলেছেন, ---
        "জেনেছি এদিক সেদিক, আশপাশ ছালবাকল
         জেনেছি পূর্ব এবং পশ্চাৎ
         আসল কথাটিই কেবল জানা হয়নি।"

        তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা হল : (১) "মহাদেবী ভার্মা পুরস্কার" (১৯৯২), (২) "সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার" (১৯৯৯) : "নটী নব-নীতা" / "নব-নীতা" (১৯৯৬) নামক গদ্য-পদ্য মিশ্রিত আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনার জন্য, (৩) "পদ্মশ্রী" (২০০০), (৪) "কমল কুমার জাতীয় পুরষ্কার" (২০০৪), (৫) "বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার" (২০০৬), (৬) "গৌরী দেবী মেমোরিয়াল স্মৃতি পুরস্কার", (৭) "ভারতীয় ভাষা পরিষদ পুরস্কার", (৮) "হারমনি অ্যাওয়ার্ড", (৯) "রকফেলার ফাউন্ডেশন পুরস্কার", (১০) ভাগলপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছেন "শরৎ সম্মাননা"।

 ♦♦ ৬) দেবারতি মিত্র (১৯৪৬ ---) ♦♦
           ~~~~~~~~~~~~~~~~~
কবি দেবারতী মিত্র জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৬ সালের
১২ এপ্রিল। তিনি ছিলেন একালের একজন বিশিষ্ট কবি। তিনি যোগমায়া দেবী কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষালাভ করেন।
               কবি মণীন্দ্র দত্তের স্ত্রী ছিলেন তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় দেবারতি মিত্রের কবিতা প্রসঙ্গে ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে "কৃত্তিবাস" পত্রিকায় লিখেছেন, --- "গ্রন্থ থেকেই তার সব অভিজ্ঞতা, কবিতা লিখতে এবং কবিতাকে ভালোবাসতে শিখেছে পূর্ববর্তী কবিদের কাব্যগ্রন্থ থেকেই, সেইজন্য তার শব্দ ব্যবহারে কোনো দুঃসাহসিক নতুনত্ব নেই, আঙ্গিকের আধুনিকতম পরীক্ষা নেই - পঙক্তিগুলি নরম ও বিপন্ন, নিঃসঙ্গতাময় এবং বিরল কবিত্বে উদ্ভাসিত।

               তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল : "অন্ধস্কুলে ঘণ্টা বাজে" (১৯৭১)। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "আমার পুতুল" (১৯৭৪), (২) "যুবকের স্নান" (১৯৭৮), (৩) "ভুতেরা ও খুকি" (১৯৮৮), (৪) "কবিতা সমগ্র" (১৯৯৫), (৫) "তুন্নুর কম্পিউটার" (২০০০), (৬) "শ্রেষ্ঠ কবিতা" (২০০০), (৭) "খোঁপা ভরে আছে তারায় ধূলোয়" (২০০৩), (৮) "জীবনের অন্যান্য ও কবিতা" ইত্যাদি।
               তাঁর উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা হল : (১) তিনি "আনন্দ পুরস্কার" লাভ করেন ১৯৯৫ সালে।

♦♦ ৭) কৃষ্ণা বসু (১৯৪৭ ---) ♦♦
           ~~~~~~~~~~~~~~
কবি কৃষ্ণা বসু জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের
১৭ নভেম্বর। তিনি অধ্যাপনার কর্মজীবন থেকে
সম্প্রতি অবসর গ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন সমকালীন বাংলার একজন বিষিষ্ট কবি। তাঁর কবিতায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে নারীবাদ, প্রতিবাদ এবং মানবিকতা। আবহমান কাল ধরে চলে আসা পুরুষতান্ত্রীকতার তিনি ঘোর বিরোধী। তিনি আবৃত্তকার হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থেকে তিনি নিয়মিতভাবে বক্তৃতার আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি "সংবাদ প্রতিদিন" পত্রিকায় “মনে মনে” কলামটি লিখেছেন। অধ্যাপিকা কৃষ্ণা বসু তাঁর কবিতায় আধুনিক সমাজ-মানসের জীবন-যন্ত্রণার চিত্র উদ্ভাসিত করেছেন।
                   
