নাথ সাহিত্য
============================
============================
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য প্রধানত বিভিন্ন ধর্ম ও উপধর্ম সম্প্রদায়ের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। শাক্ত , শৈব , বৌদ্ধ , বৈষ্ণব-- এগুলি প্রধান ধর্ম সম্প্রদায়। এই মিশ্র ধর্মচেতনা সারা ভারতবর্ষকেই নিয়ন্ত্রিত করেছে। শৈব নাথ ধর্মমতও বিচিত্র ধর্মবোধের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশে শৈব নাথ সম্প্রদায় এখনও আছে। যুগী নামেই তারা পরিচিত।দশম শতাব্দীর দিকে সারা উওর ভারতে গোরক্ষপন্থী নাথ সম্প্রদায় ছিলো। পশ্চিম ভারতেও এঁদের প্রভাব দেখা যায়। বাংলাদেশেও এই সম্প্রদায় অতি প্রাচীনকাল থেকে নিজেদের সাধনভজন করে আসছিলেন এবং এখনও নানা শাখায় এঁরা বাংলাদেশের নানা অঞ্চলে ছড়িয়ে আছেন। এঁদের ধর্মকর্ম ও আচার আচরণকে কেন্দ্র করে অনেক ছড়াপাঁচালী, লোকগীতি, আখ্যানকাব্য পাওয়াগেছে। সাহিত্যের ইতিহাসের দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন এই সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত ময়নামতীর গান , গোপীচন্দ্রের গান , গোরক্ষবিজয় প্রভৃতি ছড়াগান ও আখ্যানকাব্য বাংলা সাহিত্যের আদিপর্ব অর্থাৎ দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে রচিত হয়েছিলো।
একসময় ভারতের কোন কোন দার্শনিকগোষ্ঠী জড়দেহকে মুক্তির বাধা না বলে সোপান হিসেবেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাঁরা নানা ধরনের যৌগিক , তান্ত্রিক, রাসায়নিক , আয়ুর্বেদ সংক্রান্ত ভিষগবিদ্যার সাহায্যে জড়দেহকে পরিশুদ্ধ করঃ তার সাহায্যে মোক্ষ মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষা করতেন। এঁরা দর্শন হিসাবে পতঞ্জলির যোগদর্শন ও ক্রিয়াকর্ম হিসাবে তন্ত্র ও হঠযোগের সাহায্য নিয়ে পিন্ডদেহকে দিব্যদেহে পরিণত করতে প্রয়াসী হন। এককথায় এঁদের যোগীসম্প্রদায় বলে। কারণ এঁদের সাধনার দার্শনিক ভিত্তি পতঞ্জলির যোগ দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এঁরা কায়াসাধনা করতেন অর্থাৎ পিন্ডদেহ বা ভূতকায়ার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। অনেকে মনেকরতেন এই সাধনার দ্বারা ভঙ্গুর জীবনকে "অজরামরবৎ প্রাজ্ঞ" করা যায়।
যোগের দ্বারা প্রাণায়ামাদির দ্বারা এঁরা নিশ্বাস প্রশ্বাসকে ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রিত করতে পারতেন। পূরক-কুম্ভক-রেচক শীর্ষক বায়ু বশীভূত করে এঁরা মোক্ষলাভের প্রথম সোপান অতিক্রম করতেন। তারপর তন্ত্রের কুলকুন্ডলিনী তত্ত্ব অবলম্বনে নিজ দেহমধ্যে শিরঃস্থিত সহস্রদলযুক্ত পদ্মসহস্রারে, শিবশক্তির মিলনসম্ভূত দিব্যানুভূতি লাভকরতেন। তখন অবশ্য পাঞ্চভৌতিক জড়দেহ অপার্থিব দিব্যদেহে পরিণত হত। এঁরা মূলত আত্মবাদী, ঈশ্বরবাদী ততটা নন। সাধন প্রক্রিয়ার দ্বারা নিজের মোক্ষলাভ হল এঁদের সাধনা। শিব এঁদের আদি গুরু। তিনিই আদিনাথ। তাঁর শিষ্য মীননাথ। মীননাথের শিষ্য গোরক্ষনাথ। এই গোরক্ষনাথের পবিত্র জীবনকাহিনি নিয়ে সারা ভারতেই কত গান গল্প রচিত হয়েছে। ইনি নিজের গুরু মীননাথকে বুদ্ধিভ্রষ্টতা থেকে উদ্ধার করে স্মরণীয় হয়েছেন। শিব আদিনাথ হলেও চরিত্রগৌরবে গোরক্ষনাথ অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেছেন। মানুষ হয়ে মাহাত্ম্যে দেবতাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। তাই নাথপন্থীরা কোন কোন প্রদেশে গোরক্ষপন্থী নামেও পরিচিত।
নাথধর্মে ন-জন গুরুর কথা জানা যায়। বৌদ্ধ তান্ত্রিকরাও তাঁদের ৮৪ জন সিদ্ধাচার্যের সাথে এই নয়-জন নাথের পূজা করতেন। তাঁদের নাম --- পূর্বে গোরক্ষনাথ। উওরপথে জলন্ধর। দক্ষিণে নাগার্জুন। পশ্চিমে দত্তাত্রেয়। দক্ষিণ-পশ্চিমে দেবদত্ত। উওর-পশ্চিমে জড়ভরত। কুরুক্ষেত্র ও মধ্যদেশে আদিনাথ এবং দক্ষিণ- পূর্বে সমুদ্রোপকুলে মৎসেন্দ্রনাথ।
আলোচক - গার্গী চ্যাটার্জী
আলোচক - গার্গী চ্যাটার্জী