সংক্ষিপ্ত চৈতন্যজীবনী সাহিত্য
-------------------------------
"যদি গৌর না হইত তবে কি হইত
কেমনে ধরিতাম দে ।
রাধার মহিমা প্রেম রস সীমা
জগতে জানাত কে ।।"
শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রথম বাঙালি যাঁকে কেন্দ্র করে বাংলা সাহিত্যে প্রথম জীবনী সাহিত্য গড়ে ওঠে। একটি মানুষের জীবন তখনি জীবনী হয়ে ওঠে যখন জীবনের পরিপূর্ণতায়, অসাধারণ জীবনমাহাত্ম্যে ও সমাজ জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করে। ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী সাহিত্য বাংলা সাহিত্য ধারায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়েছিল। এর মাধ্যমে বাংলা কাব্যে দেবদেবীর মাহাত্মগাঁথা স্তুতিমূলক ধারা থেকে বেরিয়ে রক্তমাংসের মানুষের গুণগান, প্রেম-বিরহ, সুখ-দুঃখের বর্ণনা শুরু হয়। বাংলা সাহিত্যে একাধিক কবি চৈতন্য মহাপ্রভুর জীবনী অবলম্বনে কাব্য রচনা করেছেন। যদিও সর্বপ্রথম মুরারি গুপ্ত সংস্কৃত ভাষায় ধারাবাহিক ভাবে চৈতন্যজীবনী রচনা করেন, যা ‘মুরারি গুপ্তের কড়চা’ নামে পরিচিত। কাব্যেটির প্রকৃত নাম ছিল “শ্রীশ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃতম্”। এরপর পরমানন্দ সেন কবি কবিকর্ণপুরে'র লেখা জীবনী-কাব্য ও নাটকখানি সুপ্রসিদ্ধ।
চৈতন্য ভাগবত:-
বাংলা ভাষার প্রথম চৈতন্য জীবনী কাব্য হল 'চৈতন্যভাগবত' কব্যটি রচনা করেন বৃন্দাবন দাস। কাব্যটি শ্রীচৈতন্য দেবের তিরোধানের অল্প কিছুকাল পরেই রচিত হয়। বৃন্দাবন দাস এই কাব্যটি রচনা করেছিলেন তাঁর গুরু নিত্যানন্দ প্রভুর উৎসাহে।
'চৈতন্যভাগবত' গ্রন্থটি নানাদিক দিয়ে এক মাহামূল্যবান গ্রন্থ। এটি বাংলা ভাষায় রচিত চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রথম জীবনী কাব্য। চৈতন্যভাগবত তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। আদি, মধ্য ও অন্ত্য খণ্ড। আদিখণ্ডে রয়েছে চোদ্দোটি অধ্যায়, মধ্যখণ্ডে রয়েছে ছাব্বিশটি অধ্যায়, (সুকুমার সেনের মতে ২৭ টি অধ্যায়) এবং অন্ত্যখণ্ডে রয়েছে দশটি অধ্যায়। আদিখণ্ডে গৌরাঙ্গের জন্ম, বাল্যলীলা, অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা, বিবাহ, গয়াগমন প্রভৃতি নানা ঘটনার সমাবেশ হয়েছে। মধ্যখণ্ডে গৌরাঙ্গের নবদ্বীপলীলা, সন্ন্যাসগ্রহণে পরিসমাপ্ত এবং অন্ত্যখণ্ডে নীলাচলে গমন, গৌড়ীয় ভক্তদের সঙ্গে মিলন ও সেখানকার চৈতন্য লীলার আংশিক বিবরণ মেলে।
গুরুত্ব: চৈতন্যভাগবত একটি মানব রস সমৃদ্ধ জীবনী কাব্য। চৈতন্য জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রসূত অনেক ঘটনা বৃন্দাবন দাস যথাযথ ও অনুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছেন। এই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ঠ হল এই গ্রন্থের ঐতিহাসিক মূল্য। চৈতন্যভাগবতে ষোড়শ শতাব্দীর নবদ্বীপ তথা গৌড়বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অবস্থা অত্যন্ত বাস্তবানুগ ভাষায় বর্ণনা করা হয়েছে। চৈতন্যভাগবতের মধ্যদিয়েই বাংলা জীবনীসাহিত্যের দ্বার উদ্ঘাটন করে মানুষের আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলার কাজে বৃন্দাবন দাসই ছিলেন পথিকৃৎ। এই জন্য বৃন্দাবন দাস বৈষ্ণব সমাজে 'চৈতন্য লীলার ব্যাস' বলে সম্মানিত হয়েছেন।
