হরপ্রসাদ শাস্ত্রী


★ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮৫৩-১৯৩১):

যিনি না থাকলে হয়তো আজও আমরা বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন এর সন্ধান পেতাম না,যাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল হিসেবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের পাতায় জজ্বল করছে 'চর্যাপদ'এর নাম তিনি হলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
প্রকৃত নাম শরৎনাথ ভট্টাচার্য। জন্ম ১৮৫৩ সালের ৬ই ডিসেম্বর, চব্বিশ পরগনার নৈহাটির ভট্টাচার্য পরিবারে।পিতার নাম রামকমল ন্যায়রত্ন।শাস্ত্রী মহাশয় এর  সরকারী ও বেসরকারী স্কুল ও কলেজে শিক্ষাদান কর্ম সেদিনের সমাজে বিশেষ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল।সেকালের বিখ্যাত পণ্ডিত প্রবীণ পুরাতত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সাহচর্য লাভ করে। হরপ্রসাদ প্রধানত প্রত্নতত্ত্ব, পুরানতত্ত্ব এবং বাংলা ও সংস্কৃতের প্রাচীন সাহিত্যচর্চালোচনায় জীবন অতিবাহিত করেন।এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ,প্রভৃতি সারস্বত প্রতিষ্ঠান তাঁর কর্ম প্রতিভার স্পর্শে ধন্য হয়েছিল।১৯৩১খ্রিস্টাব্দে তাঁর দেহান্ত হয়।
        বাংলা, সংস্কৃত, ইংরাজি ইত্যাদি ভাষায় তিনি অসংখ্য গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন।সেদিনের 'বঙ্গদর্শন',আর্যদর্শন','কল্পনা','সাহিত্য পরিষদ পত্রিকা','নারায়ণ', প্রভৃতি পত্রিকাতে বিভিন্ন বিষয়ে বহুতর রচনা প্রকাশিত হয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য, মনস্বিতা ও জ্ঞানের প্রকাশ করে।
              তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ গুলি হল--
                   ১.ভারত মহিলা (১৮৮০-৮১)
                    ২.বাল্মীকির জয়(১৮৮১)
                     ৩.মেঘদূতের ব্যাখ্যা (১৯০২) প্রভৃতি।
এছাড়াও তাঁর উপন্যাস হল-
১.কাঞ্চনমালা(১৯১৬)
২.বেনের মেয়ে(১৯২০)
       শাস্ত্রী মহাশয়ের অবিস্মরণীয় অবদান 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা' ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়।

            ★আবিষ্কারক হরপ্রসাদঃ


                       রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয়ের মৃত্যুর পর সরকার শাস্ত্রী মহাশয়ের উপর বাংলা বিহার আসাম উড়িষ্যার পুথিসন্ধান ও সংগ্রহের দায়িত্ব ন্যস্ত করেন।রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহাশয়ের তালিকা ও আরো নবাবিষ্কৃত পুথির ভিত্তিতে হরপ্রসাদের মনে হয় যে নেপালের নানা জায়গায় বৌদ্ধ ধর্ম সংক্রান্ত নানা পুথি ছড়িয়ে রয়েছে এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এইসব উপকরণ একান্ত অপরিহার্য।এইসব উপকরণ সংগ্রহের জন্য তিনি ১৮৯৭-৯৮ সালে দুইবার নেপালে গিয়ে কিছু সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ করে আনেন।এরপর ১৯০৭ সালে তৃতীয় বার নেপালে গিয়ে 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়',সহরপাদের দোহাকোষ ও অদ্বয় বজ্রের সংস্কৃতে রচিত 'সহজাম্নায়পঞ্জিকা' নামক টিকা এবং কৃষ্ণাচার্যের দোহা ও আচার্যপাদের সংস্কৃতে রচিত 'মেখলা' নান্মী টীকার সঙ্গে আরো কিছু পুঁথি সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন।এরপর এই তিন খানি পুঁথির সঙ্গে ডাকার্ণবের পুঁথিটি গ্রহণ করে তিনি বাংলা ১৩২৩সন (ইং-১৯১৬) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে 'হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা 'প্রকাশ  করেন।
         মজার ব্যাপার,  এই গ্রন্থ প্রকাশের পরই বাংলা ভাষা  ও সাহিত্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বিষয়ক পূর্বতন ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তগুলি বিচলিত হয়ে পড়ল।শুধু বাংলাই নয় হিন্দি, মৈথিলী, ওড়িয়া  প্রভৃতি অন্যান্য নব্য ভারতীয় আর্যভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের মধ্যেও বিশেষ তৎপরতা দেখা গেল।ফলে শাস্ত্রী মহাশয় আবিষ্কৃত রচনাবলীর নিবিড়তর বিশ্লেষণ শুরু হল।এই বিশ্লেষনের ফলে দেখা গেল, শাস্ত্রী মহাশয়ের আবিষ্কার চমকপ্রদ হলেও তাঁর সিদ্ধান্তগুলি সমস্তই
অভ্রান্ত নয়।দেখা গেল তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের শুধু প্রথম পুঁথিটির ভাষাই বাংলা, অন্য তিনটি পশ্চিমা অপভ্রংশে রচিত। সে যাই হোক এভাবেই আমরা পেলাম বাংলা ভাষার আদি নিদর্শনকে।যাঁর আবিষ্কারক হলেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

