|| চর্যাপদ ||
● ভূমিকা:- প্রাচীন বাংলা ভাষা যখন অপভ্রংশের জঠর থেকে জন্মগ্রহণ করেছে সেই সময় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে মধ্যে বাংলা সাহিত্যের ঊষালগ্নে ২৩/২৪ জন কবির কন্ঠে আমরা শুনেছি বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের সাধনতত্বের গান-" চর্যাপদ ", বাংলা কাব্য সৃষ্টি প্রচেষ্টার যা প্রাচীনতম নিদর্শন।
● আবিষ্কার:- ১৯১১ সালে প্রকাশিত দীনেশচন্দ্র সেনের The History of Bengali Language and Literature" এ বাংলা সাহিত্যের আদি পর্বে বৌদ্ধ প্রভাবের কথা উল্লিখিত হলেও তাঁর আলোচনা প্রধানত গোপীচন্দ্রের গান,ডাক,খনার বচন ইত্যাদি কতগুলি লৌকিক উপাদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদ আবিষ্কৃত হয় বাংলার বাইরে নেপালের রাজদরবার গ্রন্থাগার থেকে।রাজেন্দ্রলাল মিত্র নেপালে গিয়ে সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বৌদ্ধ পুঁথির সন্ধান করে ১৮৮২ সালে" Sanskrit Buddhist Literature in Nepal" নামে একটি পুঁথির তালিকা প্রকাশ করেন।রাজেন্দ্রলাল মিত্রের মৃত্যুর পর বাংলা - বিহার- আসাম- উড়িষ্যার পুঁথি সন্ধান ও সংগ্রহের দায়িত্ব পান হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়। উপকরণ সংগ্রহের জন্য তিনি১৮৯৭-১৮৯৮ সালে দুবার নেপালে গিয়ে কতগুলো সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ করে আনেন এবং ১৯০৭ সালে তৃতীয়বার নেপালে আরোও কিছু পুঁথি আবিষ্কার করেন।এই আবিষ্কৃত পুঁথিগুলির মধ্যে চর্যাচর্যবিনিশ্চই,সরহপাদের দোহা,অদ্বয়বজ্রের সংস্কৃতি রচিত সহজাম্নায়ন পঞ্জিকা নামক টীকা এবং কৃষ্ণাচার্যের দোহা ও আচার্য পাদের সংস্কৃতে রচিত " মেখলা" নামক টীকার পুঁথিগুলিকে প্রাচীন বাংলায় রচিত বলে মনে করেন।
● প্রকাশ কাল:- ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে " হাজার বছরের বৌদ্ধ গান ও দোহা " নামে গ্রন্থটি হরপ্রসাদ শাস্ত্রি মহাশয় প্রকাশ করেন। বাংলা ১৩২৩ বঙ্গাব্দে চর্যাপদ প্রকাশিত হয়। এই সংকলনে যে গ্রন্থ ছিল তা হলো চর্যাচর্যবিনিশ্চয়,সরহপাদ ও কৃষ্ণপাদের দোহা, ডাকার্নব।
●রচনার কারণ:- পাল যুগে বৌদ্ধ - ব্রাক্ষ্মন্য সহবস্থানের পর সেনযুগে বৌদ্ধ- ব্রাক্ষ্মন্য সংঘর্ষে সংকটাপন্ন এক ক্রান্তিকালে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা বৌদ্ধ ধর্মের গূহ্যসাধন পদ্ধতিকে লোকচক্ষুর অন্তরালে সংরক্ষণের তাগিদ অনুভব করেন।সেই তাগিদ ও গুরুপরম্পরা সেই সাধন পদ্ধতির আত্তিকরনের উদ্দেশ্যে সন্ধ্যা ভাষায় চর্যাপদ রচিত হয়েছিল।
● পুঁথি পরিচয়:-¤ হরপ্রসাদ শাস্ত্রি মহাশয় প্রকাশের সময় এই পুঁথির নাম দিয়েছিলেন "চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়" ।
¤ পুথিটির প্রথম পত্রের সম্মুখ পৃষ্ঠায় নাগরী হরফে "চর্য্যাচর্য্যটীকা" কথাটি লেখা আছে।
¤পুথিটি তালপাতায় প্রাচীন বাংলা হরফে লেখা।
¤শেষ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৯।
¤ ৩৫,৩৬,৩৭,৩৮,৫৬ সংখ্যক পৃষ্ঠা নেই।
¤ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে বা চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে পুথিটি লিখিত।
¤ পুথির শুরু নমঃ শ্রীবজ্রযোগিন্যৈ শব্দ দিয়ে।
¤কাআ তরুবর" নামক পদটি প্রথম পদ।
¤পুথিতে গানের সংখ্যা পঞ্চাশটি হলেও ২৩ সংখ্যক গানের ছয়টি চরণ ছাড়া ২৪,২৫,৪৮ সংখ্যক গান সম্পূর্ণ লুপ্ত।প্রাপ্ত পদের সংখ্যা সাড়ে ছেচল্লিশ টি।
