কল্লোল ও বাংলাসাহিত্য।

আধুনিক বাংলা কবিতা কোনগুলি? এ প্রশ্নের উত্তরে সাহিত্যের ছাত্রছাত্রীদের সাধারণ অর্থে রবীন্দ্র পরবর্তীযুগের কবিতার কথাই মনে আসে। সেই সূত্র ধরে আসে ‘কল্লোল’এর কথাও। কল্লোল  [বিশেষ্য পদ] এর অর্থ মহাতরঙ্গ বা  কলরব । কল্লোলযুগের শুরুর কাহিনীর জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হয় ভারতীয় ইতিহাসের বিশের দশকের দিকে। উত্তাল সময়। একদিকে ইংরেজ শাসনের অত্যাচার,  প্রথম মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ, পশ্চিমে রাশিয়ার সাম্যবাদী বিপ্লব,  বিশ্বজুড়ে মার্ক্সিস্ট চিন্তাধারার বিস্তার, অন্যদিকে নিজ দেশের শিল্পসাহিত্য জগতের থমকে থাকা ভাব। ঠিক এই সময়টিতে চারজন তরুণ মানুষ গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাস, সুনিতা সেন ও মানবেন্দ্রনাথ বাসু মিলে একটা ঘরোয়া আড্ডার আয়োজন করেন, “ফোর আর্টস ক্লাব” নাম দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল সাহিত্য, শিল্পকলা, সঙ্গীত ও নাটক সম্পর্কিত আলোচনা এবং নিয়মিত চর্চা। একই সাথে তাঁরা ‘ঝড়ের দোলা’ নাম দিয়ে একটা ছোট গল্পের সংকলন বের করেন, ১৯২২ সালে। ঝড়ের দোলার প্রেরণা নিয়েই দীনেশরঞ্জন দাস ও গোকুলচন্দ্র নাগ, দুবন্ধুতে মিলে একটি সাহিত্যগোষ্ঠী এবং তার সাথে একটা সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেন যার নামকরণ করা হয় “কল্লোল”। সালটা ১৯২৩। মাত্র সাতবছর (১৯২৩-১৯৩০) চলা এই পত্রিকাটির প্রভাব আজও অস্বীকার করা যায় না।

* নতুন কিছু করার প্রয়াস নিয়ে শুরু হওয়া ‘কল্লোল’ অভিনবত্ব আনে বিষয়ে, রচনাভঙ্গিমায় এবং লেখকগোষ্ঠীতে। সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখার স্টাইলের বিরোধিতা পত্রিকাটির অন্যতম লক্ষ্য ছিল বলেই মনে হয়, কিন্তু পরবর্তীকালের ভাবহীন সৌন্দর্যহীন ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রাথমিক পর্যায়ের সুরের সাথে মেলে না। শুরুর রূপকার অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের মন্তব্য বিশেষ উল্লেখ্য - ‘‘ভাবতুম, রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের শেষ, তাঁর পরে আর পথ নেই, সংকেত নেই। তিনিই সবকিছুর চরম পরিপূর্ণতা। কিন্তু “কল্লোলে” এসে আস্তে আস্তে সে-ভাব কেটে যেতে লাগল। বিদ্রোহের বহ্নিতে সবাই দেখতে পেলুম যেন নতুন পথ, নতুন পৃথিবী। আরো মানুষ আছে, আরো ভাষা আছে, আছে আরো ইতিহাস। সৃষ্টিতে সমাপ্তির রেখা টানেননি রবীন্দ্রনাথ- তখনকার সাহিত্য শুধু তাঁরই বহুকৃত লেখনির হীন অনুকৃতি হলে চলবে না। পত্তন করতে হবে জীবনের আরেক পরিচ্ছেদ’’।

* কল্লোল-ই সমকালের ইংরাজি এবং বিদেশি লেখকদের অনুসরণে বাংলাসাহিত্যের পাঠকের পরিচয় করায় এমিল জোলার ন্যাচারালিজম, বোদলেয়ারের শারীরিক ভাবনা, ইংল্যন্ডের ‘ব্লুমসবেরি’ সাহিত্যিক গোষ্ঠীর তির্যক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে। অন্যদিকে মার্ক্স, ফ্রয়েডও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে এই সাহিত্যগোষ্ঠীকে ফলত তৈরি হয় এক নতুন রচনাশৈলীর।

বাংলা সাহিত্যে কল্লোলের অবদান সূত্রাকারে এভাবে সাজানো যেতে পারে-

* অপরিণত রোমান্টিক তরল আবেগের বদলে সাহিত্যে আসে প্রান্তিক মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্র।
* মধ্য ও নিম্নবিত্ত মানুষের আর্থিক দুর্গতির প্রতি সহানুভূতি।
* নরনারীর সম্পর্ক বিচারে সংস্কারমুক্ত প্রকাশভঙ্গী।
* সাহিত্যে পোয়েটিক জাস্টিসের বিরোধীতা। অর্থাৎ প্রচলিত মূল্যবোধ ধর্ম-প্রেম-সত্য-সৌন্দর্য্যের প্রতি আস্থাহীনতা।

পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত ‘মহানগর’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘পুন্নাম’, ‘স্টোভ’(প্রেমেন্দ্র মিত্র), ‘রসকলি’(তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গল্প), ‘কয়লাকুঠির দেশ’ (শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়) সবকটির পাঠেই উপরের বৈশিষ্ট্যগুলি স্পষ্ট।অন্যদিকে ‘কল্লোল’-এর সমালোচনাও হয়েছিল বিস্তর। ‘নীলকন্ঠ’ ছদ্মনামে দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্ন্যাল তীব্র ভাষায় বলেন- “কল্লোল কোনও কালে যুগ নয়; কোনও এককালে হুজুগ ছিল,- এখন তাও নয়”। পরবর্তীকালে আধুনিকতার নামে নিম্নরুচির সাহিত্য চর্চা কল্লোলের মুখ্য উদ্দেশ্য ব্যহত করে। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগরণের যুগে বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সূচনা হয়। এই সময় থেকে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর বদলে মানব-মনস্তত্ত্ব বাংলা সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। এরপর রবীন্দ্র-প্রভাবের মধ্যেই কল্লোল পত্রের মাধ্যমে একদল তরুণ কবি-সাহিত্যিকের হাতে পাশ্চাত্য আধুনিকতার পত্তন হয়। যা আখেরে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধই করেছিল।

আলোচক: - জুঁই ব্যানার্জী ( সদস্য সাকসেস বাংলা)

Share this