                      তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "শব্দের শরীর" (১৯৭৬), (২) "জলের সারল্যে" (১৯৮০), (৩) "কর্ডিগানে কুসুম প্রস্তাব" (১৯৮২), (৪) "নার্সিসাস ফুটে আছে একা" (১৯৮৪), (৫) "এই নাও মায়া তরবারি" (১৯৮৬), (৬) "অন্যমনস্ক বাতাস ও খোলাপাতা" (১৯৮৮), (৭) "সাহসিনী কে রয়েছে, সাজো" (১৯৯০), (৮) "নবমী নিশির গান" (১৯৯২), (৯) "সমস্ত মেয়ের হয়ে বলতে এসেছি" (১৯৯৮), (১০) "কথা নয়, কথার অধিক" (২০০১), (১১) "দর্পণ-দর্পণ" (২০০১), (১২) "নির্জন নদীর গঠন" (২০০৯), (১৩) "পরাণ পুতলি পদ্ম", (১৪) "ও গান যাও, নাও ভাসাও", (১৫) "শ্রেষ্ঠ কবিতা", (১৬) "কবিতা সংগ্রহ", (১৭) "এই নাও মায়া তরবারি", (১৮) "কবিতাই শির্ষ-শিল্প", (১৯) "শিল্পের সংসারে আছি", (২০) "রক্তাক্ত হৃদয়ের গান", (২১) "পরিযায়ী পাখিদের ডানা", (২২) "দুই নারী দুই জীবন", (২৩) "কথাকৃতি", (২৪) "ছাপা অক্ষরের ডানা", (২৫) "মানুষের ভিতর ক্ষত" ইত্যাদি। তাঁর কবিতার প্রেম ও প্রকৃতির সহজ-সাবলীল প্রকাশ আমাদের মুগ্ধ করে।
   
                    তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা হল : (১) “প্রতিশ্রুতি পুরস্কার”, (২) “সোপান পুরস্কার”, (৩) “কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার”, (৪) সুইডেন থেকে প্রাপ্ত “উত্তর পথ পুরস্কার” (২০০১), (৫) “কবি বিষ্ণু দে স্মৃতি পুরস্কার” (২০০৫), (৬) প্রবাসী মার্কিন বাঙালীদের দেওয়া “উত্সব পুরস্কার” (২০০৮ ও ২০১১), (৭) বাংলা অকাদেমির “আল্পনা আচার্য স্মৃতি পুরস্কার” (২০০৯), (৮) দিল্লীর সাহিত্য আকাদেমি থেকে “রাইটার ইন রেসিডেন্স” সম্মান (২০০৯) ইত্যাদি।

♦♦ ৮) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৫৫ ---) ♦♦
          ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৫৫ সালের ৫ জানুয়ারি কলকাতার হাজরা অঞ্চলে এক দরিদ্র নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রমীলেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী, মা গায়ত্রী দেবী ছিলেন গৃহবধূ। কলকাতার শ্রীশিক্ষায়তন কলেজ থেকে বি.এড. ডিগ্রি সম্পূর্ণ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে কলকাতার যোগেশচন্দ্র চৌধুরী আইন কলেজ থেকে এল.এল.বি. ডিগ্রি অর্জন করেন। রাজনীতিতে প্রবেশ ছাত্রাবস্থাতেই। শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার পর সংসার চালনার জন্য কিছুকাল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিবাহ করেননি।
                  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড়ো পরিচয়, তিনি রাজনীতিক, সমাজ সেবী। এমন ব্যস্ত নেত্রী সময় পেলেই অন্তরের টানে সাহিত্যের জন্য কলম ধরেন। বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থ রচনা করে তিনি যথেষ্ট খ্যাতিও অর্জন করেছেন। ছবি আঁকা, গান-বাজনার সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের টানে গভীর রাতে লেখেন কবিতা।সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রাম, ঘাম-রক্ত, ছায়ার মতো ছড়িয়ে থেকেছে মমতার কবিতায়। ভাষা সহজ, সরল। "মা" কবিতা সংকলনে বিদ্রোহ সংঘাত ব্যক্তি মমতাকেই চিনিয়ে দেয়। মমতা বলেছেন, "বাংলার সকল মাকে প্রণাম জানিয়েই "মা" দিয়ে আমার লেখনী শুরু। বাংলার সব কবি, সাহিত্যিকদের প্রণাম জানিয়ে "মা" কবিতায় বইটি একটি গোলাপ কাঁটার মতো উপস্থিত করলাম।" মমতার পথ চলা শুরু হয়েছে যে মা-মাটি-মানুষের স্বপ্নকে বুকে নিয়ে, সেই স্বপ্নকেই ধরে রাখতে চেয়েছেন, "মা-মাটি-মানুষ" কবিতা সংকলনে। মমতা শিশুদের যে কত গভীরভাবে ভালোবাসেন তার পরিচয় মেলে ছোটদের "আজব ছড়া", "শিশু সাথী" (২০০০) প্রভৃতি গ্রন্থে।
               