¤ পদগুলো সাধারণত দশলাইনের,এর ব্যতিক্রম আছে।
¤ চর্যার পুথির সম্মুখ পৃষ্ঠায় ৭৪১ সংবৎ তারিখটি লেখা ছিল।
● পুঁথির নামকরণ:- ¤তিব্বতী ভাষায়" চর্যা" কথাটি সংস্কৃত আচার( অর্থাৎ আচরণ শব্দের সমার্থক। চর্যা কথাটি Study পাঠ বা অধ্যয়ন অর্থে ব্যাবহার করেছিলেন।ম্যাক্সমুলার " প্রজ্ঞাপারমিতা হৃদয়সূত্র" গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদে আবার হেবজ্রতন্ত্রে "চর্যা" অর্থে যথাক্রমে যোগীর আচার ব্যবহার।
¤হরপ্রসাদ শাস্ত্রী গ্রন্থটির নাম দেন চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়।
¤বিধুশেখর ভট্টাচার্য (শাস্ত্রী) তাঁর Indian Historical Quarterly " তে মন্তব্য করেছেন গ্রন্থের শুদ্ধ নাম হবে" আশ্চর্যচর্যাচয়" কারণ নির্মলগিরা টীকার বস্তু নির্দেশক শ্লোকে এই নামটি রয়েছে।
¤ প্রবোধচন্দ্র বাগচী " Calcutta Oriental Journal" এ মন্তব্য করেছেন এর নাম হবে " চর্যাশ্চয়বিনিশ্চয়"।কারণ নেপালী পুঁথিতে এই নাম রয়েছে।
¤ সুকুমার সেন অনুমান করেছেন এর নাম ছিল" চর্যাগীতিকোষ"।
¤ জাহ্নবী কুমার চক্রবর্তী " চর্যাগীতিকোষ"নামকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেন।
¤ ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় " চর্যাচর্যবিনিশ্চয়" নামটি গ্রহণ করার পক্ষপাতী।
● রচনাকাল:-
¤ ভাষাতাত্বিক সুনীতিকুমারের মতে দশম শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগের মধ্যে চর্যাগান রচিত হয়েছিল।আদি সিদ্ধাচার্য লুইপাদ ও কাহ্নপাদের সময়কাল ধরে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
¤রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করেন আদি সিদ্ধাচার্য সরহপাদ।
¤মহম্মদ শহীদুল্লাহ তিব্বতী ঐতিহ্য অনুসারে শবরপাদকে আদিসিদ্ধাচার্য বলেছেন।
¤(১০০০-১২০০) খ্রি: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতকেই সকলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
● পদ ও পদকর্তা:- চর্যাপদের ২৩/২৪ জন পদকর্তার নাম পাওয়া যায়।চর্যার পদকারদের " পাদ" শব্দটি প্রথমত পদবী অর্থে এবং সম্মান জ্ঞাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
¤ লুইপাদ রচিত পদের সংখ্যা ২ টি।
¤ কুক্করীপাদ ৩।
¤ বিরুআপাদ ১।
¤ গুড়রীপাদ ১।
¤চাটিল ১।
¤ভুসুকুপাদ ৮।
¤কাহ্নপাদ১৩/১২।
¤কমলিপাদ ১।
¤ডোম্বিপাদ ১।
¤শান্তি ২।
¤ মহিন্ডা ১।
¤বীনাপাদ ১।
¤সরহপাদ ৪।
¤ শবরপাদ ২।
¤ আজদেব ১।
¤ টেন্টনপা ১।
¤দারিক ১।
¤ভাদে ১।
¤ তাড়ক ১।
¤কঙ্কন ১।
¤জঅনন্দি ১।
¤ধাম ১।
¤ তন্ত্রীপাদ ১।
● টীকাকার:-
¤ চর্যার সংস্কৃত টীকা রচনা করেছেন মুনিদত্ত।তিনি লুইপাদ কে আদি সিদ্ধাচার্য বলেছেন।
¤চর্যার টীকার তিব্বতী অনুবাদ করেন কীর্তিচন্দ্র। ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার তিব্বতী অনুবাদ আবিষ্কার করেন।
● চর্যার ভাষা:- চর্যার ভাষা হচ্ছে সংকেতের ভাষা।হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয়ের মতে এজন্যই তার নাম সন্ধ্যা ভাষা।তাঁর মতে এই ভাষা -" আলো আঁধারি ভাষা,কতক আলো ,কতক অন্ধকার।"
¤ তিব্বতী ভাষায় সন্ধ্যা ভাষার অর্থ প্রহেলিকা চ্ছলে উক্ত দূরহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা।
¤ ম্যাক্সমুলার সন্ধ্যা শব্দটিকে প্রচ্ছন্ন অর্থে গ্রহণ করেছেন।
তথ্য সূত্র:- চর্যাপদ- ডঃ নির্মল দাশ।
আলোচনায়: সুশান্ত সরকার।
Success বাংলা, অ্যাডমিন