বৈষ্ণব পদাবলী

■ বৈষ্ণব পদাবলী:-

● পদাবলী শব্দের উৎস:- বিষ্ণু যাঁদের উপাস্য দেবতা তাঁদের বৈষ্ণব আখ্যায় ভূষিত করা হয়।
¤ পদাবলী কথাটির মধ্যে পদ শব্দটি গান বা গীতিকে বোঝায়।
¤খ্রি:পূর্ব যুগে রামায়ণ , মহাভারত এবং হরিবংশতে গান বা গীত অর্থে " পদ" শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
¤ খ্রি: দ্বিতীয় শতকে লেখা ভরতের নাট্যশাস্ত্রে এই গীত অর্থেই পদ শব্দটির ব্যবহার দেখা যায় ২৮ নং অধ্যায়ে।
¤ পদাবলী শব্দটি বলতে আজ আমরা যা বুঝি তার প্রথম ব্যবহার জয়দেবের গীতগোবিন্দে " মধুরকোমলকান্ত পদাবলীং শৃনুতদা জয়দেবসরস্বতীম"।
¤ সপ্তদশ শতাব্দীর আলংকারিক আচার্য দন্ডী পদসমুচ্চয় অর্থে পদাবলী শব্দের প্রয়োগ করেছেন।
¤বাংলা দেশে রাধাকৃষ্ণ লীলা কথার গান একটি সুসম্পূর্ণ কাব্যের আধারে জয়দেবই প্রথম আমাদের উপহার দিয়েছেন।

● পদাবলীর বিভাগ:- গোপাল হালদার মহাশয় তাঁর" বাঙ্গালা সাহিত্যের রূপরেখা" গ্রন্থে পদাবলীকে চারভাগে ভাগ করেছেন।:-
১।গৌরপদাবলী:- এতে শ্রীচৈতন্য কে কৃষ্ণের অবতার বলা হয়েছে।
২।ভজন পদাবলী:- এতে রয়েছে গুরু মহাজনদের প্রতি বন্দনা গীত।
৩।রাধাকৃষ্ণ পদাবলী:- বাংলা পদাবলী সাহিত্যে এই শ্রেণির পদ সংখ্যাই বেশি।এতে মধুর রসের প্রাধান্য।
৪।রাগাত্মিক পদাবলী:- সাধনতত্ব বিষয়ক পদ রয়েছে এতে।

● বৈষ্ণব পদাবলীর বৈশিষ্ট্য:-
¤ বৈষ্ণব পদাবলীর মূল কথা ব্রজলীলা।
¤ এর প্রধান রস শৃঙ্গার।
¤ মানবী প্রেমের ভাগবতী শক্তিতে রূপান্তরই বৈষ্ণব পদকর্তাদের একমাত্র সাধনা।

● রাধাকৃষ্ণ তত্ত্ব:- বৈষ্ণব সাহিত্য রাধাময়। কৃষ্ণের অন্যান্য নায়িকার মধ্যে রাধাকেই তারা সর্বশ্রেষ্ঠা হিসেবে দেখেছেন।
¤ রূপগোস্বামী তাঁর উজ্বলনীলমনি গ্রন্থে কৃষ্ণ প্রেমিকাদের স্বকীয়া ও পরকীয়া এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করেছেন।স্বকীয়া নায়িকারা হলেন রূক্মিনী,সত্যভামা,জাম্ববতী,কালিন্দী,শৈব্যা,কৌশল্যা ও মাদ্রী।এরা সবাই কৃষ্ণের বিবাহিতা ও কৃষ্ণসেবা পরায়ণা পতিব্রতা নারী।
¤ পরকীয়া নায়িকা হলেন রাধা সহ ব্রজগোপী বৃন্দ।এদের মধ্যে বিবাহিতা সহ কুমারী নারী আছে।রাধা,চন্দ্রাবলী, ললিতা, বিশাখা হলেন পরকীয়া দের মধ্যে অন্যতম।এদের মধ্যে শ্রেষ্ঠা হলেন রাধা ও চন্দ্রাবলী।আবার এই দুজনের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠা হলেন রাধা।তার কৃষ্ণ প্রেম ব্যক্তিগত প্রাপ্তি , আত্মকামনা,আত্মসুখ বিবর্জিত।কৃষ্ণের সুখই তাঁর প্রধান সুখ।চন্দ্রাবলীর মধ্যে কিছুটা আত্মরতি আছে বলে তিনি শ্রেষ্ঠা নায়িকা হতে পারেন নি।

