শব্দার্থ পরিবর্তন

■ শব্দার্থ পরিবর্তন::-

      শব্দার্থ কী বা শব্দার্থ পরিবর্তন কি বা কাকে বলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে সর্বপ্রথম আমাদের জেনে নেওয়া দরকার 'শব্দ' কি ? 'শব্দ' কি -----এই প্রশ্নটির উওরে আমরা যদি একথা বলি যে , মুখ থেকে নির্গত কোনো ধ্বনিই হল শব্দ তবে এ উওর যথাযথ বলে বিবেচিত হবে না । প্রকৃতপক্ষে 'শব্দ' হল অর্থবোধক ধ্বনি সমষ্টি ।অর্থাৎ  মনের ভাব প্রকাশক অর্থ থাকতে হবে ।
          আর শব্দার্থ ? 'শব্দার্থ'-কে ভাঙলে হয় শব্দ+অর্থ । অর্থ বোঝানোর জন্যই শব্দের সৃষ্টি । তবে কেবলমাত্র একটি অর্থ বোঝানোর জন্যই এক একটি শব্দের সৃষ্টি নয় | যুগে যুগে কালে কালে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথেই শব্দের অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে চলেছে নদীর স্রোতের মতো । কখনও কখনও কোনো কোনো শব্দের অধিষ্ঠান হচ্ছে উচ্চাসনে আবার কোনো কোনো শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে তার সীমিত গন্ডীর মধ্যে ।আবার কেউ বা মুক্ত বিহঙ্গের মতো ডানা মেলে অজানা এক রঙিন জগতে দিচ্ছে পাড়ি আবার কেউ বা পায়ে বেড়ী পড়ে নিজ নিজ জায়গাতেই অবস্থান করছে । এভাবেই একের পর এক নানাভাবে চলছে  পরিবর্তনের নিত্যকেলি ।

■ শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ:-  মহাকবি কালিদাস তাঁরা "কুমারসম্ভব" কাব্যের শুরুতে বন্দনা অংশে জগতের পিতা-মাত পার্বতী পরমেশ্বর এর বন্দনা করতে গিয়ে শব্দার্থ তত্ত্বের প্রসঙ্গ তুলে ধরেছেন।
   ''বাগার্থাবিব সংপৃক্তৌ বাগর্থ প্রতিপতয়ে
জগতঃ পিতরো বন্দে পার্বতী-পরমেশ্বরৌ ।''
--অর্থাৎ শব্দার্থ বিষয়ে জ্ঞানলাভের জন্য শব্দের সাথে অর্থ যেমন সংপৃক্ত তেমনি পরস্পর সংযুক্ত জগতের পিতা-মাতা পার্বতী পরমেশ্বরকে বন্দনা করি ।

