রামাই পন্ডিত ও শূন্যপূরাণ



রামাই পন্ডিত ও শূন্যপূরাণ

     নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় রামাই পন্ডিতের "শূন্যপূরাণ" আবিষ্কার ও সম্পাদনা করেন। জনশ্রুতি মতে তিনিই মর্ত্যধামে ধর্মপূজা প্রচার করেন। কারো মতে তিনি স্বয়ং ধর্মের অবতার। ধর্মমঙ্গলের কবিরা রামাইকে ধর্মপূজার আদিপ্রবর্তক বল বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন।
রামাই পন্ডিত সম্পর্কে একটি কাহিনি প্রচলিত আছে যে তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণকুমার। বাল্যকালে মাতৃপিতৃহীন হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তাঁকে পৈতে দেওয়ার কেউ ছিলোনা। তাই যথাকালে তাঁর চূড়াকরণ হলোনা দেখে স্বয়ং ধর্মঠাকুর এসে তাঁকে তাম্রদীক্ষা দিলেন। এই হলো তাঁর তামার পৈতে, ব্রাহ্মণের যজ্ঞোপবীত। তারপর তিনি বল্লুকানদীর তীরে গিয়ে ধর্মের তপস্যা করতে লাগলেন। ক্রমে বৃদ্ধ হলেন কিন্তু সংসার করা হলোনা। তাঁর পর কে ধর্মপূজা করবে এই ভেবে ধর্মনিরঞ্জনের নির্দেশে অতি বৃদ্ধ বয়সে রামাই বিবাহ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম কেশবতী। ধর্মের পুষ্পার্ঘ্যসিক্ত জল খেয়ে কেশবতী যথাকালে এক পুত্রের জন্ম দেন। রামাই পন্ডিত পুত্রের নাম রাখেন ধর্মদাস। সে বড়ো হয়ে পিতার নির্দেশে নানাস্থানে ধর্মঠাকুরের মহিমা প্রচার করে বেড়াতে লাগলেন। একদিন দুষ্ট কলির প্ররোচনায় তিনি কিছু অনাচার করে ফেললেন। তা জানতে পেরে রামাই, পুত্রকে অভিশাপ দিলেন--"হইবি ডোমের পুরোহিত"। এ কাহিন থেকে দেখা যায় রামাইয়ের পুত্র থেকে ধর্মপূজকগণ ডোমের পুরোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। পুত্রের দুঃখ দেখে রামাই তাকে আশ্বাস দেন, ডোমের পুরোহিত হলেও ধর্মদাস ও তার সন্তান সন্ততি সমাজে ব্রাহ্মণের মতোই শ্রদ্ধা পাবে। এরপর ধর্মদাস রাজা রণজিত ও তাঁর সভার ঋষিদের ধরূমঠাকুরের বিরোধিতার জন্য খুব নাকাল করলেন। তারপর এঁরা আর্ত হয়ে ধর্মের পূজা করে বিপদ থেকে মুক্ত হলেন। ধর্মঠাকুরের বরে রাজার একটি পুত্র হল ক্রমে ধর্মদাসেরও বংশবৃদ্ধি হলো। এবং ধর্মের উপাসক ডোম জাতির পুরোহিতদের অভাব ঘুচে গেলো।
* রামাইয়ের ভণিতাযুক্ত দুটি পুঁথি পাওয়া গেছে। 1) শূন্যপূরাণ 2) অনাদ্যের পুঁথি।
শূন্যপূরাণের প্রকৃত নাম ' "আগমপুরাণ" বা "রামাইপন্ডিতের পদ্ধতি" । কিন্ত এর নানাস্থানে শূন্যের উল্লেখ থাকায় সম্পাদক নগেন্দ্রনাথ বসু একে " শূন্যপুরাণ" বলেছেন। অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন এর প্রকৃত নাম হওয়া উচিত " আগমপুরাণ" কারণ এর ভনিতায় রামাই আগম পুরাণই বলেছেন। এটি রামাই পন্ডিতের রচনা হলেও নানাজনের হস্তক্ষেপ দেখা যায়। ধর্মের গাজনে যেসব ছড়া ব্যবহৃত হতো এতে সেগুলি রয়েছে। ধর্মনিরঞ্জন কর্তৃক বিশ্বসৃষ্টি প্রভৃতি উৎপত্তিপর্ব, ধর্মপূজার ব্রত, উপাসনা, ভোগরাগ রন্ধন, পূজাবিধি বিষয়ে অনেক তথ্য এতে আছে। ধর্মমঙ্গলের হরিশ্চন্দ্র-লুইচন্দ্রের কাহিনির উল্লেখ আছে। এর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হল
"নিরঞ্জনের রুষ্মা" শীর্ষক কতগুলি অদ্ভুত ছড়া। এই ছড়া কোনো কোনো ধর্মমঙ্গল কাব্যে পুনরুল্লিখিত হয়েছে।
* ছড়া-- সদ্ধর্মীদের (বৌদ্ধ) ওপর যাজপুরের (ওড়িশা) বৈদিক ব্রাহ্মণরা অত্যাচার করতে থাকলে ধর্মের উপাসকগণ ধর্মঠাকুরের কাছে আর্তস্বরে নিবারণের প্রার্থনা জানাতে লাগলো। তখন ধর্মঠাকুর বৈদিক ব্রাহ্মণদের শাস্তি দিয়ে ধর্মের উপাসকদের রক্ষার্থে মর্ত্যে অবতীর্ণ হলেন। সঙ্গে এলেন স্বর্গের দেবদেবীরা। তবে এঁরা এলেন মুসলমানের ছদ্মবেশে। এঁরা জাজপুরে অবতীর্ণ হয়ে মুসলমানদের জেহাদের ধ্বনি করতে করতে বৈদিক ব্রাহ্মণদের উচিত শাস্তি দিয়ে সদ্ধর্মীদের রক্ষা করলেন।
নিরঞ্জন নিরাকার
হইল ভেস্ত অবতার
মুখেতে বলয়ে দম্বদার।
যতেক দেবতাগণ
সভে হৈয়া একমন
আনন্দেতে পরিল উজার।
ব্রহ্মা হইল মহম্মদ
বিষ্ণু হইল পেগাম্বর
আদম হইল শূলপাণি।
গণেশ হইল কাজী
কার্তিক হইল গাজী
ফকির হইল যত মুনি।।

(আলোচক - গার্গী চ্যাটার্জী
Success বাংলা) 

Share this