ভাষার সংজ্ঞা ও রূপভেদ



▪ ভাষার সংজ্ঞা ও  রূপভেদ ▪
------------------------------------
ভাষা:-
     ভাষাচার্য্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে,  "মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোনো বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত, স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথা বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিকে ভাষা বলে।" 
ভাষাগবেষক ড. সুকুমার সেনের মতে- "মানুষের উচ্চারিত অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনি সমষ্টিই ভাষা।"
অর্থাৎ এই দুই সংজ্ঞা থেকে  আমরা বলতে পারি  মনের ভাব প্রকাশের প্রধান মাধ্যমকে ভাষা বলে। অথবা মানুষ মুখে উচ্চারিত অর্থবোধক বা বোধগম্য কথাকে ভাষা বলে। অথবা বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত অর্থবোধক ধ্বনি বা ধ্বনিসমষ্টি অথবা শব্দ বা শব্দসমষ্টিকে ভাষা বলে যা মনের ভাব প্রকাশে সাহায্য করে। অথবা কোন সম্প্রদায় বা জাতির মনের ভাব প্রকাশের জন্য ব্যবহৃত অর্থবোধক শব্দ বা বাক্যকে ভাষা বলে। অথবা মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন কোন বিশেষ গোষ্ঠী বা জনসমাজে কৌশলে উচ্চারিত অপরের কাছে বোধগম্য তার নাম ভাষা।
বাংলা_ভাষা:-
      ভাষা বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন জাতির ও বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের জন্য বিভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গ বা বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালিরা বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা বাঙালি সংস্কৃতির অধিকারী বাঙালি জাতি যে ভাষায় তাদের মনের ভাব প্রকাশ করে, সেটিই বাংলা ভাষা। 
মৌখিক ভাষা:-
* মানুষের মুখে মুখে যে ভাষা ব্যবহৃত হয় তাকে বলা হয় মৌখিক ভাষা বা কথ্য ভাষা।
সাধুভাষা:-
* মৌখিক ভাষার সংস্কারপূত রূপটিকে বলা হয় সাধুভাষা। -শুধু সাহিত্য রচনার প্রয়োজনেই এই ভাষা বাবহৃত হয়ে থাকে।
চলিত_ভাষা:-
* মৌখিক তথা কথ্যভাষা শিষ্টজনের মুখে বিশেষ পরিবর্তিত না হয়ে হয়েও যখন কিছুটা মার্জিত রূপ লাভ করে এবং সাহিত্যেও ব্যবহৃত হতে থাকে তাকে বলা হয় চলিত ভাষা বা শিষ্ট কথ্যভাষা
উপভাষা:-
* একটি ভাষার অন্তর্গত এমন বিশেষ বিশেষ রূপ যা একটি বিশেষ অঞ্চলে প্রচলিত যার সঙ্গে আদর্শ ভাষার বা সাহিত্যিক ভাষার ধ্বনিগত, রূপগত এবং বিশিষ্ট বাগধারাগত বেশ কিছু  পার্থক্য আছে তাকে উপভাষা বলে।
* এ প্রসঙ্গে বলা ভালো যে এই আঞ্চলিক পার্থক্য শুধু মাত্র মৌখিক ভাষার মধ্যেই বিদ্যমান, কিন্তু   লেখ্য ভাষায় সেই প্রভেদ দেখা যায় না।
ড. সুকুমার সেন উপভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন " কোনো ভাষা-সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোটো ছোটো দলে বা অঞ্চল বিশেষে প্রচলিত ভাষাছাঁদকে উপভাষা বলে।
কেন্দ্রীয় উপভাষা:- 
* কোনো অঞ্চলবিশেষের উপভাষা যদি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক  প্রভৃতি কারণে অন্য উপভাষা থেকে অধিক গুরুত্ব অর্জন করে, তখন সেই উপভাষাটিকে কেন্দ্রীয় উপভাষা বলা হয়।
যেমন আমাদের দক্ষিণ বাঁকুড়ার ভাষা ঝাড়খণ্ডী হলেও যখন আমরা শহরে যাই বা কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথন করি তখন আমরা রাঢ়ীউপভাষাকেই অধিক প্রাধান্য দিই। 
সমাজিক উপভাষা:-