     পরিস্থিতি,স্থান,কাল প্রভৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে শব্দের অর্থও পরিবর্তিত হতে শুরু করে । শব্দের অর্থের এই যে পরিবর্তন তার কারণ স্বরূপ আমরা কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলোচনা করতে পারি-------
  ● 1)ভৌগোলিক কারণ:::------ শব্দার্থ পরিবর্তনের প্রথম কারণ হিসাবে আমরা ভৌগোলিক কারণকে উল্লেখ করতে পারি | স্থান-কাল-ধর্ম-সমাজ-জাতি-রাষ্ট্র প্রভৃতির কালানুক্রমিক পরিবর্তনের সাথে সাথে শব্দের প্রচলিত অর্থেরও রূপ ধীরে ধীরে পরিবর্তনের পথে অগ্রসর হচ্ছে । যেমন----- ফরাসীতে 'দরিয়া' শব্দের অর্থ 'নদী' , কিন্তু বাংলাতে এর অর্থ দাঁড়িয়েছে 'সমুদ্র' ।আবার ' শাক্' শব্দের অর্থ বলতে আমরা বুঝি গাছের পাতা বিশেষ , যা আমাদের আহার্য । কিন্তু পশ্চিম ভারতে 'শাক' বলতে বোঝায় নিরামিষ সব ধরনের খাদ্য বস্তুকে ।মূলত শুষ্ক কঠিন আবহাওয়ার জন্য হয়তো এমন পরিবর্তন ।
●3) উপকরণগত কারণ:::::-----
      কোনো উপকরণ দিয়ে কোনো বস্তু তৈরী হলে সাধারণত সেই উপকরণ থেকে প্রস্তুত বস্তুর নাম হত উপকরণ হিসাবে ।কিন্তু ধীরে ধীরে সেই উপকরণের পরিবর্তন হতে থাকলেও পুরানো নামটি থেকেই যায় । যেমন----- আগে 'যবের মন্ড'-কে 'জাউ' বলা হত ।কিন্তু বর্তমানে ফেনা ভাত বা যে কোনো চাল থেকে প্রস্তুত একটু জলসানো আঠা আঠা ভাব যুক্ত খাদ্যকেই জাউ বলা হয়ে থাকে । 'জাউ' খাবারটির মধ্যে নতুনত্ব ভাব থাকলেও তার সেই পুরাতন অর্থটিই প্রাধান্য পায় । আবার তিল থেকে প্রস্তুত এক ধরনের তরল নির্যাসকে 'তৈল' বলা হত । কিন্তু বর্তমানে সরষে , বাদাম , সূর্যমুখী বীজ , সোয়া প্রভৃতি থেকে নিস্কাষিত তরল নির্যাসকেও তৈল বলা হচ্ছে ।
●4) মানসিক বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার ::::-----
       অনেক সময় ভালোকে গোপন করবার জন্য শব্দার্থ পরিবর্তন ঘটে থাকে । আমরা অশুভ-কুরুচিকর কিংবা ভীতি জনক শব্দ পরিহার করে ঐ শব্দের পরিপ্রেক্ষিতে একই মনের ভাব প্রকাশক অন্য আর একটি শব্দ ব্যবহার করে থাকি । যেমন ::--- কানা ছেলের নাম 'পদ্মলোচন' , আবার 'খুব ফর্সা' মেয়ের নাম কালি , ঘরে চাল ফুরিয়ে যাওয়াকে 'বাড়ন্ত' , বসন্ত হওয়াকে 'মায়ের দয়া ' ইত্যাদি ।
●5) শব্দের সংক্ষিপ্তকরণ:::----
     অনেক সময় আলস্যতা বসত উচ্চারণের সুবিধার্থে বড়ো শব্দকে ছোটো করে প্রয়োগ করা হয় ।যেমন::--'ক্ষৌরকর্ম'- কে সংক্ষেপে 'কামানো' ,'জন্তু' শব্দের মূল অর্থ 'সমস্ত জীব' বা 'প্রাণী' , কিন্তু বর্তমানে মানুষকে বাদ দিয়ে কেবলমাত্র পশুকে বোঝানো হচ্ছে ইত্যাদি ।

●6) আলংকারিক প্রয়োগ:::----
     শব্দে অলংকার প্রয়োগের ফলে কেবল তার সৌন্দর্য্যই বৃদ্ধি পায় না বরঞ্চ শব্দের অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে ।যেমন::-- ব্যবসায় লোকসান হওয়াকে 'গণেশ ওল্টানো ' , দেবতাদের জন্য প্রস্তুত খাবারকে 'ভোগ' ইত্যাদি ।
■ শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা:::::-------
     শব্দার্থ পরিবর্তন নানা ধারায় সম্পন্ন হলেও ভাষা বিজ্ঞানীগণ মূলত পাঁচটি ধারাকে স্বীকার করেছেন | নিম্নে ঐ পাঁচটি ভাগ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো::---