                  সবার আগে মমতা রাজনৈতিক নেত্রী। রাজনৈতিক নেত্রীর চোখে দেখা মানুষ, মানবিকতা, সমাজ, সংসারই শেষপর্যন্ত তাই স্বাভাবিকভাবেই মমতার কাব্যের উপকরণ হয়েছে। ছোটদের জন্য তিনি লিখেছেন, : (১) "আজব ছড়া", (২) "শিশু সাথী" (২০০০) প্রভৃতি গ্রন্থ। তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল : (১) "মা" (১৯৯৬), ২() "জন্মাইনি" (২০০১), (৩) "সরণী" (২০০৫), (৪) "লাঙল", (৫) "মা-মাটি-মানুষ" (২০০৭) ইত্যাদি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কয়েকটি কবিতা হল : (১) "ধর্মতলার সিঙ্গুর" [আন্দোলনের অনশন মঞ্চে বসে লেখা কবিতা], (২) "আমার ঠিকানা", (৩) "সিঙ্গুর", (৪) "জীবন", (৫) "ওরা একা খাবে", (৬) "তাপসী" ইত্যাদি। তাঁর অন্যান্য কবিতাবলীগুলি হল :(১) "সাগরের মোহনায়", (২) "বাদলা বেলার কথা", (৩) "ছোট্ট মেয়ে", (৪) "২১শে জুলাই, রক্তে লেখা এক নাম",  (৫)"যবনিকা", (৬) "গুছিয়ে নেওয়া", (৭) "রাস্তার ধুলো" ইত্যাদি।
                       
                    তাঁর বিশেষ পুরস্কার ও সম্মাননা হল : সমাজসেবা ও শিল্প-সাহিত্যে অবদানের জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে "ডি.লিট" সম্মান দিচ্ছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি নজরুল মঞ্চে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান হবে। ওই অনুষ্ঠানেই মুখ্যমন্ত্রীকে এই সম্মান জানানো হবে। সমাবর্তনে দীক্ষান্ত ভাষণও দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দেশের রাষ্ট্রপতিকে ডি লিট সম্মান দেওয়া হলেও এই প্রথম কোনও মুখ্যমন্ত্রীকে ডি লিট দেওয়া হচ্ছে। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে ডি লিট দিয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। তারও আগে ২০০৭ সালে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে ‘‌ডক্টর অফ ল’‌ সম্মান দেওয়া হয়েছিল। কিছুদিন আগে সমাবর্তন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও সেনেট বৈঠক হয়। এই বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রীকে ডি লিট প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। উপাচার্য সোনালি চক্রবর্তী ব্যানার্জি জানান, সমাজসেবা ও শিল্প-সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে ডি.লিট সম্মানে সম্মানিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিন্ডিকেট ও সেনেট। উপাচার্য বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে তাঁর সম্মতি দিয়েছেন।" এ বছর আর কাউকে ডি লিট দিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয়। ডি.এস.সিও দেওয়া হচ্ছে না। উপাচার্য বলেন, "ডি.লিট বা ডি.এস.সি দেওয়ার ব্যাপারে সিন্ডিকেট বা সেনেট বৈঠকে আর অন্য কোনও নাম উঠে আসেনি। তাই আর কাউকে ডি. লিট দেওয়া হচ্ছে না। ডি.এস.সির জন্যও কোনও নাম উঠে আসেনি।" প্রসঙ্গত, দুটি বৈঠকেই মুখ্যমন্ত্রীকে ডিলিট দেওয়ার জন্য তাঁর নাম প্রস্তাব করেন স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান এবং শ্যামাপ্রসাদ কলেজের অধ্যক্ষ সুবীরেশ ভট্টাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত ১০ জন শিক্ষককে "এমিনেন্ট টিচার’" অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে। কিছুদিন আগেই শতবার্ষিকী হল সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। এই কারণেই সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি নজরুল মঞ্চে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এদিনের সিন্ডিকেট বৈঠকে সেনেট ও সিন্ডিকেট রুমের সংস্কারের সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়। ঐতিহ্য বজায় রেখে সেনেট রুমটিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা যায় কিনা তা দেখা হবে।‌‌‌

