বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়



|| বাংলা সাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ||

     সময়টা বিশ শতকের তিনের দশক। বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগনে বিরাজ করছেন রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র। তাঁদের সৃষ্টিতে পাঠককুল মুগ্ধ।এর সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত ভাবনার বিপরীতে, এক পাল্টা হাওয়ার প্রবাহ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে হাজির হলেন কল্লোল গোষ্ঠীর লেখককূল। পাঠক হল তাতে চমকিত, বিস্মিত।আর ঠিক এমনই সময়ে এই দুই ভাবনা - রীতির বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ নিজস্ব ভঙ্গিতে মানুষ, প্রকৃতি আর ঈশ্বর ভাবনার সম্মিলিত রূপকে সহজ সরল ভাবে তুলে ধরে সাহিত্যাকাশে আবির্ভূত হলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অস্থির, সংকটময় সময়ে অবস্থান করেও জগৎ ও জীবনের আনন্দময় রূপকে অনুভব করেছেন তিনি। তাঁর কথায়, "জীবনকে যারা দুঃখময় বলেছে, তারা জীবনের কিছুই জানে না, জগৎটাকে দুঃখময় মনে করা নাস্তিকতা। জগৎ হল সেই আনন্দময়ের বিলাস বিভূতি" ।আজকের আলোচনা সেই মহান সাহিত্যিক কে ঘিরেই।

* জন্ম ও বংশপরিচয় :
* জন্ম:12 ই সেপ্টেম্বর 1894খ্রিস্টাব্দ। 
* জন্মস্থান :নদীয়ার ঘোষপাড়া মুরাতিপুর গ্রাম (মাতুলালয়)। 
* পৈত্রিক বাসস্থান :উ:24 পরগনার ব্যারাকপুর। 
* আদি বাসস্থান :24 পরগনার পানিতর গ্রাম। 
*পিতা-মাতা'র নাম :মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মৃনালিনী দেবী। 
*মৃত্যু : 1 লা নভেম্বর 1950 খ্রিস্টাব্দ।


* শিক্ষাজীবন 
*1914 সালে বনগ্রাম বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। 
*1916 সালে রিপন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই. এ পাশ করেন। 
*এখান থেকেই 1918 সালে ডিস্টিংশন নিয়ে বি. এ. পাশ করেন।


*কর্মজীবন 
*কর্মজীবন শুরু স্কুলে শিক্ষকতা দিয়ে। শিক্ষকতা করেন জঙ্গীপাড়া, হরিনাভি, কলকাতার খেলাতচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল এবং গোপালনগর স্কুলে। 
*এর মাঝে গোরক্ষিণী সভার ভ্রাম্যমাণ প্রচারক রূপে বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা ও আরাকান অঞ্চলে ভ্রমণ করেন এবং পাথুরিয়াঘাটার খেলাত ঘোষ এস্টেটের অ্যাসিস্ট্যানট ম্যানেজার রূপে ভাগলপুর সার্কেলে কিছুকাল কাজ করেন। এই দুই ভিন্ন বৃত্তির অভিজ্ঞতা যথাক্রমে "অভিযাত্রিক" ও "আরণ্যক" - এ স্থান পেয়েছে।


*সাহিত্য কর্ম:
i ) উপন্যাস :
*"পথের পাঁচালী" (1929)>>>বিচিত্রা পত্রিকা >>>প্রকৃতি আর মানুষের জীবন ছবি। 
* "অপরাজিত"(1932) >>>প্রবাসী পত্রিকা >>>প্রকৃতির কোল থেকে মানুষের শহর যাত্রার ছবি। 
* "দৃষ্টিপ্রদীপ" (1935)>>> মুক্তমন আর মানুষের প্রতি ভালোবাসা। 
*" আরণ্যক "(1939)>>>বিহারের অরণ্য প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং আরণ্যক মানুষের সরলতা। 
* " আদর্শ হিন্দু হোটেল" (1940)>>>হোটেল রাঁধুনীর কর্মনিষ্ঠা ও হোটেল ব্যবসা। 
*  "বিপিনের সংসার" (1941)>>>বিপিনের জীবনে বিবাহিতা দুই স্ত্রীর প্রভাব। 
*  "দুই বাড়ী" (1941)>>>দুই নারীকে কেন্দ্র করে স্বপ্নের জলছবি। 
*  "অনুবর্তন"(1942) >>>শিক্ষক সমাজের জীবন চর্চার কাহিনি। 
* " দেবযান" (1944)>>>অধ্যাত্ম চেতনা। 
*  "কেদার রাজা" (1945)>>>সিংহাসন দখলকারী রাজার বৃত্তান্ত। 
*  "অথৈ জল" (1947)>>>রাজনীতি স্পর্শী সামাজিক বিষয়। 
*  "ইছামতী" (1950)>>>প্রকৃতি, মানুষ, ঈশ্বর, নীলকর অত্যাচার। 
*  "অশনি সংকেত" (1959)>>>সংকটময় সামাজিক অবস্থা। পঞ্চাশের মন্বন্তরের কাহিনি ।