চৈতন্যমঙ্গল:-
চৈতন্যমঙ্গল নামে চৈতন্যের জীবনীকাব্য রচনা করেন দুজন লোচনদাস ও জয়ানন্দ। লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল চারটি খণ্ডে বিভক্ত-- সূত্রখণ্ড, আদিখণ্ড, মধ্যখণ্ড ও শেষখণ্ড। কাব্যটির ছত্র সংখ্যা প্রায় এগারো হাজার। লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল সাধারণত গান করবার উদ্দেশ্যে রচিত হয়। অনেকটা মঙ্গল কাব্যের ঢঙে রচিত। সূত্র খণ্ড চৈতন্য মঙ্গলে অতিরিক্ত।
চৈতন্যচরিতামৃত:-
কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ একটি শ্রেষ্ঠ চৈতন্যজীবনী গ্রন্থ। বৈষ্ণব সাহিত্যে গ্রন্থটি দর্শন, কাব্য ও ইতিহাসের একটি আকর গ্রন্থ। সুকুমার সেনের মতে গ্রন্থটির রচনা কাল ১৫৬০-১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্য। *'চৈতন্যভাগবত'এর মতো 'চৈতন্যচরিতামৃত'ও তিনটি খন্ডে বিভক্ত আদি, মধ্য ও অন্ত্য; এবং এগুলির সর্গসংখ্যা যথাক্রমে সাতের, পঁচিশ ও কুড়ি। মোট অধ্যায় বাষট্টি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যভাগবতের মতো আদি ও মধ্যলীলা বিশদ ভাবে বর্ণনা করেন নি। তিনি মূলতঃ শ্রীচৈতন্যের নীলাচলে অন্তলীলা বর্ণনায় মনোনিবেস করেছিলেন। আদি লীলায় বৈষ্ণবীয় দর্শন, চৈতন্যাবতারের প্রয়োজনীয়তা, নিত্যানন্দের সঙ্গে মহাপ্রভুর পরিচয়, চৈতন্যের বাল্যলীলা, কৈশোর ও সন্ন্যাস বর্ণিত হয়েছে। মধ্যলীলায় আছে সন্ন্যাস গ্রহণের পর মহাপ্রভুর নীলাচলে অবস্থান পর্যন্ত ছয় বছরের কথা। এই অংশ কৃষ্ণদাস গ্রহণ করেছেন বৃন্দাবন দাস, মুরারি গুপ্ত ও কবি কর্ণপুরের সংস্কৃত গ্রন্থ থেকে। অন্ত্যলীলায় চৈতন্যদেবের নীলাচলের শেষ সতেরো-আঠারো বছরের লীলা বর্ণিত হয়েছে। এই সময়ে মহাপ্রভুর দিব্যোন্মাদ অবস্থা। এই লীলাবর্ণনায়, তত্ত্ববিশ্লেষণে, তথ্যনিষ্ঠায়, আপন ভাবমাহাত্ম্যে কৃষ্ণদাস অভাবনীয় সার্থকতা লাভ করেছেন।
গুরুত্ব: চৈতন্যচরিতামৃত শুধু একটি আখ্যান বা জীবনী গ্রন্থ নয়। এটি একটি তত্ত্বগ্রন্থও। চৈতন্য জীবনের গভীতর তাৎপর্য, ভক্তিশাস্থ, দর্শন ও গৌড়িয় বৈষ্ণবধর্মের মূল তত্বকথা অতি সরল ভাষায় ব্যাখ্যাত হয়েছে। অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্যজীবনের প্রেক্ষাপটে গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের ব্যাখ্যা ও বিচার বিশ্লেষণ করেন। ব্যক্তি চৈতন্যের আদর্শ ও তাঁর প্রবর্তিত ভক্তিধর্মের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে এই গ্রন্থটিতে। মধ্যযুগের অন্য কোনো কাব্য বিষয় মাহাত্ম্যে, অকৃত্রিমতায়, তথ্যনিষ্ঠায়, সরল প্রাঞ্জল বাক্যগুণে, দর্শন, ইতিহাস ও কাব্যের অভূতপূর্ব সমন্বয়ে এমন গৌরব অর্জন করতে পারেনি। বৈষ্ণবধর্মের একটি আকর গ্রন্থ হিসেবেও তাই চৈতন্যচরিতামৃতের মূল্য অনস্বীকার্য।
আলোচক - সুশান্ত কর্মকার
অ্যাডমিন, সাকসেস বাংলা