♦♦ ৯) মল্লিকা সেনগুপ্ত (১৯৬০-২০১১) ♦
          ~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কবি মল্লিকা সেনগুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন ১৯৬০ সালের ২৭ মার্চ ভারতের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর শহরে। তাঁর কবি জীবন শুরু ১৯৮১ সালে এবং সেই থেকে তিনি ১১টি কাব্যগ্রন্থ / কবিতার বই, দুটি উপন্যাস এবং বিভিন্ন প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা কেন্দ্রে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা নারীবাদী ও সংবেদনশীল, সমসাময়িক ও ইতিহাস মুখী। তিনি কুড়িটি বই রচনা করেন। পেশায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যার অধ্যাপক ছিলেন।
                           মল্লিকা সেনগুপ্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা কেন্দ্রে অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর হয়ে কলকাতার  মহারাণী কাশীশ্বরী কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হয়েছিলেন। ১৯৮১ সাল থেকে তাঁর লেখা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তিনি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। তাঁর বহু লেখা ইংরেজীতে অনুবাদ করা হয়েছে। তাঁর কবিতা এক কথায় "আগুন ঝরানো"। মেয়েদের দুঃখ, দুর্দশা, হতাশা, লাঞ্ছনা,  উপেক্ষা ও অসম সামাজিক অবস্থানের বিরুদ্ধে তাঁর কবিতা বার বার গর্জে উঠেছে।
                          কবির নিজের কথায়, --- "আমি কান্না পড়ি, আগুন লিখি, নিগ্রহ দেখি, অঙ্গার খাই, লাঞ্ছিত হই, আগুন লিখি।" ৯০-এর দশকে তিনি অপর্ণা সেন সম্পাদিত "সানন্দা" পত্রিকার কবিতা বিভাগের সম্পাদনা করতেন। স্বামী সুবোধ সরকারের সাথে তিনি "ভাষানগর" নামক একটি সাংস্কৃতিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। অধ্যাপক তরুণ সেন বলেছেন, --- "মল্লিকা সেনগুপ্ততে দেখি সিন্ধুর মেয়ে প্রণয় পুলক পার হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পুরুষের জগতে, যেখানে কেবলই শেকল, অসূর্য অন্ধকার, নিগ্রহ, পুরুষ বিদ্বেষী না হয়েও অতঃপর এই দ্বিধাহীন সম্পূর্ণ মানুষী অর্ধেক পৃথিবীতে অধিকার চায়, অক্ষয় যৌবন চায়, সন্তান চায়, সন্তান জন্মের প্রতিটি মুহূর্তের সচেতনতা চায়।" পুরুষ ও নারীর বৈষম্যের প্রতিবাদ করেছেন মৃদুভাষায় মল্লিকা।
                            মল্লিকার কবিতা আপষহীন রাজনৈতিক ও নারীবাদী হিসেবে পরিচিত। তাঁর লেখনির গুণে তিনি আন্তর্জাতিক স্তরেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তাঁর লেখা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।  ইতিহাসের ব্রাত্য নারী চরিত্ররা প্রায়ই তাঁর লেখায় পুনর্জীবিত হয়েছেন। সমসাময়িক কবি সংযুক্তা দাশগুপ্তের ভাষায় "তার কবিতায় নারীস্বত্বা কেবলমাত্র অন্তর্ভূতি সচেতনতা হিসেবেই থেকে যায় না, সেটা প্রস্ফুটিত হয় সমস্ত প্রান্তিক নারীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে এক স্বতস্ফুর্ত প্রতিবাদ।"

                          তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "চল্লিশ চাঁদের আয়ু" (১৯৮৩), (২) "সোহাগ শর্বরী" (১৯৮৫), (৩) "আমি সিন্ধুর মেয়ে" (১৯৮৮), (৪) "হাঘরে ও দেবদাসী" (১৯৯১), (৫) "অর্ধেক পৃথিবী" (১৯৯৩), (৬) "মেয়েদের অ আ ক খ" (১৯৯৮), (৭) "কথামানবী কবিতা" (১৯৯৯), (৮) "আমরা লাস্য আমরা লড়াই" (২০০০), (৯) "দেওয়ালির রাত" (২০০০), (১০) "সুবোধ মল্লিকা
স্কোয়ার" [তাঁর স্বামী, কবি সুবোধ সরকারের সাথে যৌথভাবে প্রকাশিত করেছেন] ইত্যাদি।
                         