* সামাজিক স্তরভেদে একই ভাষাভাষী লোকেদের কথায় অল্পবিস্তর পার্থক্য হতে পারে। যেমন,একজন ব্রাহ্মণ পন্ডিত, একজন অধ্যাপক,একজন উকিল, একজন রাজনৈতিক নেতা,একজন শ্রমজীবী এবং একজন দাগী অপরাধী গুন্ডার ভাষার উচ্চারণে ও শব্দ ব্যবহারে বেশ পার্থক্য চোখে পড়ে। একই ভাষার মধ্যে সামাজিক স্তরভেদে এই যে পার্থক্য একে সমাজ ভাষা বলে।অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য এই উপভাষাকে 'শ্রেণীভাষা' নামে অভিহিত করাই শ্রেয় বলে মনে করেছেন।
আদর্শ কথ্যভাষা:-
* কেন্দ্রীয় উপভাষা যখন সাহিত্য রচনার উপযোগী  রূপে মার্জিত ও সংস্কার-কৃত হয়ে শিষ্টজনসম্মত রূপ লাভ করে, তবে তাকে আদর্শ কথ্যভাষা বলে। আদর্শ কথ্যভাষাই  চলিত ভাষারূপে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বিভাষা:-
* এক-একটি কথ্য উপভাষিক অঞ্চলের মধ্যে কথ্য উপভাষার আরো ছোট ছোট উপবিভাগ দেখা যায়,এই উপবিভাগকে বিভাষা বলে।
যেমন: দক্ষিণ পশ্চিম বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার উপভাষা ঝাড়খণ্ডী হলেও উচ্চারণে কিছু পার্থক্য রয়েছে।
নিভাষা:-
* অনেকসময় কোন ব্যক্তি বিশেষের কোনো বাক্য বা শব্দ ব্যবহারে যদি স্বাতন্ত্র্য  ঘটে, আর যদি সেই স্বাতন্ত্র্য সমন্বিত শব্দ তার পরিবারের লোকেরা বা প্রিয় পরিচিতরা ব্যবহার করতে থেকে, তবে সেই স্বাতন্ত্র্য সমন্বিত ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাষাকে নিভাষা বলে। ড. সুকুমার সেন এই ভাষাকে বলেছেন 'নিজভাষা'।
যেমন গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের মধ্যে নিজভাষার উদারহণ পাওয়া যায়। প্রধানত স্বামী শ্বশুর ভাসুর ইত্যাদি গুরুজনদের নাম করতে নেই বলে গ্রামের বিবাহিত মহিলাদের মধ্যে নিজভাষার উদাহরণ মেলে। যেমন: আমার দিদার নাম  "কালীদাসি" তাই আমাদের মামিরা সবাই "কাল" কে বলে "উদিন" আবার "কালীঠাকুর কে বলে "ভুষাঠাকুর"। এই শব্দ গুলি শুনে শুনে বাড়ির অনেকেই এই শব্দ গুলি ব্যবহার করে।
অপভাষা:-  
* এক ভাষাগোষ্ঠীর লোক যখন অন্যভাষা সঠিক ভাবে না শিখে বা উচ্চারণ রীতি না বুঝে বিকৃত বা ভ্রমপ্রমাদ পূর্ণ শব্দ বা বাক্য উচ্চারণ করে, তখন সেই  বিকৃত বাক্ ব্যবহারকে  অপভাষা বলে।
যেমন: মূল ইংরেজি শব্দ "স্টেশন" কিন্তু অনেকে "টিসন যাবি" ইত্যাদি বলে থাকে। এটা বিকৃত বা ভুল উচ্চারণ এ হল অপ ভাষার নিদর্শন।
অপার্থভাষা:-
সাধারণত দুর্বৃত্তসম্প্রদায় প্রকাশ্যে নিজেদের মধ্যে এমন ভাষায় কথা বলে, যার একটি বীষেষ দলীয়  লোকেরাই শুধু বুঝতে পারে, অন্যেরা তাদের এই কথাবার্তায় কোনো অপরাধের সন্ধ্যান পায় না। তাদের এরূপ বাগব্যবহারকে অপার্থভাষা বা সংকেত ভাষা বলে। 
যেমন: 'পিস্তলকে' বলে 'খোকা', 'পুলিশকে' বলে 'মামা' ইত্যাদি।
মিশ্রভাষা:-
যখন এক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অন্য ভাষাভাষী  জনগোষ্ঠীর মধ্য স্থায়ীভাবে বসবাস করে তখন এই দুটি ভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী প্রয়োজনের তাগিদে উভয়ে উভয়ের ভাষার দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং কাজ চালানো গোছের এক জাতীয়  সরলভাষা সৃষ্টি হয়  তাকে বলে মিশ্রভাষা।  এরূপ ভাষাগুলির মধ্য উল্লেখযোগ্য "পিজন ইংলিশ"। এটি ইংরেজি ও চীনা ভাষার মিশ্রণে গড়ে উঠেছে।


আলোচক: সুশান্ত কর্মকার(অ্যাডমিন, সাকসেস বাংলা)
গ্রন্থ ঋণ
▪ 'ভাষা-প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ'- ডঃ সুনীতি কুমার চট্টপাধ্যায়।
▪ 'ভাষার ইতিবৃত' - ডঃ সুকুমার সেন
▪ 'ভাষাবিদ্যা পরিচয়'- অধ্যপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য।
▪ 'সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা' - ডঃ রামেশ্বর শ

Share this