♦বিজনের প্রাঙ্গণে ♦
#ছেলেবেলা থেকেই এক নাট্য পরিমণ্ডলে তাঁর বেড়ে ওঠা।পরিবারে ছিল সাহিত্য, সঙ্গীত এবং নাট্যচর্চার আবহ। বাড়িতেই পরিবারের সবাই মিলে অভিনয় করতেন। হয়তো কোনোদিন শেক্সপিয়রের 'মার্চেন্ট অব ভেনিস 'এর কিছুটা অংশ হল। ছেলেটির বাবা করতেন শাইলকের চরিত্র, মা করতেন পোর্শিয়ার চরিত্র এবং আর তাঁরা নয় ভাইবোনের মধ্যে কেউ কেউ অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করতেন। এইভাবে ছেলেবলে থেকেই তাঁর মধ্যে তৈরী হয়েছিলো সাহিত্য এবং নাটকের প্রতি অনুরাগ। এই ছেলেটিই বিজন ভট্টাচার্য।
#বিজন ভট্টাচার্যের নাম করলেই একটা নতুন যুগের সূচনার কথা আমাদের মনে আসে। সেটা হল 'নবান্ন'। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই একটি নাটকের জন্যই তিনি নট্যমঞ্চ বা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করতে পারতেন। আমরা যাকে গণনাট্য বা নবনাট্য নামে অভিহিত করি, সেই ধারায় এক যুগান্তর সৃষ্টি করেছিল 'নবান্ন' নাটকটি।
#বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যচর্চার সূচনা হয়েছিল তাঁর বাবার কাছে, শেক্সপিয়রের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তাঁর ভিতরে ভিতরে যেন একটা অদৃশ্য টানতৈররি হয়ে গিয়েছিল দেশজ শিল্পের প্রতি। গ্রামীণ জীবনের মানুষ লোকশিল্পের যেসব আঙ্গিকের মধ্যে তাদের বিনোদন খুঁজে পেত, সেসব আঙ্গিকের দিকেই তাঁর গভীর টান ছিল। গ্রাম্য যাত্রা, লোকনাট্য, আঞ্চলিক নাটক এসব তিনি অনেক দেখেছেন এবং তার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে তাঁর মানসিক গঠন। তাই তাঁর কবিতা, উপন্যাস, নাটক এসবের মধ্যে ছাপ পড়েছে এবং একটা ভাঙাচোরা পরিবর্তনশীল যুগের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই সৃষ্টি মানুষের প্রাণের কাছে গ্ৰাহ্য হয়ে উঠেছিল।
#১৯১৫ সালের ১৭ই জুলাই তিনি জন্মেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের ফরিপুর জেলার খানখানাপুর গ্রামে। এ বিষয়ে মতান্তর আছে। বাবা ক্ষীরোদবিহারী ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা সুবর্ণপ্রভা ছিলেন সংস্কৃতিমনা এক নারী। বাবার ছিল বালির চাকরি। কখনও ফরিদপুর, কখনও বসিরহাট, কখন ও মেদিনীপুর, আবার কখন ও সাতক্ষীরা বা আড়বেলে তিনি বদলি হতেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতেন ছোট্ট বিজন। বাবা যে স্কুলে পড়াতেন তিনিও সেই স্কুলে ভরতি হতেন। এর একটা অন্যতর দিক ছিল, যেটা তাঁকে অনেক বেশী শিক্ষিত করে তুলেছিল। সেটা হল বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের মানুষ তিনি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন তাদের জীবন, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি।শিখেছিলেন তাদের ভাষা। গ্রামীণ লোকায়ত জীবনের মধ্যে এভাবে জড়িয়ে পড়তে পড়তেই তাঁর অবচেতন মনে তৈরি হয়ে যাচ্ছিল সৃষ্টিশীলতার এক বীজ। সেই সৃষ্টিশীলতার পিছনে ছিল শুধুই মানুষ। সমাজের নিচুতলার মানুষের দল। একেবারে কৈশোরে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যোগ দিয়েছেন নানা আন্দোলনে ।কলকাতায় এসে আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় সেখানে রবীন্দ্রনাথের নাটক অভিনয় করেছিলেন। তাঁর গান ও কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও। একদিন তাঁর ডাকেই নেমে পড়লেন লবণ আইন ভঙ্গ আন্দোলনে। তারপর থেকেই শুরু হল তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যিকদের সঙ্গে ওঠাবসা। শুরু করছিলেন 'অনামী চক্র' নামে এক আড্ডা। এই সময় থেকেই বিজন ভট্টাচার্য শুরু করেছিল কবিতা লেখা। লিখলেন, -
