বাংলা সাহিত্যে স্বপ্রতিভায় চির সমুজ্জ্বল কাজী নজরুল


বাংলা সাহিত্যে স্বপ্রতিভায় চির সমুজ্জ্বল কাজী নজরুল

     বাংলা কাব্য সাহিত্যের জগতে কবি রবীন্দ্রনাথের পরই যার নাম আমাদের মনে আসে তিনি হলেন  কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কবি নজরুল ইসললাম বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দে ১১ জ্যৈষ্ঠ, পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার ‘চুরুলিয়া’ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ডাক নাম ছিল দুঃখু মিঞা। পিতা ছিলেন কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন।
কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির জীবনে ও সাহিত্যে হয়ে উঠেছেন এক প্রবাদ প্রতিম ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে শুধু উন্নত ও সমৃদ্ধই করেননি,  মৌলিক কাব্য-প্রতিভার ছাপ রেখে গেছেন। তাই এখনও তিনি যুগ প্রবর্তক কবি হিসেবে স্বীকৃত। বিদ্রোহী কবি বলে সমাধিক খ্যাত কবি নজরুলের মরমী কবিতা, অসংখ্য গান আজও পাঠক-শ্রোতাকে সমভাবে আপ্লুত করে রাখে। কাজী নজরুল যে বিশাল সাহিত্য ভান্ডার রচনা করেছেন তার তুলনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তিনি যে কত বড় কবি ও সাহিত্যিক ছিলেন তা বলে শেষ করা যাবে না।
বাংলা সাহিত্যে যার আবির্ভাব ধূমকেতুর মত, নিপীড়িত মানুষের কবি, বিদ্রোহী কবি, তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল। কাজী নজরুল ইসলামকে চেতনা ও জাগরণের কবিকে বলাও হয়। তিনি মূলত একজন কবি হলেও সাহিত্যের সব শাখাতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নজরুল শুধু শিল্পী-সুরকার, গীতিকার, কবি, উপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, সম্পাদক ও আপোষহীন সৈনিকই নন। তিনি ছিলেন সেকালের শক্তিধর এক কলমযোদ্ধা। তাঁর লিখনীতে ফুটে ওঠেছে বিদ্রোহী মানুষের চাওয়া-পাওয়া। কবি তাঁর ক্ষুরধার লিখনীর মাধ্যমে অন্যায়, জুলুম ও অত্যাচারে বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেন। যা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ও তাদের অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ছিল, ‘ব্রজের ন্যায় কঠিন, হীরার চেয়ে ধারালো’। এ কারণেই বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুল স্বপ্রতিভায় চির সমুজ্জ্বল। গল্প, উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস সব শাখাতেই বিচরণ ছিল মহাপ্রতিভাবান কবি কাজী নজরুল ইসলামের। কেবল গানই সৃষ্টি করেছেন চারহাজারের কাছাকাছি। অধিকাংশে সুরারোপ করেছেন তিনি নিজেই, যেগুলো এখন নজরুল সঙ্গীত বা "নজরুল গীতি" নামে পরিচিত এবং বিশেষ জনপ্রিয়। এত গান পৃথিবীতে আর কোন কবি-গীতিকার লিখেছেন বলে জানা নেই। গান ছাড়াও রয়েছে তার অজস্র ছড়া-কবিতা। লিখেছেন বেশ কিছু ছোট গল্প ও উপন্যস। লেখালেখির পাশাপাশি সুর সৃষ্টি ও সংগীত পরিচালনাও করেছেন তিনি। এমন কি চলচ্চিত্র পরিচালক, সূরকার, গায়ক ও অভিনেতা হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। ‘নবযুগ, অর্থ সাপ্তাহিক, ধুমকেতু, লাঙল ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব ও পালন করেছেন।
তিনি ছিলেন তৎকালীন যামানার কাঁটাভরা দুর্গম পথের এক নির্ভীক সাংবাদিকও। তিনি বড়দের জন্য লিখেছেন অনেক অনেক প্রবন্ধ-গল্প ও কবিতা। তাই বলে নজরুল ছোটদের ভুলে যাননি। নজরুল ছোটদের জন্য রেখে গেছেন শিশুসাহিত্যের এক সুবিশাল ভান্ডার। লিখেছেন অনেক ছড়া- কবিতা। বড়দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় হল যে, নজরুল একজন মানবতাদী কবি, যিনি সাধারণ মানুষের জন্য লিখেছেন, মানবতার গান গেয়েছেন, স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছেন। তিনি চিরকাল শোষিত-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কাজ করেছেন। বাংলা সাহিত্য ও সংগীত জগতে তিনি নিয়ে এসেছেন ‘সৃষ্টি সুখের উল্লাস’।
* কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য জীবন শুরু হয় পালা গান রচনায়। অবশ্য তিনি শৈশবেই যাত্রাপালায় অভিনয় করতে শুরু করেন।  তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা মুক্তি (১৩২৬) বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় শ্রাবণ সংখ্যায়।  প্রথম প্রবন্ধ ‘তুর্ক মহিলার ঘোমটা খোলা’ প্রকাশিত হয় ‘সওগাতে’ ১৩২৬ সনে, কার্তিক সংখ্যায়।  নজরুলের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ 'ব্যথার দান'(১৯২১)। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লেখা হয় ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় ১৯২২ সালের জানুয়ারিতে। প্রথম গদ্য প্রবন্ধ ‘যুগবাণী’ (১৯২২)। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২)। 

