ঔপন্যাসিক যখন নাট্যকার :: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।


ঔপন্যাসিক যখন নাট্যকার :: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
---------------------------------------------------
নাট্যকার শরৎচন্দ্র:
* শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মূলত ঔপন্যাসিক,  তাই তাঁর শিল্পী মানস উপন্যাস ও ছোটগল্পকে অবলম্বন করে যতখানি আত্মপ্রকাশ করেছে অন্যত্র ততখানি নয়। কথা সাহিত্যের জগতে তাঁর সাবলীল বিচরণ বলেই তিনি কথাশিল্পী বিস্তৃত পটভূমিকায় বিশাল কোন ভাববস্তু বর্ণনাতেই তিনি অধিকতর মানসিক সুখানুভূতি লাভ করেন।
* কিন্তু ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার ও প্রাবন্ধিক শরৎচন্দ্র একজন নাট্যকারও বটে। ঔপান্যাসিক শরৎচন্দ্রের নাট্যকার হয়ে ওঠা কোন আকস্মিক ঘটনা নয়। শরৎচন্দ্রের বাল্য এবং কৈশরের জীবনের নানা ঘটনা বহুল কাহিনীর পেছনে লুকিয়ে আছে তার নাট্যকার সত্তা। শরৎচন্দ্রের জীবনী থেকে জানা যায় যে, তিনি খুব অল্প বয়স থেকে গান বাজনা এবং নাট্যাভিনয়ের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। এমনকি ভাগলপুর যাওয়ার পূর্বে একটি যাত্রা দলের প্রত্যক্ষ্য সংস্পর্শেও এসেছিলেন।
* শরৎচন্দ্র অবশ্য কোন মৌলিক নাটক রচনা করেন নি। তাঁর জনপ্রিয় কয়েকটি উপন্যাসের নাট্যরূপ তিনি নিজেই দিয়েছিলেন। নাটকের প্রতি শরৎচন্দ্রের একটা সুপ্ত আকর্ষণ প্রথম থেকেই ছিল। শরৎচন্দ্র যখন সাহিত্য প্রতিভার মধ্যগগনে তখন পেশাদার রঙ্গমঞ্চের পৃষ্টপোষকদের কাছ থেকে নাটক লেখার জন্য বিশেষ অনুরোধ আসতে শুরু করে। এর সঙ্গে ছিল শিশির কুমার ভাদুড়ী মহাশয়ের অদম্য উৎসাহ। শিশির বাবুর আগ্রহেই তিনি "দেনাপাওনা" উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়ে নাট্যকার জীবনের সূত্রপাত ঘটান।
* ১৯২৭ খ্রিঃ ১৩ আগষ্ট শরৎচন্দ্র কৃত 'দেনাপাওনা' উপন্যাসের নাট্যরূপ 'ষোড়শী'র আত্মপ্রকাশ ঘটে 'ভারতী' পত্রিকায়। তবে জানা যায় 'ষোড়শী"র নাট্যরূপ দানের কৃতিত্ব শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একার নয়। সৌরিন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় তাঁর "শরৎচন্দ্রের জীবনরহস্য" গ্রন্থে জানিয়েছেন  'দেনাপাওনা' উপন্যাসের নাট্যরূপ প্রথমে শ্রীশিবনাথ চক্রবর্তী দিয়েছিলেন। শরৎচন্দ্র সেই লেখা আগাগোড়া পরিমার্জন করে শরৎচন্দ্রের নামেই "ষোড়শী' নামে 'ভারতী'তে প্রকাশিত হল এক সংখ্যাতেই সমগ্রভাবে। নাটক বাবদ 'ভারতী'র তরফ থেকে সম্পাদিকা সরলা দেবী শরৎচন্দ্রকে তিনশো টাকার চেক দেন। এ টাকা থেকে শরৎচন্দ্র অবশ্য শিবরামকে একশো টাকা দিয়েছিলেন।
* সে যাই হোক বাংলা ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের ২২ শে শ্রাবণ শনিবার নাট্যমন্দিরে 'ষোড়শী' প্রথম অভিনিত হয়েছিল। প্রথম রজনীতে যারা অভিনয় করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন শিশির কুমার ভাদুড়ি (জীবানন্দ), যোগেশ চৌধুরী(জনার্দন রায়), চারুশীলা(ষোড়শী), জীবানন্দের ভূমিকায় শিশির কুমার অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। এক কথায় "ষোড়শী" একটি মঞ্চসফল নাটক।
* "ষোড়শী" নাটকের অসাধারণ অভিনয় সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে শরৎচন্দ্র ১৯২৭ খ্রীঃ "পল্লীসমাজ" উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন "রমা"। উল্লেখ্য শরৎচন্দ্রের এই নাটকটিও তাঁর একার দেওয়া নাট্যরূপ নয়। "রমা" নাটকের প্রথমে নাট্যরূপ দেন হরিদাস চট্টোপাধ্যায় এবং পরিমার্জন করে দেন শরৎচন্দ্র। রমা প্রথমে আর্ট থিয়েটার কর্তৃক স্টার রঙ্গমঞ্চে অভিনিত হয়। পরবর্তীকালে শিশির কুমার ভাদুড়ির সুদক্ষ পরিচালনায় নাট্যমন্দিরে আরো সাফল্যের সাথে অভিনিত হয়।
* "দত্তা" উপন্যাসের নাট্যরূপ হল "বিজয়া"। বিজয়া নাটক সম্পর্কে শরৎচন্দ্র অবিনাশ ঘোষালকে বলেছিলেন -- "বিজয়া যদিও দত্তা থেকে নেওয়া কিন্তু আমি অনেক কিছু বদলে এক রকম একখানি নতুন নাটক লিখে দিয়েছি।"
* 'ষোড়শী', 'রমা' ও 'বিজয়া' এই তিনটিই শরৎচন্দ্রের পূর্ণাঙ্গ নাটক। আরো কতকগুলি উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলেন। কিন্তু নানা কারণে তা শেষ করতে পারেন নি। "বামুনের মেয়ে" উপন্যাসের নাট্যরূপ দু-এক দৃশ্যের বেশি এগোয়নি। শিশির কুমারের অনুরোধের 'নববিধান' উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু শিশির বাবু অসুস্থ হয়ে পড়লে তা বন্ধ হয়ে যায়। আবার শিশির বাবুর অনুরোধেই "অচলা" নাম দিয়ে 'গৃহদাহ' উপন্যাসের নাট্যরূপ দেওয়া শুরু করেন। কিন্তু এবার শরৎচন্দ্র নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়লে সে কাজও আর দু-অঙ্কের বেশি এগোয়নি। পরবর্তীকালে শিশির কুমার "অচলা" নাটকের নাট্যরূপ যতীন্দ্রনাথ রায়কে দিয়ে সম্পন্ন করেছিলেন। অবশ্য নাটকটি তেমন মঞ্চ সফল হয়নি।

আলোচক – সুশান্ত কর্মকার
অ্যাডমিন, সাকসেস বাংলা 

Share this