গানের ভেলায় রবীন্দ্রনাথ


                    ♦গানের ভেলায় রবীন্দ্রনাথ♦
 
                                (এক)

  উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা গানের ভুবনে যেন এক নবজোয়ার এল। ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। যদিও এর ঠিক এক দশকের মধ্যেই বাংলাদেশে এমন কয়েকজন প্রতিভার আবির্ভাব ঘটে, যাঁদের কথা অন্তত একবার না জানানো নিতান্তই অন্যায়। তাঁরা হলেন,দ্বিজেন্দ্রলাল রায়(রবীন্দ্রনাথের থেকে দুবছরের ছোট),রজনীকান্ত সেন(চার বছরের ছোট),অতুলপ্রসাদ সেন(দশ বছরের ছোট)। রবীন্দ্রনাথ সহ এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক।

       বাংলাদেশের সমাজ,বাঙালির মানসিকতা ও সংস্কৃতিকে উপলব্ধি করার জন্যে যে পরিবেশ ও পরিবারের প্রয়োজন হয়েছিল,তা অতি শৈশবকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথকে প্রভাবিত করেছিল। আর এই কারণেই,
 'রবীন্দ্রনাথের মতো বিরাট এবং বহুমুখী প্রতিভা বঙ্গদেশে আর জন্মগ্রহণ করেননি।'(১) জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সেইসময়ের কলকাতার সাহিত্য, সঙ্গীত, সংস্কৃতি, চিত্রকলা ও নাটকের পীঠস্থান ছিল। জানা যায়,প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ভালো গান ও বাজনা জানতেন। দেবেন্দ্রনাথও ব্যাতিক্রম ছিলেন না। তিনি অনেক গান লিখে তাতে সুর দিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ,সত্যেন্দ্রনাথ এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বড়ো সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। এই পরিবেশেই বেড়ে উঠলেন সঙ্গীতপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ। প্রথাগত ঘরানায় রবীন্দ্রনাথ গান শিখতে আগ্রহী না থাকলেও তাঁকে বাধ্য হয়ে যদু ভট্ট,বিষ্ণু চক্রবর্তী, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী এবং শ্যামসুন্দর মিশ্র প্রমুখ ব‍্যক্তিদের তত্ত্বাবধানে গান শিখতে হয়। তিনি যে ওস্তাদদের কাছে গান শিখেছিলেন,তাঁরা বেশিরভাগই গাইতেন ধ্রুপদ। রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত ছিলেন। সেই সময়ের ব্রাহ্মসমাজে গাওয়া হতো ধ্রুপদাঙ্গ ব্রহ্মসঙ্গীত। ফলে প্রয়োজনে ও আন্তরিক তাগিদে রবীন্দ্রনাথ কৈশোরকাল থেকেই এই জাতীয় সঙ্গীত রচনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

     সাধারণত ধ্রুপদ সঙ্গীতের চারটি তুক থাকে। সেগুলি যথাক্রমে - স্থায়ী,অন্তরা,সঞ্চারী এবং অভোগ। রবীন্দ্রনাথ এই তুকগুলিকে  মেনে গান লিখতে শুরু করলেন। এমনকি তিনি যখন কোনো লোকসঙ্গীত রচনা করেছেন,তখনো এই কাঠামোকে অস্বীকার করেননি। ধ্রুপদ গানের একটি প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হলো,এ গান সাধারণত গুরুগম্ভীর ও উপাষনামূলক। রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের অনেক গানে এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়। সামগ্রিক দৃষ্টিতে বলা যেতে পারে যে,তিনি ধ্রুপদ গানের দ্বারা মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত খেয়াল আঙ্গিকের কোনো গান রচনা করেননি। এমনকি ঠুংরি টাইপের গান আরো কম রচনা করেন,যদিও তিনি প্রচুর টপ্পা গান লিখেছিলেন।

                                  (দুই)