"শুরু হোক
পৃথিবীর বুকে পলাশের রক্তে রাঙা
বসন্তের নতুন সংলাপ। "
তখনই বোঝা গিয়েছিল এক নতুন সংলাপের পথে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে যেতে চান। লিখলেন বেশ কিছু ছোট গল্প এবং চার পাঁচটি উপন্যাস। সেসব সাহিত্যের মূল বিষয় ছিল মধ্যবিত্তের সংকট, হতাশা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচে দগ্ধ জীবন, কিংবা উচ্চবিত্তের লোলুপতা। প্রশংসা আসছিল, তবু যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। শুধু মনে হচ্ছিল হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে।
#তখনই তাঁর মনে হয়েছে নাটক ই হল তাঁর সেই মাধ্যম, যেখানে তিনি মনের ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে একটা আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন। সময়ের পরিপেক্ষিত তাঁর মধ্যে তৈরী করে দিল এক দ্বায়বদ্ধতা। অসহায় দরিদ্র মানুষের কাছে 'রিলিফ' পৌঁছে দেওয়া দরকার। 'ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ' গঠন করে একটি নাটক অভিনয় করালেন। সেজন্য নিজেই লিখে ফেললেন নাটক 'জবানবন্দী '।নিম্ন চাষিদের যন্ত্রনার কথা উঠে এল সে নাটকে। 'নবান্ন' যদি মহীরুহ হয়, 'জবানবন্দী ' তবে চারাগাছ।
#গঙ্গাপদ বসুর লেখা থেকে 'নবান্ন' রচনার পরিপ্রেক্ষিতটি জানা যায়। দুজনেই তখন একটা সংবাদ পত্রে পাশাপাশি বসে কাজ করতেন। সংবাদ পত্রে চাকরির পাশাপাশি মনে হত, আরও কিছু কাজ করা দরকার। সময়কে ঠিক মতো ধরতে পারছে না সংবাদপত্র। তখন কলকাতা জুড়ে 'ফ্যান দাও 'কান্না। রাস্তায় অনাহারে মৃত মানুষের দেহ পড়ে আছে। জাপানি বোমার আতঙ্ক, কালোবাজারিরা সেই সুযোগে মুনাফা লুটছে, সে এক বিষমকাল। ব্রিটিশ নিষেধাজ্ঞাণয় সংবাদ পত্রে তার কোনও চিহ্নই ফুটে উঠছে না। নিয়ম ভেঙে স্টেটসম্যান কাগজে প্রথম দুর্ভিক্ষের খবর ছাপানো হল। গঙ্গাপদ বসু একদিন দেশে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে যখন তিনি কাজে যোগ দিলেন, বিজন তাঁকে দেশের কৃষকদের হাল জিজ্ঞাসা করলেন। চাষীদের সংকটের কথা শুনলেন। তখনই বিজনের মনে ঝিলিক দিয়ে গেল নবান্ন'। নয়-দশ দিনের মধ্যে লিখে ফেললেন নাটকটা। গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় শ্রীরঙ্গমে মঞ্চস্থ হয় ১৯৪৪ সালে ২৪ অক্টোবর। সে নাটক অভিনয়ের পর অভিনয়ে ভেসে গেল ।পৌঁছে গেল শ্রমিকদের কাছে, চাষিদের কাছে। তৎকালীন বোম্বাইয়ে যখন সে নাটক কারখানায় শ্রমিকদের সামনে অভিনীত হল, তখন ভাষার প্রাচীর ভেঙে সে নাটক পৌঁছে গেল তাদের হৃদয় পুরে ।শম্ভু মিত্র এ নাটককে 'এপিক ড্রামা' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
