বিষয় : একলব্য



     পুরাণ মতে পৃথিবীর প্রথম রাজা ছিলেন বেণ। বেণের পিতার নাম অঙ্গ। তাঁর সাথে বিবাহ হয় যমরাজের কন্যা সুনীথার। তাঁরই গর্ভে বেণের জন্ম। ঋষিরা তাঁকে প্রথম রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করেন। কিন্ত বেণের স্বভাব ভালো ছিলো না। তিনি ছিলেন অত্যাচারী। রাজা হয়ে তিনি আদেশ দেন এ-রাজ্যে অন্য কারও পূজা অর্চনা চলবেনা। রাজার এই ঔদ্ধত্য ঋষিরা মেনে নিলেন না। তাঁদের অভিশাপে ও আঘাতে বেণ নিহত হলেন।রাজপরম্পরা চলমান রাখার জন্য ঋষিরা নিঃসন্তান রাজার ঊরু মন্থন করা শুরু করলেন। বেণের মথ্যমান ঊরু থেকে খর্বমুখ ও হ্রস্বকায় পুরুষ জন্মাল এবং সে উঠে দাঁড়িয়ে ঋষিদের বললো-- "আমি কী করবো?" ঋষিরা বললেন "নিষীদ" অর্থাৎ  মানে  বসে থাকো। বিষ্ণুপুরাণমতে অধার্মিক বেণের পাপের অংশে এই পুরুষটির জন্ম বলেই ঋষিরা তাকে বসে থাকতে বলেন। আর নিষীদ শব্দ থেকেই নিষাদ শব্দটি এসেছে। বেণের দক্ষিণ বাহু মন্থন করে জন্ম হয় পৃথুর, যার নামে এই পৃথিবী। বেণের কাহিনি এটাই প্রমাণ করে  দ্রোণাচার্য যেমন একলব্যকে বসিয়ে দিলেন পৃথুর হস্তমর্দী ব্রাহ্মণরাও নিষাদদের বসিয়েই দিয়েছিলেন।
     একলব্য নিষাদ রাজ হিরণ্যধনুর পুত্র। রাজপুত্র হলেই দ্রোণাচার্যের শিষ্য হওয়া যাবে এই ভরসাতেই একলব্য দ্রোণের কাছে উপস্থিত হন।জাতিবিদ্বেষ থেকেই যে দ্রোণ তাকে গ্রহণ করেননি এমন নয়। যদি তাই হতো তাহলে যজ্ঞকর্মের হরিঃ-পুরোডাশ-স্রুক-স্রুব ছেড়ে তিনি ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করতেন না। ব্রাহ্মণের বৃত্তি ছেড়ে যিনি ধনুক-বাণ ধরেছেন সেই মহাভারতের কালে, তিনি আর অত জাতের বিচার করবেন কোন মুখে কোন মানসিকতায়!
     দ্রোণাচার্যের একলব্যকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ না করার কিছু কারণ ছিলো। ❄ ঘটনা-বহুল জীবনে  তিনি  নানা বিপরীত পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। দারিদ্র্যমুক্তি, অর্থ ও ঐশ্বর্যের ব্যাপারে তাঁর লিপ্সা ছিলো। আর সেই কারণেই নিজের মাতৃভূমি পাঞ্চাল ছেড়ে  হস্তিনাপুরে আসতে বাধ্য হন। অনেক কষ্টে শ্যালক কৃপাচার্যের শংসাপত্রে তিনি কুরুবাড়ির চাকরিটা পেয়েছিলেন। নৈষাদি একলব্যকে শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করলে কোনোক্রমে যদি সে রাজপুত্রদের থেকে ভালো অস্ত্রশিক্ষা লাভকরে অথবা নৈষাদির সাহচর্যে যদি রাজপুত্রদের চরিত্রে কোনো অনার্যতা চলে আসে তাহলে তাঁর চাকরিটা যাবে এবং আবার দারিদ্র্য তাঁর পরিবারকে গ্রাস করবে।
❄ অন্যদিকে হস্তিনাপুরের রাজকুমারেরা মৃগয়ায় গেলে তাদের পশু অণ্বেষণকারী কুকুরটি বনে ঘুরতে ঘুরতে ধূলোমাটি মাখা, জটপাকানো চুল, মৃগচর্ম পরিহিত ধনুক বাণ হাতে একলব্যকে দেখতে পেলো। এমন অদ্ভুত চেহারার মানুষ দেখলে কুকুর স্বভাবতই চেঁচায়। কুকুরটি চেঁচাতেই নির্জনে তপস্যাভঙ্গের অপরাধে একলব্য পরপর সাতটি বাণ ছুঁড়লেন কুকুরটির মুখ লক্ষ করে। পাণ্ডবদের কুকুর দুবারের বেশি ডাকার সুযোগ পেলোনা। একে বলে ক্ষিপ্রতা। যার ধনুর্বেদগ্রাহ্য পারিভাষিক নাম "লাঘব"। সারা মুখে অস্ত্র নিয়ে  শিকারী কুকুর পান্ডব ভাইদের খুঁজে বার করলো। তারা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো কুকুরের দিকে। এবং বুঝলো, যে মানুষ এই কাজ করেছে সে অবশ্যই ধনুর্বেদের চরম দুটি রহস্য---- ক্ষিপ্রতা বা চরমতম হস্ত লাঘব এবং  দূর থেকে শব্দ শুনে চোখে না  দেখে লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা। পান্ডব ভাইরা  এই অদ্ভুত অস্ত্র শিক্ষা দেখে যতখানি আশ্চর্য হলো তার বেশি লজ্জা পেলো। আর  পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে যার মন সক্ষমের অসূয়ায় শঙ্কিত হয়ে উঠলো  সে হলো অর্জুন।  পাঁচ ভাই তাকে খুঁজে বের করে একলব্যর পরিচয় জানলো। এবং শুনলো যে একলব্য দ্রোণাচার্যের শিষ্য। পান্ডবরা একথা শুনে অবাক হলো। ফিরে গিয়ে অর্জুন একান্তে গুরুর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন--"যেদিন রাতে আমি অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শব্দ শুনে লক্ষভেদ অভ্যাস করছিলাম, সেদিন খুশি হয়ে আপনি আমাকে সগৌরবে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন---তোমার চেয়ে বেশি জানবে এমন অস্ত্রশিষ্য আমার কেউ থাকবে না। তাহলে আজ কী দেখে এলাম গুরুদেব!  দেখে এলাম আপনার আরও একজন শিষ্য আছে যে আমার চেয়ে অনেক বড়োতো  বটেই পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্রবিদদের চেয়েও সে অনেক বড়ো। " নিজের অজান্তেই অর্জুনের কাছে মিথ্যাচারিতার দায়ে পড়লেন দ্রোণ।  শিষ্যকে নিয়ে পৌঁছলেন একলব্যর কাছে। গুরুকে দেখামাত্র অসাধারণ প্রতিক্রিয়া হলো একলব্যের মধ্যে। তবে সে বুঝলো গুরু অকারণে তার কাছে আসেননি।  একলব্য গুরুর চরণ বন্দনা করে একান্ত অনুগত শিষ্যের মতো আত্মসমর্পণ করলো। গুরু তার প্রতি অধিক দুর্বল হয়ে পড়ার আগেই শিষ্যের কাছে চেয়ে বসলেন সেই সর্বকালের কালিমালিপ্ত গুরুদক্ষিণা----"তোমার ডান হাতের বুড়ো আঙুলটি আমায় দিতে হবে"। শোনামাত্রই শিষ্য বিনা বাক্য ব্যয়ে দক্ষিণা দিলেন।