   রবীন্দ্রনাথের মেজদা বাড়িতে পিয়ানো বাজিয়ে পাশ্চাত্য সঙ্গীতচর্চা করতেন। রবীন্দ্রনাথ তখন আঠারো বছরের যুবক,বিলাতে গেলেন লেখাপড়া শিখতে। স্বাভাবিক ভাবেই এই পর্বে পাশ্চাত্যের সাঙ্গীতিক আবহাওয়া তাঁকে আচ্ছন্ন করে। ইতিমধ্যে; লন্ডনে জন স্কটের যে বড়িতে তিনি থাকতেন,সেখানেও তিনি গান সেখার সুযোগ পান। স্কট পরিবারের ছোট মেয়ে লুসি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বছর আটেকের বড়ো হলেও রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসতেন। কেউ কেউ মনে করেন, রবীন্দ্রনাথও বোধহয় লুসিকে ভালোবাসতেন।(ওগো বিদেশিনী,তুমি থাকো../গান) লুসির সঙ্গে তাঁর একটা চুক্তি হয়,তিনি লুসিকে বাংলা শেখাবেন,আর লুসি তাঁকে শেখাবেন পাশ্চাত্য সঙ্গীত। বলাবাহুল্য; নবযৌবনের নবকলেবরে রবীন্দ্রনাথের গীতিময় আত্মা পাশ্চাত্যের সঙ্গীত তরঙ্গকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল।
    বিলেতফেরত রবীন্দ্রনাথ ফিরে আসার কয়েকমাসের মধ্যেই লিখলেন 'বাল্মীকি প্রতিভা'। এই গীতিনাট্যে বিলিতি সুরে কমপক্ষে তিনটি গান আছে। পাশ্চাত্যের অপেরার আদর্শে এই নাটকে গীতিময়তা এসেছে। এছাড়াও তাঁর অন্যান্য গীতিনাট্যে গানের ব‍্যবহার,নিতান্তই সঙ্গীতপ্রীতিরই দ্যোতক। গান সাধারণত দুপ্রকার- কথাপ্রধান ও সুরপ্রধান। রবীন্দ্রনাথ সামান্য পরিমানে সুরপ্রধান গান রচনা করলেও,বিলিতি আদর্শে কথাপ্রধান গান রচনা করেছেন বেশি।

                                  (তিন)

      রবীন্দ্রনাথ বাঙালির আত্মার আত্মীয়। কেননা, তিনি বিলাত থেকে ফেরার এক দশকের মধ্যেই পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর বাঙালি সমাজের সঙ্গে পরিচিত হন। এই পরিচয়ের নিগূঢ় পরিচয় পাই তাঁর কবিতা, ছোটগল্প আর গানে(২)। পূর্ববঙ্গের মেঠোপথ,নদীপাহাড়,প্রকৃতি ও মানুষজন রবীন্দ্রনাথের গানের বিষয় হয়ে উঠেছিল এই পর্বে। 'প্রবাসী' পত্রিকা থেকে জানা যায়,তিনি লালন ফকিরের অনেক বাউল গান সংগ্রহ করে ছাপিয়েছিলেন। বাউল সুর যে সঙ্গীতশাস্ত্রের জ্ঞানবর্জিত সাধারণ মানুষের অন্তরের সুর,তা তিনিই প্রথম উপলব্ধি করেছেন। বাউল গান সাংসারিক বন্ধন মুক্তির আধ‍্যাত্মিক গান।শিলাইদহে যাবার প্রায় পনেরো বছর পরে রবীন্দ্রনাথ বাউলগান লিখতে শুরু করেন।
      বাউলদের মরমী,হৃদয়ভেদী ও আবেগপ্রবণ সুর রবীন্দ্রনাথের আস্তিক‍্যবাদী চিত্তকে উদ্বেলিত করেছিল। তাই তিনি রাগরাগিণী,তাল-লয়ের ধ্বজা ভেঙে দিয়ে আন্তরিক আকুতিকেই বড়ো করে দেখলেন বাউল গানগুলিতে।

                                 (চার)

      সময়টা ১৯০৫ সাল। চারিদিকে বঙ্গভঙ্গের কলরব কলতান চলছিল। এই সময়পর্বে রবীন্দ্রনাথ বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গান রচনা করেন। এই ধরনের গানগুলির প্রধানত দুটি সুর। প্রথম পর্যায়ের গানগুলি তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাঠামো মেনে রচনা করেন('তোমারি তরে মা সঁপিনু দেহ'/গান)। আর পরবর্তীতে বঙ্গভঙ্গের আবহকে করুণ করে তুলতে তিনি বেছে নিয়েছেন, বাউল সুরকে। শুধুমাত্র দেশাত্মবোধক গানই নয়,প্রেম ও প্রার্থনা বিষয়ক গানেও ব‍্যাপকভাবে মিশে গিয়েছে বাউল গানের সুর। বাউলগান ছাড়া অন্য কোনো লোকগীতি তাঁকে তেমনটা প্রভাবিত করতে পারেনি বলেই হয়তো শশিভূষণ দাশগুপ্ত রবীন্দ্রনাথকে 'বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বাউল' বলে সম্মানিত করেছেন।
  এছাড়াও কীর্তনের সুর তাঁর গানকে ব‍্যাপকভাবে নাড়া দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে, 'রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব এই যে,তিনি বাংলা গানকে সত্যিকার বাংলা গানে পরিণত করেছিলেন।'(৩)অর্থাৎ কীর্তন এবং বাউল যেমন বাংলার নিজস্ব সঙ্গীত, তিনিও তেমনি নতুন ধারায় বাংলা গানের প্রবর্তন করলেন।যে গানের ভাষাই শুধু বাংলা নয়; সুর,কথা,আবেগ,অনুভূতি সবদিক থেকেই তা বাঙালি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

