আলোচনার কলমে শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায় স্মরণ
জন্ম কথা:
১৮৯৯ সালের ৩০শে মার্চ জৌনপুরে শরদিন্দুর জন্ম, বড়ো হয়েছেন মুঙ্গেরে আর পাটনায়। বংশে ওকালতি করার চল ছিলো। প্রথম কবিতা লেখেন চোদ্দো বছর বয়সে।, প্রথম সম্পূর্ণ গল্প লেখেন ষোলো বছর বয়সে।প্রথম কবিতার বই যখন ছাপা হয় ,তখন তাঁর বয়স কুড়ি। বাবার আগ্রহাতিশয্যে ওকালতি শুরু করেন এই সময় ।তিন বছর পরে তা ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন । ১৯২৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত গল্প লিখেছেন। তারপর তখনকার নামকরা মাসিক পত্রিকার লেখকগোষ্ঠীতে ঢুকে পড়েন।তাঁর লেখা প্রথম গল্পের বই 'জাতিস্মর' ,প্রকাশ পায় ১৯৩২সালে। ১৯৩৮ সালে মুম্বই যান বোম্বে টকীজে চিত্রনাট্য লেখার চাকরী নিয়ে।স্বাধীন চিত্রনাট্যকার হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেখানে সফল হওয়া সত্ত্বেও সিনেমার জগত ছেড়ে পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় ফিরে আসেন ১৯৫২ সালে। প্রথম জীবন বাংলায় কাটলেও জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছেন মুম্বই আর পুনে তে।পুনে বাড়ি কিনে নাম রাখেন 'মিথিলা'। জীবনের শেষ টুকু ওই বাড়ি তেই তাঁর কাটে। প্রথিতযশা এই লেখকের মৃত্যু হয় ১৯৭০ সালের ২২ শে সেপ্টেম্বর ।
১৯৩২ সালে প্রথম প্রকাশ থেকে ১৯৭০ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত শরদিন্দুর চল্লিশাধিক বছরের সাহিত্যচর্চার ধারা তারাশঙ্করের মতো বাঁধভাঙা জলস্রোত না হলেও ক্ষীণতোয়া বলা যায় না। তেষট্টিটি মৌলিক বইয়ের হিসেব পাওয়া যায়। এ ছাড়া সঙ্কলন ও রূপান্তর-- যথা গল্পের ভিত্তিতে উপন্যাস, চিত্রনাট্যের উপন্যাসরূপ ইত্যাদি কিছু লেখারও বেশ কয়েকটি পরিচয় পাওয়া যায় ।সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে তাঁর বিচরণ, তার মধ্যে আছে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, কিশোর সাহিত্য, ,ভৌতিক গল্প ,অনুবাদ। রেকর্ডের জন্য পালাও লিখেছেন। একটি মাত্র অনুবাদ করেন তাকে ঠিক ভাষান্তর বলা যায় না, ছায়া অবলম্বনে বলা ঠিক হবে, সেটি এতোই উৎকৃষ্ট যে সেটিকে মৌলিক সাহিত্যের তকমা দিলে গর্হিত অপরাধ হবে না। প্রবন্ধও লিখেছেন, তবে তা 'চন্দ্রহাস' ছদ্মনামে। এই ছদ্মনামে কিছু কবিতাও লিখেছেন। সংখ্যা গুণলে ছোটো গল্পই সবচেয়ে বেশী, সংখ্যায় দুশো বাইশ, ছত্রিশটি বইতে সংগৃহীত; উপন্যাস তেরোটি, নাটক ও চিত্রনাট্য তেরোটি, কিশোরপাঠ্য কাহিনী আটাশটি। জনপ্রিয়তা তো ছিলোই, তাছাড়াও 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' উপন্যাসের জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন, কিশোর সাহিত্যের জন্য ভারত সরকারের দেওয়া পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎস্মৃতি পুরস্কার, এছাড়া আর কিছু পত্রপত্রিকার পুরস্কারও তাঁর ভাগ্যে জুটেছিলো।
পাঁচটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস আর সতেরোটি গল্প নিয়ে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনীর ভাণ্ডার। ১৯৩২ সালে "জাতিস্মর" নামের বইতে তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প "অমিতাভ" প্রকাশিত হয়।। প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস "কালের মন্দিরা" ১৯৩৮ সালে শুরু করেন, কিন্তু সিনেমার কাজ করতে যখন মুম্বই ছিলেন তখন এই লেখা বন্ধ রাখতে হয়।, তারপর ১৯৫০ সালে উপন্যাস টি লেখা শেষ করেন। ঐতিহাসিক ঔপন্যাসিক বলে তিনি বিশেষ খ্যাত হয়েছিলেন ।অনেক বিদ্বজ্জন তাঁর ঐতিহাসিক রচনা পড়ে মন্তব্য লেখেন।