  একলব্যর শরচালনার প্রধানতম সহায় ডান হাতের বুড়ো আঙুল কাটা গেলেও অবশিষ্ট চার আঙুল দিয়েই তিনি ধনুকে বাণ যোজনা করার চেষ্টা করছিলেন বারবার। অর্জুনকে অতিক্রম করতে না পারলেও অনেকের চেয়ে খ্যাতিমান বীর হয়েছিলেন তিনি। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে তিনি নিমণ্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন। এই যজ্ঞে  শিশুপাল  অর্ঘ্য দানের জন্য একলব্যের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে   কুরু-পাণ্ডবের যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে পাঞ্চালরাজ ধ্রুপদ  পাণ্ডবদের পরামর্শ দেন একলব্যকে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করার আমণ্ত্রণ জানাতে।
     মহাভারত ও হরিবংশ পুরাণ থেকে জানা যায় জরাসন্ধর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পৌন্ড্রক বাসুদেব দ্বারকা আক্রমণ করলে একলব্য তার সহায় হন। কৃষ্ণ বলেছেন-- নিরন্তর অভ্যাসে একলব্য নিজেকে প্রস্তুত করেছে। সে মহাকাল অন্তক যমের মতোই ভয়ংকর। যাদব-বৃষ্ণিদের মধ্যে সেদিন এমন একজনও বীর ছিলেন না যিনি একলব্যের বাণবর্ষণে আহত হননি। এই যুদ্ধেই কৃষ্ণ বুঝে গিয়েছিলেন  যে, নিরঙ্গুষ্ঠ অবস্থাতেও একলব্য কত ভয়ংকর। কৃষ্ণও তার বাণে আহত হন। সুতরাং তার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ যদি দ্রোণের কৌশলে কাটা না পড়তো তাহলে দেবতা, দানব, সর্প, গন্ধর্ব কারো পক্ষে তাকে যুদ্ধে পরাস্ত করা সম্ভব হতোনা। মানুষতো কোন ছার । শুধু শর যোজনা নয়, গদা যুদ্ধেও সমান পারদর্শিতা ছিলো একলব্যের। বলরামের সাথে যুদ্ধেও এতটুকু পরাস্ত হননি তিনি। সুতরাং বলা যায় আপন স্বকীয়তায়  মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান তৈরি করেছিলেন তিনি। তিনি তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের সাথেও আপোস করেন নি। তাঁর জীবৎকালে আর্যাবর্তের কোনো রাজা তাঁকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। আজীবন স্বমহিমায় সূর্যের প্রখর দীপ্তিতে জাজ্জ্বল্যমান থেকেছেন তিনি। অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈর্ষা তাঁর গতিকে রোধ করতে পারেনি। এই জন্যই তিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্  একলব্য।

আলোচনায়:- গার্গী চট্টোপাধ্যায়

Share this