রবীন্দ্রকাব্যের মূল সুর

রবীন্দ্রকাব্যের মূল সুর
===========================
"একটি মাত্র পরিচয় আমার আছে সে আর কিছুই নয়,আমি কবি মাত্র৷" -- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শৈশব থেকেই উপনিষদীয় আবহে লালিত রবীন্দ্রনাথের মনে সমগ্র জীবন ধরে একটি আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গী ক্রিয়াশীল ছিল৷ এছাড়াও জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি ছিল সেইসময়ের কোলকাতার একটি উল্লেখযোগ্য সাহিত্য ও সংস্কৃতির পীঠস্থান৷ ছেলেবেলায় ভৃত্যের অধীনে রবীন্দ্রনাথ জানালার ধারে গন্ডীবদ্ধ ব্রহ্মচর্য যাপন করেছেন৷ এই সময় জানালা দিয়ে প্রায়শই তাঁর কৌতুহলী মন উড়ে যেত বিস্তির্ণ নীলাকাশ, গাছপালা, মানুষজন ও প্রকৃতির কোলে৷ কবি তাঁর সাহিত্যজীবনের চাবিকাঠি 'জীবনস্মৃতি' তে এই বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন৷
অতিশৈশব থেকেই একদিকে গভীর আধ্যাত্মবাদ, অন্যদিকে; অপরূপ বিশ্বপ্রকৃতি তাঁর কবিজীবনের ভিত্তি রচনা করেছে৷.আর তাই তো 'প্রভাতসঙ্গীতে'ই নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হল এভাবে -----
" হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি৷"
*     মানুষ পথিক, প্রেম তার পথের আলো...
কবির কাব্যজীবনের প্রেরণাদাত্রী যে তাঁর বৌঠান কাদম্বরী দেবী ছিলেন, সেকথাটি আজ আর কোনো রবীন্দ্রজিজ্ঞাসুর কাছেই অজানা নয়৷ ১৮৮৪ সালে কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু হয়৷ ইতিমধ্যে রবীন্দ্রনাথ তারই প্রেরণায় 'সন্ধ্যাসঙ্গীত'
,'প্রভাতসঙ্গীত','ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী' ও 'ছবি ও গান' ইত্যাদি কাব্য রচনা করেছেন৷
প্রসঙ্গত,কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কিরূপ সম্পর্ক ছিল, তা যারা কাদম্বরী দেবীর সুইসাইড নোটটি পড়েছেন তাদের কাছে অজ্ঞেয় নয়৷
মূলকথা, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর এই জগত ও জীবন সম্পর্কে কবির ধারনা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল৷ এই সময় থেকেই শুরু হল তাঁর কাব্যরচনার 'ঐশ্বর্য পর্ব'৷ বস্তুতঃ এই পর্ব থেকে কবির সঙ্গে একজন শিল্পী এসে যোগ দিলেন৷ কবি একসময় নিজেও বলেছেন; আমি যা লিখছি তা আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিচ্ছে, আমি যা বলছি তা আমাকে দিয়ে কেউ বলিয়ে নিচ্ছে --- এই অদৃশ্য শক্তিকে রবীন্দ্রনাথ কখনো বলেছেন 'মানসসুন্দরী' কখনো বলেছেন 'জীবনদেবতা'৷
তাঁর ঐশ্বর্য পর্বের চারটি কাব্যগ্রন্থ হল -
'মানসী', 'সোনার তরী', 'চিত্রা' ও 'চৈতালী'৷ নৈসর্গিক প্রেম,মানবপ্রেম ও সৌন্দর্যানুসন্ধান এই পর্বের মূলসুর৷ 'মানসী' প্রকৃতি প্রেমের কাব্য হলেও এই কাব্যে কবি আশা দিয়ে, ভাষা দিয়ে তাতে ভালোবাসার রঙ মিশিয়ে তুলির টানে এঁকেছেন মানসী প্রতিমাকে৷
এই প্রসঙ্গে অনেক রবীন্দ্রসমালোচক
ই মনে করেছেন যে, কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথের কবিচেতনা একটি ভাববাদী স্তরে পৌঁছে গিয়েছে৷ মানসীর সেই আবছা প্রেমের মূর্তিই ভেসে উঠেছে সোনার তরীতে৷
'সোনার তরী'র মাঝি, 'মানসসুন্দরী'র কর্ণধার এবং 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'র সুন্দরী নাবিকা অন্তর্লীন স্রোতে কবিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এক অজানা অন্তিম তটে৷ কবি তাই সেই রহস্যময়ীকে বলেছেন ---
"আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে
হে সুন্দরী?
বলো, কোন পার ভিড়িবে তোমার
সোনার তরী৷"
'চিত্রা' কাব্যের কবিতা গুলিতেও একদিকে মানবপ্রীতি, অন্যদিকে কবি তাঁর অন্তরতম সত্তার সন্ধান করেছেন -- 'এবার ফিরাও মোরে', 'জীবনদেবতা' ও 'অন্তর্যামী' ইত্যাদি কবিতায়৷
*     "সাত কোটি সন্তানেরে,হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি৷"
'চৈতালী' কাব্যে কবি প্রকৃতিপ্রেম ও সৌন্দর্যের ধ্যানে মগ্ন থাকলেও সংসার জীবনের প্রতি তাঁর গভীর মমত্তবোধ প্রকাশিত হয়েছে অনেক কবিতায়৷
"বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি,সে আমার নয়৷
অসংখ্য বন্ধন-মাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ!
... ... ... ... ... ... ...
ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসন,যে নহে আমার৷" (নৈবেদ্য)
এই পর্বটিকে রবীন্দ্রসমালোচকেরা বলেছেন 'ভাবনা পর্ব'৷আর অবশ্যই এই ভাবনা ঈশ্বর ভাবনা,প্রকৃতি ভাবনা,নারীভাবনা,মানবপ্রেম ও সর্বোপরী এক অদৃশ্যমান শক্তির প্রতি সৌন্দর্যানুভূতির ভাবনা৷
'কণিকা','কথা ও কাহিনী','কল্পনা
','ক্ষণিকা',নৈবেদ্য','স্মরণ','
শিশু','উত্সর্গ' ও 'খেয়া' ইত্যাদি কাব্য এই পর্বে লেখা৷ এই পর্বের কাব্যগুলির বহুমূখী বৈচিত্রতা লক্ষ্য করার মতো৷মূলত,ঐশ্বর্য পর্বে কবি যে ভাবটির সাধনা করেছেন;তা যেন এই পর্বের কাব্যগুলিতে পৃথক পৃথক ভাবে প্রকাশিত হয়েছে৷প্রকৃতপক্ষে; যে কবির হৃদয়ের কথা-- " চিত্ত যেথা ভয়শূণ্য; উচ্চ যেথা শির,"
তিনি যে জ্ঞানমার্গের নানা পন্থার কথা বলবেন,এটাই স্বাভাবিক৷আর তাই জড়তা ও ভয়কে ত্যাগ করে মাথা উঁচু করে পরবর্তী পর্বে কবি জ্ঞানের কথাই বললেন এভাবে--
" জগতে আনন্দ যজ্ঞে আমার নিমন্ত্রন
ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন৷৷"
আজ্ঞে হ্যাঁ; একথা আজ বলতে আর কোনো দ্বিধা নেই যে 'গীতাঞ্জলী পর্ব'টি রবীন্দ্রকাব্যধারায় এমন একটি পর্ব,যেখানে আমরা এক সাধক রবীন্দ্রনাথকে পাই৷'গীতাঞ্জলী'র গানগুলি আসলে দেবতার উদ্দেশ্যে অঞ্জলী নিবেদন করা ছাড়া আর কিছুই নয়৷এই কাব্যটিই এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বপ্রথম সাহিত্যের নোবেল পুরস্কারটি কবিগুরুর হাতে এনে দেয়৷সালটি ১৯১৩ খ্রীঃ৷রবীন্দ্রনাথ এইসময় এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন৷এই একনিষ্ঠ তপস্যার ফসল তাঁর 'গীতাঞ্জলী','গী
তিমাল্য'ও'গীতালী' ইত্যাদি কাব্য৷
জাতপাত,ভেদাভেদ ভুলে,বর্ণবৈষম্য
কে তুচ্ছ করে এই পর্বে রবীন্দ্রনাথ আহ্বান করলেন অখন্ড ভারতভূমির প্রত্যেকটি মানুষকে--
" এস হে আর্য্য,এস অনার্য্য
হিন্দু-মুসলমান৷
এস এস আজ তুমি ইংরাজ
এস এস খৃষ্টান৷
এস ব্রাহ্মণ,শুচি করি মন
ধর হাত সবাকার,
এস হে পতিত,কর অপনীত
সব অপমান ভার৷"
স্পষ্টটই বোঝা যাচ্ছে যে, কবি এই পর্যায়ে বিশ্বমানবের দরবারে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন৷একদিকে; আধ্যাত্মসম্বলিত ঈশ্বরচিন্তা,অন্
যদিকে;বিশ্বমানবকে এক অখন্ড,অসীম ছত্রছায়ায় নিয়ে আসার তাগিদ এই পর্যায়ের কাব্যগুলির ইন্ধন জুগিয়েছে৷

তথ্যসূত্রঃ কবিগুরু – অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়
রবীন্দ্ররচনাসমগ্র, বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ

আলোচক – ধনঞ্জয় চক্রবর্তী
বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,
কোচবিহার
সদস্য Success বাংলা

Share this