●1)শব্দার্থের প্রসার বা বিস্তার:::---- শব্দের মূল অর্থ যখন তার সীমিত গন্ডী পেরিয়ে বহুলাংশে বৃদ্ধি পায় , তখন সেই অর্থের প্রসার ঘটে । যেমন----- আগে 'কালি' বলতে কেবলমাত্র কালো রঙ দিয়ে তৈরি এক ধরনের তরল , যা লিখবার উপযোগী ।কিন্তু বর্তমানে কালো রঙ এর যে কোনো কিছুকেই কালি বলে ।আবার আগে তিল থেকে তৈরি নির্যাসকেই তৈল বলতো , কিন্তু বর্তমানে সরিষা , নারকেল , জলপাই প্রভৃতির নির্যাসকেও তৈল বলে ।

●2) শব্দার্থের সঙ্কোচ ::---- কোনো কোনো শব্দের অর্থ অনেকগুলো থাকা সত্বেও যদি ঐ অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি মাএ অর্থের গুরুত্ব দেওয়া হয় , তখন শব্দের অর্থের সঙ্কোচ ঘটে ।যেমন ::-----'পঙ্কজ' বলতে 'পাকে জন্মে যা ' (পদ্ম , শালুক ইত্যাদি) তাকেই বোঝায় । কিন্তু বর্তমানে 'পঙ্কজ' বলতে কেবল পদ্মকেই বোঝায় । 'মহৎসব' শব্দের অর্থ মহৎ অর্থাৎ বড়ো করে যে উৎসব পালন করা হয় , কিন্তু বর্তমানে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের একটি বিশেষ উৎসব মচ্ছবকে বোঝায় ।

●3) অর্থ সংশ্লেষ::----
     কোনো কোনো শব্দের অর্থের সংকোচন ও প্রসারণের ফলে ধীরে ধীরে সেইসব শব্দের অর্থের এমন পরিবর্তন ঘটে চলেছে যা থেকে বর্তমানে অর্থের সঙ্গে পূর্ব প্রচলিত অর্থের মিল খুঁজে পাওয়া মুশকিল । শব্দার্থের এমন আমুল পরিবর্তনকে অর্থ সংশ্লেষ বলে ।যেমন::--- পূর্বে 'সন্দেশ'-কে 'সংবাদ' বা 'খবর'বলা হত , কিন্তু বর্তমানে ছানা থেকে তৈরি একধরনের মৃষ্টি বিশেষ ।
●4) শব্দার্থের উৎকর্ষ::----
          যদি কোনো শব্দের পূর্বের অর্থ অপেক্ষা বর্তমান অর্থ অধিকতর উন্নত পর্যায়ে পৌঁছায় তবে শব্দার্থের সেই পরিবর্তনকে শব্দার্থের উন্নতি অর্থাত্ উত্কর্ষ পর্যায়ে প্রযুক্ত হয় । যেমন::--- 'দুহীতা' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'দোহনকারিনী' কিন্তু বর্তমান অর্থ 'কন্যা' । আবার 'থান' শব্দ বলতে আগে বোঝানো কোনো স্থান , কিন্তু বর্তমানে 'থান' শব্দের অর্থ দেবস্থানকেই বোঝায় ।

5)শব্দার্থের অপকর্ষ:::---- কোনো শব্দের অর্থ যদি পূর্বতম অপেক্ষা বর্তমানে নিম্নতর হয় অর্থাত্ অনেকটা হীন প্রকৃতির হয় , তবে তাকে শব্দার্থের অপকর্ষ বলে । যেমন ::---'ঝি' শব্দের পূর্বের অর্থ ছিল 'কন্যা' , কিন্তু বর্তমানে 'ঝি' শব্দের অর্থ 'পরিচারিকা' । 'পীরিতি' অর্থাত্ 'প্রীতি' অর্থে প্রযুক্ত । এর অর্থ 'অলৌকিক প্রেম' , কিন্তু বর্তমানে 'অবৈধ প্রেম' হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে 'পীরিতি' শব্দটি  কাজেই শব্দের অর্থের অবনতি ঘটেছে |
   

♦আলোচক--মৌমিতা বাছার♦
♦অ্যাডমিন♦Success বাংলা।♦

Share this