● কৃষ্ণের প্রধান শক্তি তিনটি:-
১।স্বরূপ শক্তি:- এই শক্তিতে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর আপন ভগবৎ অস্থিত্ব বজায় রাখে।
২।তটস্থ শক্তি:- শ্রীকৃষ্ণের সৃষ্ট অগনিত জীবের শক্তি।
৩।মায়া শক্তি:- আর যে শক্তি দ্বারা কৃষ্ণ বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড সৃষ্টি করেছেন।কৃষ্ণ নিজে সেই মায়া শক্তির অধীন নয়,তিনি মায়াধীশ।
● কৃষ্ণের স্বরূপ শক্তিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়:-
১।সৎ:- সৎ শক্তির নাম সন্ধিনী।তিনি যে দেবতা,এই শক্তির দ্বারা তিনি প্রকাশ করেন।
২।চিৎ:- চিৎ শক্তি হলো চেতনা।এর দ্বারা নিজের চৈতন্যময় অস্থিত্ব প্রকাশ করেন।
৩।আনন্দ:- এই শক্তি হলো হ্লাদিনী শক্তি।এই শক্তির দ্বারা কৃষ্ণ জগৎ জীবন সৃষ্টি করে তাঁর মাধুর্য উপলব্ধি ও আস্বাদন করার জন্য আনন্দ লীলায় ব্যাপৃত হন।রাধা চন্দ্রাবলী, ললিতা,বিশাখা প্রভৃতি তার হ্লাদিনী শক্তির মানবী রূপ।

● গোপীতত্ব:- বৈষ্ণব ধর্ম বা তত্বাদর্শে গোপীর স্থান অত্যন্ত উচ্চস্তরে।বৈষ্ণব ধর্মে গোপী ও সখী সমার্থক।ষোলোশত গোপিনী নিয়ে কৃষ্ণের রসকেলি জনসমাজে সুপ্রচলিত।এদের মধ্যে রাধা হলেন প্রধানা গোপী।

● রাগাত্মিকা ভক্তি:- রাগাত্মিকা ভক্তিতে থাকে স্বাতন্ত্রময়ী সেবা।রাধার প্রেম রাগাত্মিকা প্রেম।আত্মগত গভীর সহজাত যে প্রেম ভক্তি সেটাই রাগাত্মিকা ভক্তি।

● রাগানুগা ভক্তি:- রাগের অনুগ যে প্রেম সেটাই রাগানুগা।রাগানুগা ভক্তির মধ্যে বাঞ্চিতকে পাবার আকাঙ্খা তীব্র থাকে।

● কান্তাপ্রেম:- কান্তাপ্রেম প্রকৃতপক্ষে গোপীরই নিষ্কাম প্রেম।এখানে ভক্ত নিজেকে কান্তা ভাবেন।নিজেকে কৃষ্ণের কান্তা ভেবে যে প্রেম তার নাম কান্তা প্রেম।

● স্বকীয়া ও পরকীয়া তত্ত্ব:-
¤ তত্ত্বের দিক থেকে রাধা কৃষ্ণের পরকীয়া।কারণ রাধা কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি।শ্রীজীব গোস্বামী রাধার পরকীয়া তত্ত্ব স্বীকার করেননি।
¤লৌকিক আখ্যানে বৃষভানু সুতা অভিমন্যু পত্নী রাধা কৃষ্ণের কাছে পরকীয়া নারী।রাধা লৌকিক মতে আয়ান ঘোষের বিবাহিতা পত্নী।এই বিচারে রাধাকৃষ্ণ প্রেম পরকীয়া।
¤ কৃষ্ণদাস কবিরাজ রামানন্দ সংবাদে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে স্বয়ং মহাপ্রভূ পরকীয়া মতের সমর্থন করেন।-
" পরকীয়া ভাবে অতি রসের উল্লাস/ব্রজ বিনা ইহার অন্যত্র নাহি বাস"।রাধা প্রেমই পরকীয়া প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
¤¤¤¤¤¤☆¤¤¤¤¤¤¤

● তথ্য সূত্র:- সাহিত্যের ইতিহাস:- পার্থ চট্টোপাধ্যায়।বৈষ্ণবপদাবলী:- সনাতন গোস্বামী।

ধন্যবাদ
সুশান্ত সরকার
Success বাংলা"

Share this