#তবে এই যে গণনাটে্যর উন্মেষ তা বেশিদিন স্থায়ী হল না। পারস্পরিক মতাদর্শগত কারণে তা ভেঙে গেল এবং শুরু হল নবনাট্যএর কাল।বাস্তবতা না শিল্প, কোনটা প্রধান, এই তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে প্রাথমিক মতান্তর। ফলে নতুন নতুন নাট্য সংগঠন তৈরি হতে লাগল। ১৯৪৮ সালে শম্ভু মিত্রা তৈরি করলেন 'বহুরূপী ',১৯৫০ সালে উৎপল দত্ত তৈরি করলেন 'লিটিল থিয়েটার গ্রুপ ' এবং১৯৫১ সালে বিজন ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠা করলেন 'ক্যালকাটা থিয়েটার। অসংখ্য একাঙ্ক নাটকের পাশাপাশি লিখেছেন 'জতুগৃহ ','গোত্রান্তর', ছায়াপথ', দেবীগর্জন', 'গর্ভবতী জননী'।
#এর ফাঁকে ১৯৪৬ সালে। বিয়ে করলেন কবি মনীশ ঘটকের মেয়ে মহাশ্বেতা দেবীকে। তারপরেই বোম্বাই চলে গেলেন। রুটির সন্ধানে বোম্বাইয়ে চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু করলেন। তাঁর লেখা গীতিনাট্য 'জিয়নকন্যা' নিয়ে বলিউডে তৈরি হয় ফিল্ম 'নাগিন'। কিন্তু কলকাতার নাটক ছেড়ে প্রবাসে মন বসল না। ফিরে এলেন কলকাতায়। আবার শুরু হল নাটক আর অভিনয়।
#বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। মেঘে ঢাকা তারা', 'বাড়ি থেকে পালিয়ে ',সুবর্ণরেখা ইত্যাদি। পাশাপাশি নাটক লেখা আর অভিনয়। একটা সময় ছেড়ে দিলেন 'ক্যালকাটা' থিয়েটার। ১৯৭৹ সালে তৈরি করলেন নতুন দল, 'কবচকুণ্ডল'। একে একে অভিনয় করলেন 'আজ বসন্ত', 'মরাচাঁদ', 'লাশ ঘুইরা যাউক', 'চলো সাগরে '।১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। আগের দিন রাতেও তিনি 'মরাচাঁদ' নাটকে পবনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটকের সংলাপই যেন ছিল তাঁর জীবন মন্ত্র---
"বাঁচবো রে আমরা বাঁচবো "।
♦অালোচক -- সুসমিতা বেরা ♦
♦মডারেটর সাকসেস বাংলা♦
#ছেলেবেলা থেকেই এক নাট্য পরিমণ্ডলে তাঁর বেড়ে ওঠা।পরিবারে ছিল সাহিত্য, সঙ্গীত এবং নাট্যচর্চার আবহ। বাড়িতেই পরিবারের সবাই মিলে অভিনয় করতেন। হয়তো কোনোদিন শেক্সপিয়রের 'মার্চেন্ট অব ভেনিস 'এর কিছুটা অংশ হল। ছেলেটির বাবা করতেন শাইলকের চরিত্র, মা করতেন পোর্শিয়ার চরিত্র এবং আর তাঁরা নয় ভাইবোনের মধ্যে কেউ কেউ অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করতেন। এইভাবে ছেলেবলে থেকেই তাঁর মধ্যে তৈরী হয়েছিলো সাহিত্য এবং নাটকের প্রতি অনুরাগ। এই ছেলেটিই বিজন ভট্টাচার্য।
#বিজন ভট্টাচার্যের নাম করলেই একটা নতুন যুগের সূচনার কথা আমাদের মনে আসে। সেটা হল 'নবান্ন'। ইতিহাস সৃষ্টি করা এই একটি নাটকের জন্যই তিনি নট্যমঞ্চ বা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করতে পারতেন। আমরা যাকে গণনাট্য বা নবনাট্য নামে অভিহিত করি, সেই ধারায় এক যুগান্তর সৃষ্টি করেছিল 'নবান্ন' নাটকটি।
#বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যচর্চার সূচনা হয়েছিল তাঁর বাবার কাছে, শেক্সপিয়রের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তাঁর ভিতরে ভিতরে যেন একটা অদৃশ্য টানতৈররি হয়ে গিয়েছিল দেশজ শিল্পের প্রতি। গ্রামীণ জীবনের মানুষ লোকশিল্পের যেসব আঙ্গিকের মধ্যে তাদের বিনোদন খুঁজে পেত, সেসব আঙ্গিকের দিকেই তাঁর গভীর টান ছিল। গ্রাম্য যাত্রা, লোকনাট্য, আঞ্চলিক নাটক এসব তিনি অনেক দেখেছেন এবং তার মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে তৈরি হয়েছে তাঁর মানসিক গঠন। তাই তাঁর কবিতা, উপন্যাস, নাটক এসবের মধ্যে ছাপ পড়েছে এবং একটা ভাঙাচোরা পরিবর্তনশীল যুগের মধ্যে দাঁড়িয়ে সেই সৃষ্টি মানুষের প্রাণের কাছে গ্ৰাহ্য হয়ে উঠেছিল।