ii) গল্পগ্রন্থ:
" মেঘমল্লার" (1931),"মৌরীফুল"(1932),"যাত্রাবদল" (1934),"জন্ম ও মৃত্যু"
(1937),"কিন্নরদল"(1938),"বেনীগির ফুলবাড়ি" (1941),"নবাগত"(1944),"উপলখন্ড"(1944),"বিধু মাস্টার "(1945),"ক্ষণভঙ্গুর" (1945),"অসাধারণ" (1946),"মুখোশ ও মুখশ্রী" (1947),"নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব"(1948)'"জ্যোতিরঙ্গন"(1949),"কুশল পাহাড়ী"(1950),""রূপ হলুদ "(1957),"ছায়াছবি"(1960),"অনুসন্ধান "(1960) ।
iii) শিশু সাহিত্য :
" চাঁদের পাহাড় "(1937),"মরণের ডঙ্কা বাজে"(1940),"মিসমিদের কবজ"(1942),"তালনবমী"(1944),"হীরামাণিক জ্বলে "(1946)।

iv)দিনলিপি :
" স্মৃতির রেখা "(1941)," তৃনাঙ্কুর "(1943),"ঊর্মিমুখর"(1944),"উৎকর্ণ"(1946),"হে অরণ্য কথা কও"(1948),"বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপি "(1983)।

v)ভ্রমণ কাহিনি :
" অভিযাত্রিক" (1941),"বনে পাহাড়ে "(1945)।
vi) বিবিধ গ্রন্থ :
" বিচিত্র জগৎ"(1937),"আইভ্যানহো"(1938)," টমাস বাটার আত্মজীবনী "(1943)-এই দুটি অনুবাদ রচনা, "অভিনব বাংলা ব্যাকরণ" (1940),"আমার লেখা" (1961)-প্রবন্ধ সংকলন।

Vii)  অন্য লেখকের সঙ্গে রচনা :
"সুন্দরবনে সাত বৎসর "(1359 বঙ্গাব্দ) - ভুবনমোহন রায়ের সঙ্গে যৌথভাবে লিখিত," অনশ্বর" (1379 বঙ্গাব্দ) - গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে।


 উৎসর্গীকৃত গ্রন্থ:-
*পথের পাঁচালী >>পিতৃদেব- কে ।
*অপরাজিত >>মাতৃদেবী-কে ।
* আরণ্যক >>গৌরীদেবী-কে ।
* চাঁদের পাহাড় >>খুকু - কে ।
* আদর্শ হিন্দু হোটেল >>নুটুবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় কে। 
* বিপিনের সংসার >> চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় - কে ।
*দেবযান >>ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায়-কে ।
*কেদার রাজা >>নীরদরঞ্জন দাশগুপ্ত - কে ।
* ইছামতী >>রমা বন্দ্যোপাধ্যায় - কে ।

##বিভূতিভূষণের সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য চরিত্র সমূহ ~
*অপু, দুর্গা, সর্বজয়া, হরিহর, ইন্দির ঠাকরুণ ="পথের পাঁচালী" ।
*জিতু, সীতা = "দৃষ্টিপ্রদীপ" ।
* সত্যচরণ, ভানুমতী, মঞ্চী, কুন্তা, রাজু পাঁড়ে, গনোরি তেওয়ারী,দোবরু পান্না ="আরণ্যক" ।
*হাজারি ঠাকুর, পদ্ম =" আদর্শ হিন্দু হোটেল "। 
*নিধিরাম, মঞ্জরী, হৈম =  "দুই বাড়ি"। 
* কেদার রাজা, শরৎ = "কেদার রাজা"। 
* শশাঙ্ক  =" অথৈ জল "। 
*নীলু, বিলু, তিলু, ভবানী বাঁড়ুয্যে = "ইছামতী" ।
* গঙ্গাচরণ পন্ডিত, অনঙ্গ বউ, কাপালী-বউ = "অশনি সংকেত "। 
*ক্ষেন্তী, সহায়হরি চাটুয্যে, অন্নপূর্ণা =" পুঁইমাচা" ।
* সুনন্দা, প্রদ্যুম্ন =" মেঘমল্লার" ।
*  সুশীলা  ="মৌরীফুল "।


*বিভূতিভূষণের কাহিনির উপর নির্মিত চলচ্চিত্র এবং তার পরিচালক:-
* পথের পাঁচালী (1955)>> সত্যজিৎ রায়। 
* অপরাজিত (1956)>>সত্যজিৎ রায়। 
* অপুর সংসার (1959)>>সত্যজিৎ রায়। 
* বাক্স বদল (1970)>> নিত্যানন্দ দত্ত ।
*নিশিপদ্ম (1970)-"হিংয়ের কচুরি" অবলম্বনে নির্মিত বাংলা ছবি >>অরবিন্দ মুখার্জি। 
* অমর প্রেম (1972)-"হিংয়ের কচুরি "অবলম্বনে নির্মিত হিন্দি ছবি >>শক্তি সামন্ত। 
*নিমন্ত্রণ (1971)>> তরুণ মজুমদার। 
*অশনি সংকেত (1973)>> সত্যজিৎ রায়। 
*  ফুলেশ্বরী(1974)>>তরুণ মজুমদার। 
* আলো (2003)-" কিন্নরদল" অবলম্বনে নির্মিত ছবি >>তরুণ মজুমদার। 
*চাঁদের পাহাড় (2013)>> কমলেশ্বর মুখার্জি ।


*কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:-
*1922 সালে "প্রবাসী" পত্রিকার মাঘ(1328 বঙ্গাব্দে) সংখ্যায় প্রকাশিত হয় বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প 'উপেক্ষিতা' ।পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী নামে এক বালক কবির প্ররোচনায় তিনি গল্পটি লেখেন। 
*গল্পটি পড়ে খুশি হয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এক চিঠিতে বিভূতিভূষণকে লেখেন, - "তোমার গল্পটি বড়ই মনোরম হইয়াছে। রচনা যেমন সুললিত, তেমনি প্রাঞ্জল।" 
*বিভূতিভূষণের প্রথম গল্পগ্রন্থ "মেঘমল্লার" ।
* 1935 বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা থেকে "বিচিত্রা" পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে তাঁর প্রথম উপন্যাস "পথের পাঁচালী" প্রকাশিত হয়। 
*1929 খ্রিস্টাব্দে "পথের পাঁচালী" প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক - সজনীকান্ত দাস, রঞ্জন প্রকাশালয়। 
*রোমাঁ রোলাঁর 'Jean christophe' - এর সঙ্গে 'পথের পাঁচালী' র মিল আছে। 
*1944 সালে " পথের পাঁচালী "-ছোটদের জন্য প্রকাশিত হয়। 
*" উমারানী" গল্পের জন্য বিভূতিভূষণকে হরিনাভি স্কুল ছাড়তে হয় বলে শোনা যায়। 
* "ইছামতী" উপন্যাসের জন্য তিনি মরনোত্তর রবীন্দ্র পুরষ্কার (1951)লাভ করেন। 
* বিভূতিভূষণ সাপ্তাহিক ' চলচ্চিত্র' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
* সুকুমার সেনের মতে - "পুঁইমাচা" গল্পটি  "পথের পাঁচালী" র বীজ। 
*"কাজল" - যা  "অপরাজিত" উপন্যাসের শেষ পর্ব - সমাপ্ত করেন তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়।


*কিছু গুরুত্বপূর্ণ উক্তি:-
* "বইখানা দাঁড়িয়ে আছে আপন সত্যের জোরে" - 'পথের পাঁচালী' সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ। 
*"বিভূতিভূষণ আর অপু দুই নয়, এক। তাই 'স্মৃতির রেখা' আর 'পথের পাঁচালী' একই মনের দুই প্রকাশ।"- অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়। 
* "আমরা শুধু দেখিলাম বিভূতিভূষণ বাংলা সাহিত্যে তাঁহার আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে নবশুচিতা ও সহৃদয়তার আমদানি করিলেন, আমরা দীর্ঘবিরোধ ও কঠিন প্রতিবাদের দ্বারা যাহা করিতে পারি নাই বিভূতিভূষণ অবলীলাক্রমে  দৃষ্টান্তের দ্বারা সাহিত্যে সেই চিরন্তন সত্যের প্রতিষ্ঠা করিয়া গেলেন।"- সজনীকান্ত দাস। 
*" বিভূতিভূষণ কেবল মাটি ও মানুষের শিল্পী নন, আকাশভরা আনন্দলোক ও ঐশী মহিমারও রূপকার। "-  অরুণ কুমার মুখোপাধ্যায়। 
*" বিভূতিভূষণের সংলাপ পড়লে কথা কানে শুনতে পাওয়া যায়, চরিত্রের বর্ণনা না থাকলেও কেবল সংলাপের গুনে চরিত্রের চেহারা চোখের সামনে ফুটে ওঠে।" - সত্যজিৎ রায়। 
*" কেউ কেউ আছেন যিনি তুচ্ছকে মহৎ করে তোলেন, বিভূতিভূষণ সে শ্রেণীর লেখক নন। তাঁর কাছে কিছুই তুচ্ছ নয় - তিনি যা কিছু দেখেছেন তা সবই পূর্ণ। "- সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ।


তথ্যসূত্র :
* বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়। 
*বাংলা সাহিত্য পরিচয় - পার্থ চট্টোপাধ্যায়। 
* আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস - তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়। 
*কালের প্রতিমা - অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়। 
* বাংলা উপন্যাসের কালান্তর - সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
                                এবং 
                     সাকসেস বাংলা গ্রুপ।

আলোচনায়- তাপস ঘোষ, 
(বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, 
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, success বাংলা)

Share this