   ★★প্রাবন্ধিক হরপ্রসাদঃ

        পণ্ডিত হরপ্রসাদ তাঁর প্রবন্ধগুলির বিষয় গৌরব ও রচনাশৈলী  আকর্ষনীয় করে তুলেছেন রসসম্মতভাবে; বক্তব্যবিষয়কে সুচারুভাবে উপস্থাপনের দ্বারা।তাঁর সহজ,সুললিত রচনাভঙ্গি, সুচিন্তিত সিদ্ধান্তমুখী মানসিকতা ও রচনার মধ্যে মধ্যে বিশুদ্ধ কৌতুক রসের বিচ্ছুরনে প্রবন্ধগুলি উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।তাঁর 'ভারতমহিলা' প্রবন্ধগ্রন্থটির পাঁচটি অধ্যায়ে রয়েছে বেদ,স্মৃতি, পুরাণ, তন্ত্র,সংস্কৃত সাহিত্যের বাল্মীকি, বেদব্যাস,কালিদাস প্রমুখ কবিদের সম্বন্ধে আলোচনা। সৌন্দর্য রসিক মন নিয়ে কালিদাসের মেঘদূত কাব্যের বিশ্লেষণ করেছেন মেঘদূত প্রবন্ধে।শাস্ত্রী মহাশয়ের তুলনামূলক প্রবন্ধের মধ্যে 'কালিদাস ও সেক্ষপীয়র'এবং 'বঙ্গীয় যুবক ও তিন কবি' সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তাঁর বাংলা ভাষা ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের উপর মনগ্রাহী প্রবন্ধ হল ১.'বাংলা ভাষা',২.'বর্ত্তমান শতাব্দীর বাঙ্গালা সাহিত্য',৩.'বাঙ্গালা ভাষার পরিনতি'।শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর রচিত প্রবন্ধ হল-'দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান', 'বাংলায় সংস্কৃত',  'ভাস্করের কাজ'।তাঁর প্রবন্ধের ভাষা সম্পর্কে রবীন্দ্র অভিমত -
    "যে কোন বিষয় শাস্ত্রী মহাশয় হাতে নিয়েছেন,তাকে সুস্পষ্ট করে দেখেছেন এবং সুস্পষ্ট করে দেখিয়েছেন।তাঁর রচনার খাঁটি বাংলা যেমন স্বচ্ছ ও সরল এমন তো আর কোথাও দেখা যায় না।"
পরিশেষে এটাই বলতে পারি, বর্তমানে সিরিয়াল প্রেমী বাঙালি যেখানে নিজের পরিজনকে ভুলতে বসেছে সেখানে নিজের সংস্কৃতির ও নিজের ভাষার এই মহান মানুষকে তো ভুলেই যাবে আর সেটাই স্বাভাবিক। তবুও তারই মধ্যে আশার আলো যাঁরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে নিয়মিত চর্চা করছেন বা পরীক্ষা বৈতরনী পার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি তাদের কাছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী খুবই গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যাক্তিত্ব।জন্মদিনে ওনাকে জানাচ্ছি সশ্রদ্ধ প্রনাম।

** তথ্যঋণ
১.বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত -ড.অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
২.সাহিত্য টীকা - শ্রী সনৎ কুমার মিত্র।
৩.চর্যাগীতি পরিক্রমা - ড.নির্মল দাশ।
৪.বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (আধুনিক যুগ) - ড.দেবেশ কুমার আচার্য্য।

♦অালোচক-- গৌতম জানা।
♦ মডারেটর ♦সাকসেস বাংলা।

Share this