কাব্যগ্রন্থ:
অগ্নিবীণা, দোলনচাঁপা, বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, চিত্তনামা, ছায়ানট, সাম্যবাদী, পূবের হাওয়া, প্রলয় শিখা, সিন্ধু-হিন্দোল, সর্বহারা, জিঞ্জির ইত্যাদি।
#কাব্যানুবাদ গ্রন্থ:
* নজরুল ফারসি কবি হাফেজের কাব্যের অনুবাদও করেছিলেন। নজরুলের অনুবাদ কাব্যগুলি হল-- 
'রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ'(১৩৩৭), 'রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম' 'কাব্যে আমপারা'।
#গানের গ্রন্থ:
বুলবুল, চোখের চাতক, বনগীতি,গানের মালা,চন্দ্রবিন্দু।
#উপন্যাস
'বাঁধন হারা', 'মৃত্যুক্ষুধা', 'কুহেলিকা' ও 'জীবনের জয়যাত্রা'।
#ছোটগল্প:
'ব্যথার দান', 'রিক্তের বেদন',  'শিউলি মালা' ও 'সোনালী স্বপন' ।
#নাটক
'ঝিলিমিলি', 'আলেয়া',
'পুতুলের বিয়ে'। এছাড়াও রেকর্ড কোম্পানির জন্যও কিছু নাটক লেখেন--  বিদ্যাপতি, শ্রীমন্ত, ইদলফেতর, প্রীতি উপহা, বনের বেদে, মধুবালা প্রভৃতি।
#প্রবন্ধ:
'যুগবানী', 'দুর্দিনের যাত্রী', 'রুদ্র মঙ্গল'।
#শিশুতোষ_গ্রন্থ:
নজরুল বেশকিছু-শিশু বিষয়ক কাব্য-কবিতা-নাটক রচনা করেছেন--
ঝিঙেফুল, সাত ভাই, চম্পা, নতুন চাঁদ প্রভৃতি।
#সম্পাদিত_পত্রিকা
'ধূমকেতু', 'লাঙ্গল' ও 'দৈনিক নবযুগ'
* নজরুল ইসলামের কবিতা, গান গুলি সে যুগে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এখনো সমান ভাবে সেগুলির জনপ্রিয়তা রয়েছে। পৃথিবীর যেখানে বাংলাভাষী রূপে যারা বাস করে, নজরুল তাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছেন। রবীন্দ্রনাথের মতই তাঁর কবিতা ও গান বাংলা সাহিত্যে তাকে অমর করে দিয়েছে।

তথ্য সংগ্রহ ও সংযোজনায় - সুশান্ত কর্মাকার
#গ্রন্থপঞ্জি:
(১) বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস - ডঃ সুকুমার সেন (৫ম খণ্ড)।
(২) বাংলা সাহিত্য পরিচয় - ডঃ পার্থ চট্টোপাধ্যায়।
(৩) বংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত - অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

Share this