                          তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা হল : (১) ১৯৯৮ সালে ভারত সরকারের "জুনিয়র রাইটার ফেলোশিপ", (২) ১৯৯৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের "সুকান্ত পুরস্কার", (৩) ২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির "অনীতা-সুনীল বসু পুরস্কার", (৪) "বাংলা আকাদেমি অ্যাওয়ার্ড", (৫) "ফেলোশিপ ফর লিটারেচার"-এ সম্মানিত হয়েছেন।
                             তিনি ২০১১ সালে আমাদের ছেড়ে পরলোকে পাড়ি দেন।

♦♦ ১০) মন্দাক্রান্তা সেন (১৯৭২ ---) ♦♦
           ~~~~~~~~~~~~~~~~~~
কবি মন্দাক্রান্তা সেন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা জেলায়। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত তিনি চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে গবেষণা শুরু করেন কিন্তু স্নাতক হবার আগেই সাহিত্যের প্রতি আরও মনযোগী হতে চূড়ান্ত পরীক্ষার আগেই তিনি তার গবেষণায় ইতি টানেন। কবিতার বই ছাড়াও তিনি তার মাতৃ ভাষায় প্রচুর ছোট গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শ্রুতি নাটক প্রকাশ করেছেন। ২০০৬ সালের বসন্তে তিনি জার্মানির "লিপজিগ" বইমেলায় অসংখ্য কবিতা পাঠ করেন এবং সেই বছরেই অক্টোবর ও নভেম্বর মাসেও একই ভাবে কবিতা পাঠ করেন।
                বিশ শতকের নব্বই-এর দশকের জনপ্রিয় কবি হলেন মন্দাক্রান্তা সেন। বিষয় ও আঙ্গিকে তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। নিত্য নৈমিত্তিক জীবন-সমস্যা, প্রেম, ক্ষুধা তাঁর কাব্যে জায়গা নিয়েছে। তাঁর কবিতা হিন্দী ও ইংরেজী সহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। ঈশ্বরকে তিনি নিজের মতো করে উপলব্ধি করেছেন। "সেদিন দুজনে" কবিতায় তিনি লিখেছেন, ---
         "যা অতি মধুর, অথচ গোপন,
          সেকথা লিখিনি কাব্যে লিখে
          দিলে হায় তিনি যে আমায়
          অবিশ্বাসিনী ভাববেন"

          মন্দাক্রান্তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল : "হৃদয় অবাধ্য মেয়ে" (১৯৯৯)। তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল : (১) "বলে অন্যভাবে" (২০০০), (২) "ছদ্ম পুরাণ" (২০০১), (৩) "উৎসারিত আলো" (২০০১), (৪) "এইসব রাতের চিহ্ন" (২০০২), (৫) "কাশভরা বন্ধুতারা" (২০০২), (৬) "বর্ষাফলকে গ্রন্থহার" (২০০৪), (৭) "কাব্যসংগ্রহ" (২০০৪), (৮) "প্রেমের কবিতা" (২০১৫), (৯) "বর্ষাফলকে গাঁথা হাড়" ইত্যাদি।

          জীবনানন্দীয় আমেজ তাঁর কবিতায় আমরা প্রত্যক্ষ করি। চিত্রকল্প রচনায় তিনি যথেষ্ট মুন্সীয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। নিজের অনুভূতি ও উপলব্ধির কথা বলেছেন এইভাবে, ---
             "ছোঁও, আরও একটু ছোঁও,
              মুহূর্তে উজাড় হোক প্রাণ
              প্রিয় পুরুষের কাছে
              চেয়ে নেব নিভৃত সন্তান।"
   
           তাঁর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননা হল : (১) ১৯৯৯ সালে "আনন্দ পুরস্কার", "হৃদয় অবাধ্য মেয়ে" (১৯৯৯) কাব্যগ্রন্থের জন্য, (২) ২০০২ সালে "আকাশ বাংলা বর্ষ সন্মান", (৩) ২০০৩ সালে "কৃত্তিবাস পুরস্কার", (৪) ২০১৫ : তরুণ লেখকদের জন্য "স্বর্ণা জয়ন্তী আকাদেমি পুরস্কার" তিনি লাভ করেন।


★আলোচক : সৌম্য মাইতি 
(ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র, কিংসটন কলেজ, মেছেদা, পূর্ব মেদিনীপুর)

★ মডারেটর -- সাকসেস বাংলা★


Share this