নাগরিক জাগরণের স্ফুরণ: কবিতায় সমর সেন


নাগরিক জাগরণের স্ফুরণ: কবিতায় সমর সেন
     কলমকে বিদ্রোহের পোষাক পরিয়ে যৌবনের পথে হাঁটিয়েছেন অনেক কবি। বিদ্রোহের ঝোঁক বিভিন্ন কবিকে বিভিন্ন পথে নিয়ে যায়। চারপাশের জটিলতা, পারপার্শ্বিক দুর্ভোগ, যা কিছু কুৎসিত, নিষ্ঠুর তার বিরুদ্ধে নিজের মতো করে নির্বাক বিদ্রোহ করা, প্রচলিত রীতিনীতিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া, যৌবন যে বিদ্রোহের ঋতু তা বারবার লেখনীর মাধ্যমে বোঝানো এবং একসময় সমস্ত গ্লানি, বিদ্রোহের পথ পেরিয়ে নবনির্মানের পরিকল্পনা করে যে কবির দীর্ঘকাল পাঠক মননে বাঁচবার সৌভাগ্য হয়েছে তিনি নাগরিক কবি সমর সেন।
     সমর সেনের কবিতায় বিদ্রোহের ভাব নক্ষত্রপুঞ্জের মতো জ্বলজ্বলে। তাঁর কবিতা গদ্যে রচিত। বাংলা কবিতায় তাঁর গদ্যছন্দের ব্যবহার অভিনব। এই ছান্দিক প্রয়াস কোনো কবির অনুসারী নয়। যেন গদ্যের রূপে বাস্তবকেই কবিতার ছাঁচে ঢেলেছেন তিনি কিন্তু তাতে কাব্যিক গন্ধ টাও বর্তমান রয়েছে। "কবিতা" পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত এই কবি সগর্বে ঘোষনা করেছিলেন- "আমি রোম্যান্টিক কবি নই, আমি মাক্সিস্ট।" মার্কসবাদের প্রতি প্রবল আশক্তি তাঁর কবিতায় ছাপ ফেলেছে। ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা, ধনতান্ত্রিক যান্ত্রিক ব্যবস্থার ফলাফল, স্নেহ-প্রেম প্রভৃতি মানবিক অনুভূতির আড়ালে স্বার্থপরতা, পাশবিকতার আচরণ তাঁর কবিতায় বারবার প্রকাশ পেয়েছে। দুঃসময়ের কাছে আত্মসমর্পণের পরিবর্তে আগামীর নিশ্চিন্দিপুরের স্বপ্নের অন্তরীপের সন্ধান পাওয়া যায় সমর সেনের কবিতায়। আশাবাদ তাঁর কবিতার আত্মা যেন। কোনোরকম কোনো ভণিতা, আড়ম্বর ছাড়াই নিপাট সত্যিটা কালির অক্ষরে ভাস্বর হতো তাঁর বুননে। তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখ্য কাব্যগ্রন্থ হল-- কয়েকটি কবিতা(১৯৩৭), গ্রহণ(১৯৪০), নানাকথা(১৯৪২), খোলাচিঠি(১৯৪৩), তিনপুরুষ(১৯৪৪)। 
     তাঁর আত্মজিবনীমূলক "বাবু বৃত্তান্ত" প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। উক্ত কাব্যগ্রন্থের মধ্য 'কয়েকটি কবিতা' তেই যৌবনের উন্মাদনা প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক অন্যায়, অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনি নতুন নয় কিন্তু সমর সেনের নতুন সুর কবিতার জগতে নতুন বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। কবিতাগুলো ছিল লিরিকধর্মী। লিরিকে ধরা পড়েছে সুর, সেই সুরে ধরা পড়েছে বিদ্রোহের এক মহীরুহ-ছায়া। তিনিই আবিষ্কর্তা এই অভিনব ধ্বনি ও প্রতিধ্বনির। বিপ্লবীদের প্রতি আস্থা রেখেই কবি 'লোকের হাট' কবিতায় লিখেছিলেন-
"ওরা যেখানে প্রাণ নেয়,সেখানেই প্রাণের স্বাক্ষর,
ওরা যেখানে প্রাণ দেয়,সেখানে জীবন অমর।
ওদের বাহুবলে পাশব শত্রুরা পলাতক,ছত্রভঙ্গ,
যুদ্ধের দলিত রক্তাক্ত প্রান্তরে লোহিত পদ্মের গান।"
নাগরিক কবির এই গান তাকে নিয়ে যাবে দূর সমুদ্রে,খুঁজে নেবে নতুন পৃথিবী।বাংলা কবিতাকে দিগন্তবিস্তৃত করবে সেই ঢেউ এর আঘাত আর ঝড়ের বিপর্যয়।আর এই যাত্রার শেষপ্রান্তে অপেক্ষা করপ আছে এক নতুন তটরেখা,আর তার পূর্বাভাস ই ধরা পড়েছে নবযৌবনের বিষন্ন মধুর দীর্ঘশ্বাসে---
"অনেক,অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ,
সমস্তক্ষণ সেখানে পথের দুধারে ছায়া ফেলে
দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য
আর দূর সমুদ্রের দীর্ঘশ্বাস
রাত্রির নির্জন নিঃসঙ্গতাকে আলোড়িত করে।
আমার ক্লান্তির উপর ঝরুক
মহুয়ার ফুল
নামুক মহুয়ার গন্ধ।"
(মহুয়ার দেশঃসমর সেন)

আলোচক-- বৈশাখী পাল
(সাকসেস বাংলা)

Share this