   গীতাঞ্জলি-র যুগভূমিতে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথ সারা বিশ্বের প্রত্যেকটি মানুষকে নিজের বাহুডোরে আলিঙ্গন করার উদ্যেশ্যে আহ্বান করলেন। এই পর্যায়ের গানগুলি তাই আধ‍্যাত্মিকতা ও ঈশ্বর চিন্তায় নিমজ্জিত। এই গানগুলি রবীন্দ্রনাথের পূজা পর্যায়ের গানগুলির নামান্তর। অনেকেই বলেন যে,রবীন্দ্রনাথের হাতে কথা এবং সুর মিশে এক অপূর্ব বস্তুর সৃষ্টি হয়েছে। দৃষ্টান্ত:(সত্য মঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।,গীতবিতান,অখণ্ড:পূজা ৪৫২)
 তবে তাঁর শেষ জীবনের গানগুলিতে আপাতদৃষ্টিতে যতটা জায়গা জুড়ে কথা আছে,সুর কিন্তু ততটা গুরুত্ব লাভ করেছে বলে মনে হয় না।
  * 'একলা বসে হেরো তোমার ছবি..'
  * 'মনে কি দ্বিধা রেখে গেলে চলি ..'
  * 'মন মোর মেঘের সঙ্গী....'
  প্রভৃতি গানগুলি কথাপ্রধান,সুর এখানে আরোপিত। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত জীবনের প্রায় সার্ধশতবর্ষ পরে,বর্তমানেও বাংলা গান চারটা তুকে বিভক্ত এবং কথাপ্রধান। এখানেই তো তাঁর সঙ্গীতচর্চার চরম সার্থকতা!

                                (পাঁচ)

   তৎকালীন শিক্ষিত সমাজে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট সঙ্গীতগুলি বিশেষ প্রাধান্য লাভ করেছিল। কেননা,রবীন্দ্রসঙ্গীতে আমরা আমাদের সত্তাকে খুঁজে পাই এবং আমরা আমাদের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। এছাড়াও তাঁর গানের কথাগুলি আমাদের চেতন ও অবচেতন মনকে এক অকৃত্রিম অনুভূতির ভাবজগতে দোলায়িত করে তোলে। সহজ-সরল ভাব ও ভাষার বুঁনতে রচিত তাঁর গানগুলি। তিনি শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের কঠোর অনুশাসনের শৃঙ্খল ভেঙে সঙ্গীতকে চিরমুক্তি দিয়েছেন বাংলা গানের নীলাকাশে। রবীন্দ্রনাথ নিজেই সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন, কিন্তু তাঁর গলার স্বর ভারী ছিল না। বিশ শতকের গোড়ার প্রথম এক দশকে গ্রামফোন রেকর্ডে তাঁর চেয়ে বেশি গান আর কেউ গাননি। তিনি ছাড়া সেই সময়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের উৎকৃষ্ট গায়ক ছিলেন দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শান্তিদেব ঘোষ। এঁদের প্রত্যেকের কণ্ঠ ছিল হাল্কা ও চড়া। প্রথম ভারী গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করেন,পঙ্কজ কুমার মল্লিক। তারপর হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং দেবব্রত বিশ্বাস। এঁরা প্রত্যেকেই বিশ শতকের তিনের দশকের জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতকার। বস্তুত, এই ত্রয়ী সঙ্গীতকার তাঁদের ভারী গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের বহমান ঐতিহ্য ও আদর্শকে পর্ব থেকে পর্বান্তরে পৌঁছে দিয়েছেন। তবে শেষ করছি শুধু একটি কথা বলে যে, রবীন্দ্রনাথ বাংলা গানের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট গীতিকার এবং কারো কারো মতে সুরকারও। আধুনিক বাংলা সহ অন্যান্য অনেক প্রাদেশিক সঙ্গীত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের কাছে তাই চিরকাল বিশেষভাবেই ঋণী হয়ে থাকবে।।
(সংক্ষেপিত)

 #_তথ্যসূত্র: 
   (১) মুরসিদ;গোলাম, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি,অবসর প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা,পৃ.৩৩১.

   (২) মুরসিদ; গোলাম, রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, প্রকাশনী পূর্বল্লেখ,সূত্র কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বক্তৃতামালা।

   (৩) মুরসিদ; গোলাম, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, অবসর প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা,পৃ.৩৩৫.

#_সহায়ক_গ্রন্থাবলী:
  (১) সঙ্গীত জিজ্ঞাসা: শ্রী রামপ্রসাদ রায় (Theory and practical)
  (২) স্বরবিতান : (বিভিন্ন খণ্ড)
  (৩) হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি: গোলাম মুরসিদ
  (৪) রবীন্দ্রবিশ্বে পূর্ববঙ্গ ও পূর্ববঙ্গে রবীন্দ্রনাথ: গোলাম মুরসিদ।
  (৫) রবীন্দ্রনাথ সংগৃহীত লালনের গানের পাণ্ডুলিপি: আবুল আহসান চৌধুরী।

♦আলোচক: ধনঞ্জয় চক্রবর্তী♦

 ♦অ্যাডমিন--সাকসেস বাংলা♦

Share this