শরদিন্দু কবিতাও লিখেছেন।সেগুলো প্রকাশ করেন কিছু নিজের নামে আর কিছু 'চন্দ্রহাস' ছদ্মনামে। সব মিলিয়ে সত্তর-পঁচাত্তরটি কবিতা তিনি লেখেন। এই কবিতা গুলি --- 'যৌবনস্মৃতি' (১৯২০) আর 'তনুমন' (১৯৬২)-- নামক কাব্যগ্রন্থে গ্রথিত। এছাড়া তাঁর অনেক নাটকেই গান আছে এবং তা তাঁর নিজেরই লেখা।আর তাঁর পদাবলী ধাঁচে লেখা 'রাধাকৃষ্ণ পালা' (১৯৭৬) আর রেকর্ডের পালা 'উমার তপস্যা'ও (১৯৩৭) ছন্দমিলবদ্ধতার দেখা মেলে। বৈষ্ণব কবিদের মতো ব্রজবুলিতে লেখা পদ তাঁর পছন্দ ছিলো, তাঁর কবিতাগুচ্ছে তার কিছু ছাপ দেখতে পাওয়া যায়।তাঁর লেখা গুলো দেখলে 'ভানুসিংহের পদাবলী'র কথা মনে আসতে পারে। এ ছাড়া যে সামান্য কটি কবিতা বাকী থাকে তা করুণানিধান-কুমুদরঞ্জন-কালিদাস রায়ের লেখনশৈলীর অনুগামী।
তার ঐতিহাসিক উপন্যাস গুলি হলো:-
'কালের মন্দিরা'(১৯৫১),
'গৌড় মল্লার'(১৯৫২),
'তুমি সন্ধ্যার মেঘ'(১৯৫৮),
'কুমারসম্ভবের কবি'(১৯৬৩ )
'তুঙ্গভদ্রার তীরে'(১৯৬৫)।
কমবেশি ২০০টি ছোট গল্প রচনা করেছেন।
তাঁর লেখা প্রথম ছোট গল্প---' জাতিস্মর'(১৯২৯)
উল্লেখযোগ্য অন্যান্য ছোট গল্পগুলি হলো---
অলৌকিক রসের বা অতিপ্রাকৃত রসের ছোট গল্প---'সবুজ চশমা' ,'ভূত ভবিষ্যৎ', ফকির বাবা','দেহান্তর প্রভৃতি।
ইতিহাসাশ্রয়ী গল্প-- 'শঙ্খ-কঙ্কন', 'অমিতাভ','রক্ত সন্ধ্যা' প্রভৃতি।
সামাজিক গল্প---ঘড়ি, সাদা পৃথিবী,স্বাধীনতার রস,গোদাবরী, ভল্লুসর্দার প্রভৃতি।
ব্যোমকেশ বক্সী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সৃষ্ট সবচেয়ে জনপ্রিয় চরিত্র।গোয়েন্দা হিসাবে ব্যোমকেশ চরিত্র তার অসামান্য কৃতিত্ব বহন করে। ব্যোমকেশ নিজেকে সত্যান্বষী বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। ১৯৩২ এ 'পথের কাঁটা' উপন্যাসে ব্যোমকেশের আত্মপ্রকাশ। প্রথমে শরদিন্দু অজিতের কলমে লিখতেন। কিন্তু পরে তিনি তৃতীয়পুরুষে লিখতে শুরু করেন।
ব্যোমকেশ এর সহযোগী ছিলেন অজিত।
শরদিন্দুর লেখা ব্যোমকেশের গল্প:---
শরদিন্দু ব্যোমকেশ কে নিয়ে ৩৩টি গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন।
'পথের কাঁটা'(১৯৩২) হলো প্রথম ব্যোমকেশ কে নিয়ে কাহিনী।
শেষ গল্প ---'বিশু পাল বধ' (১৯৭০)।
তার সৃষ্ট ব্যোমকেশ বক্সী সিরিজ
মূল নিবন্ধ: ব্যোমকেশ বক্সী
ব্যোমকেশের ডায়েরী (১৯৩৩)
ব্যোমকেশের কাহিনী (১৯৩৩)
ব্যোমকেশের গল্প (১৯৩৭)
দুর্গরহস্য (১৯৫২)
চিড়িয়াখানা (১৯৫৩)
আদিম রিপু (১৯৫৫)
বহ্নি-পতঙ্গ (১৯৫৬)
সসেমিরা (১৯৫৯)
কহেন কবি কালিদাস (১৯৬১)
ব্যোমকেশের ছ'টি (১৯৬২)
ব্যোমকেশের ত্রিনয়ন (১৯৬২)
মগ্নমৈনাক (১৯৬৩)
শজারুর কাঁটা (১৯৬৭)
বেণীসংহার (১৯৬৮)
আরো অন্যান্য গল্প ও লেখা গুলি হলো------"অর্থমনর্থম", , "চোরাবালি", "দুর্গরহস্য", "রক্তের দাগ", "পথের কাঁটা", "হেঁয়ালির ছন্দ", শরদিন্দুর বিচার: "অগ্নিবাণ " প্রভৃতি।
শরদিন্দু ও সিনেমা:-
শরদিন্দুর জীবনে সিনেমার, বিশেষ করে বম্বের সিনেমার, খুব বড় ভূমিকা ছিল। তিনি যে ছবিগুলিতে চিত্রনাট্যকারের কাজ করেছেন সেগুলি হল দূর্গা (১৯৩৯), কঙ্গন (১৯৩৯), নবজীবন(১৯৩৯) ও আজাদ (১৯৪০)। তাঁর বিভিন্ন রচনা থেকেও সিনেমা তৈরি হয়েছে, যেমন নিম্নলিখিত বাংলা সিনেমাগুলি
চিড়িয়াখানা - নির্দেশক সত্যজিত রায়
ঝিন্দের বন্দী - নির্দেশক তপন সিংহ
বিষের ধোঁয়া
দাদার কীর্তি - নির্দেশক তরুণ মজুমদার
'তিশগ্নি' নামে একটি পুরস্কারপ্রাপ্ত হিন্দি ছবি লেখকের ঐতিহাসিক ছোটগল্প 'মরু ও সঙ্ঘ'র চিত্ররুপ।
তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার (উপন্যাস 'তুঙ্গভদ্রার তীরে'র জন্য), শরৎস্মৃতি পুরস্কার , মতিলাল পুরস্কার প্রভৃতি পুরস্কার লাভ করেন।
আলোচনায়---অমিয়তোষ ঘোষ
(Success বাংলা)