#১৯১৫ সালের ১৭ই জুলাই তিনি জন্মেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের ফরিপুর জেলার খানখানাপুর গ্রামে। এ বিষয়ে মতান্তর আছে। বাবা ক্ষীরোদবিহারী ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মা সুবর্ণপ্রভা ছিলেন সংস্কৃতিমনা এক নারী। বাবার ছিল বালির চাকরি। কখনও ফরিদপুর, কখনও বসিরহাট, কখন ও মেদিনীপুর, আবার কখন ও সাতক্ষীরা বা আড়বেলে তিনি বদলি হতেন। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতেন ছোট্ট বিজন। বাবা যে স্কুলে পড়াতেন তিনিও সেই স্কুলে ভরতি হতেন। এর একটা অন্যতর দিক ছিল, যেটা তাঁকে অনেক বেশী শিক্ষিত করে তুলেছিল। সেটা হল বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরনের মানুষ তিনি দেখেছিলেন। দেখেছিলেন তাদের জীবন, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি।শিখেছিলেন তাদের ভাষা। গ্রামীণ লোকায়ত জীবনের মধ্যে এভাবে জড়িয়ে পড়তে পড়তেই তাঁর অবচেতন মনে তৈরি হয়ে যাচ্ছিল সৃষ্টিশীলতার এক বীজ। সেই সৃষ্টিশীলতার পিছনে ছিল শুধুই মানুষ। সমাজের নিচুতলার মানুষের দল। একেবারে কৈশোরে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলস্রোতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। যোগ দিয়েছেন নানা আন্দোলনে ।কলকাতায় এসে আশুতোষ কলেজে পড়ার সময় সেখানে রবীন্দ্রনাথের নাটক অভিনয় করেছিলেন। তাঁর গান ও কবিতা শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম ও। একদিন তাঁর ডাকেই নেমে পড়লেন লবণ আইন ভঙ্গ আন্দোলনে। তারপর থেকেই শুরু হল তাঁর বিভিন্ন সাহিত্যিকদের সঙ্গে ওঠাবসা। শুরু করছিলেন 'অনামী চক্র' নামে এক আড্ডা। এই সময় থেকেই বিজন ভট্টাচার্য শুরু করেছিল কবিতা লেখা। লিখলেন, -
"শুরু হোক
পৃথিবীর বুকে পলাশের রক্তে রাঙা
বসন্তের নতুন সংলাপ। "
তখনই বোঝা গিয়েছিল এক নতুন সংলাপের পথে তিনি তাঁর সৃষ্টিকে নিয়ে যেতে চান। লিখলেন বেশ কিছু ছোট গল্প এবং চার পাঁচটি উপন্যাস। সেসব সাহিত্যের মূল বিষয় ছিল মধ্যবিত্তের সংকট, হতাশা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঁচে দগ্ধ জীবন, কিংবা উচ্চবিত্তের লোলুপতা। প্রশংসা আসছিল, তবু যেন তৃপ্তি পাচ্ছিলেন না। শুধু মনে হচ্ছিল হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে।
#তখনই তাঁর মনে হয়েছে নাটক ই হল তাঁর সেই মাধ্যম, যেখানে তিনি মনের ভাবে ছড়িয়ে দিয়ে একটা আন্দোলনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেন। সময়ের পরিপেক্ষিত তাঁর মধ্যে তৈরী করে দিল এক দ্বায়বদ্ধতা। অসহায় দরিদ্র মানুষের কাছে 'রিলিফ' পৌঁছে দেওয়া দরকার। 'ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘ' গঠন করে একটি নাটক অভিনয় করালেন। সেজন্য নিজেই লিখে ফেললেন নাটক 'জবানবন্দী '।নিম্ন চাষিদের যন্ত্রনার কথা উঠে এল সে নাটকে। 'নবান্ন' যদি মহীরুহ হয়, 'জবানবন্দী ' তবে চারাগাছ।
#গঙ্গাপদ বসুর লেখা থেকে 'নবান্ন' রচনার পরিপ্রেক্ষিতটি জানা যায়। দুজনেই তখন একটা সংবাদ পত্রে পাশাপাশি বসে কাজ করতেন। সংবাদ পত্রে চাকরির পাশাপাশি মনে হত, আরও কিছু কাজ করা দরকার। সময়কে ঠিক মতো ধরতে পারছে না সংবাদপত্র। তখন কলকাতা জুড়ে 'ফ্যান দাও 'কান্না। রাস্তায় অনাহারে মৃত মানুষের দেহ পড়ে আছে। জাপানি বোমার আতঙ্ক, কালোবাজারিরা সেই সুযোগে মুনাফা লুটছে, সে এক বিষমকাল। ব্রিটিশ নিষেধাজ্ঞাণয় সংবাদ পত্রে তার কোনও চিহ্নই ফুটে উঠছে না। নিয়ম ভেঙে স্টেটসম্যান কাগজে প্রথম দুর্ভিক্ষের খবর ছাপানো হল। গঙ্গাপদ বসু একদিন দেশে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে যখন তিনি কাজে যোগ দিলেন, বিজন তাঁকে দেশের কৃষকদের হাল জিজ্ঞাসা করলেন। চাষীদের সংকটের কথা শুনলেন। তখনই বিজনের মনে ঝিলিক দিয়ে গেল নবান্ন'। নয়-দশ দিনের মধ্যে লিখে ফেললেন নাটকটা। গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় শ্রীরঙ্গমে মঞ্চস্থ হয় ১৯৪৪ সালে ২৪ অক্টোবর। সে নাটক অভিনয়ের পর অভিনয়ে ভেসে গেল ।পৌঁছে গেল শ্রমিকদের কাছে, চাষিদের কাছে। তৎকালীন বোম্বাইয়ে যখন সে নাটক কারখানায় শ্রমিকদের সামনে অভিনীত হল, তখন ভাষার প্রাচীর ভেঙে সে নাটক পৌঁছে গেল তাদের হৃদয় পুরে ।শম্ভু মিত্র এ নাটককে 'এপিক ড্রামা' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
#তবে এই যে গণনাটে্যর উন্মেষ তা বেশিদিন স্থায়ী হল না। পারস্পরিক মতাদর্শগত কারণে তা ভেঙে গেল এবং শুরু হল নবনাট্যএর কাল।বাস্তবতা না শিল্প, কোনটা প্রধান, এই তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে প্রাথমিক মতান্তর। ফলে নতুন নতুন নাট্য সংগঠন তৈরি হতে লাগল। ১৯৪৮ সালে শম্ভু মিত্রা তৈরি করলেন 'বহুরূপী ',১৯৫০ সালে উৎপল দত্ত তৈরি করলেন 'লিটিল থিয়েটার গ্রুপ ' এবং১৯৫১ সালে বিজন ভট্টাচার্য প্রতিষ্ঠা করলেন 'ক্যালকাটা থিয়েটার। অসংখ্য একাঙ্ক নাটকের পাশাপাশি লিখেছেন 'জতুগৃহ ','গোত্রান্তর', ছায়াপথ', দেবীগর্জন', 'গর্ভবতী জননী'।
#এর ফাঁকে ১৯৪৬ সালে। বিয়ে করলেন কবি মনীশ ঘটকের মেয়ে মহাশ্বেতা দেবীকে। তারপরেই বোম্বাই চলে গেলেন। রুটির সন্ধানে বোম্বাইয়ে চিত্রনাট্য লেখার কাজ শুরু করলেন। তাঁর লেখা গীতিনাট্য 'জিয়নকন্যা' নিয়ে বলিউডে তৈরি হয় ফিল্ম 'নাগিন'। কিন্তু কলকাতার নাটক ছেড়ে প্রবাসে মন বসল না। ফিরে এলেন কলকাতায়। আবার শুরু হল নাটক আর অভিনয়।
#বেশ কিছু চলচ্চিত্রে তিনি অভিনয় করেছেন। মেঘে ঢাকা তারা', 'বাড়ি থেকে পালিয়ে ',সুবর্ণরেখা ইত্যাদি। পাশাপাশি নাটক লেখা আর অভিনয়। একটা সময় ছেড়ে দিলেন 'ক্যালকাটা' থিয়েটার। ১৯৭৹ সালে তৈরি করলেন নতুন দল, 'কবচকুণ্ডল'। একে একে অভিনয় করলেন 'আজ বসন্ত', 'মরাচাঁদ', 'লাশ ঘুইরা যাউক', 'চলো সাগরে '।১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। আগের দিন রাতেও তিনি 'মরাচাঁদ' নাটকে পবনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটকের সংলাপই যেন ছিল তাঁর জীবন মন্ত্র---
"বাঁচবো রে আমরা বাঁচবো "।
♦অালোচক -- সুসমিতা বেরা ♦
♦মডারেটর সাকসেস বাংলা♦