কীর্তন- বাঙালীর প্রাণ বাংলার গান।।


             💐কীর্তনের মধুর সুরে💐

বাংলা গানের একটি বিশিষ্ট ধারা কীর্তন । সংস্কৃত কীর্তন [কীর্ত্তি (বর্ণনা করা) +অন (ল্যুট), ভাববাচ্য] শব্দের একাধিক অর্থের ভিতরে বিশেষ কয়েকটি অর্থ হলো- গুণকথন, গুণগানকরণ, স্তবন। এই অর্থের সাথে বাংলা গানের কীর্তন-এর ভাবের সবিশেষ মিল খুঁজে পাওয়া যায়। কীর্তন-এর এই ভাব যেকোনো বিষয়ের গুণকীর্তন নয়। মূলত এর সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে হিন্দু পৌরাণিক দেবতা বিষ্ণু, বিষ্ণুর দ্বাপর যুগের প্রথম অবতার এবং দশম অবতারের অষ্টম অবতার হিসাবে নির্দেশিত শ্রীকৃষ্ণ এবং রাধার সাথে সম্পর্কিত বিষয়াবলী। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি মতে- কংস নামক এক অত্যাচারী রাজার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলে, ব্রহ্মা সকল দেবতাদের নিয়ে সমুদ্রের ধারে বসে বিষ্ণুর আরাধনা শুরু করেন। বিষ্ণু সে আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সাদা ও কালো রঙের দুটি চুল দিয়ে বললেন যে,
তিনি বসুদেবের ঔরসে দেবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন। কৃষ্ণের প্রতীক হলো কালো চুল। তাঁর সহযোগী হলেন বলরাম, তাঁর প্রতীক হলো সাদা চুল। এই সূত্রে
বসুদেবের ঔরসে দেবকীর অষ্টম গর্ভে কৃষ্ণের জন্ম হয়েছিল। পক্ষান্তরে রাধাকে কৃষ্ণের প্রণয়িনী হিসাবে দেখা হয়। পদ্মপুরাণ ও ভাগবতের মতে, গোলকধামে কৃষ্ণের বামপাশ থেকে রাধার উৎপত্তি হয়েছিল। জন্মের পর পরই ইনি কৃষ্ণের আরাধনা শুরু করেন। ইনি উৎপত্তিকালে ১৬ বৎসরের নব-যৌবনারূপে কৃষ্ণের সিংহাসনের বামপাশে অবস্থান নেন। এই সময় রাধার লোমকূপ হতে লক্ষকোটি গোপিকা ও কৃষ্ণের লোমকূপ থেকে লক্ষকোটি গোপের জন্ম হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে- একবার বিষ্ণু রম্যবনে প্রবেশ করে রমণ ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ফলে কৃষ্ণের ডান অংশ থেকে কৃষ্ণমূর্তি ও বাম অংশ থেকে রাধা মূর্তি প্রকাশ পায়। রাধা কৃষ্ণকে কামাতুর দেখে তাঁর দিকে অগ্রসর হন। রা অর্থ লাভ এবং ধা অর্থ ধাবমান। ইনি অগ্রসর হয়ে কৃষ্ণকে লাভ করেছিলেন বলে- এঁর নাম হয়েছিল রাধা।

ভাবের বিচারে কীর্তন গান হলো- সুর-তাল সহযোগে কৃষ্ণের মধ্য দিয়ে বিষ্ণুর দশম অবতারের গুণকথন বা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলার ভিতর দিয়ে ঈশ্বর লীলা অনুধাবনের চেষ্টা। সঙ্গীতের এই বিশেষ ধারার আদি উৎস হিসাবে ধরা হয়, সংস্কৃত ভাষার কবি জয়দেবের রচিত গীতগোবিন্দম্ । এই আখ্যানকাব্যে যে পদগুলো পাওয়া যায়, সেগুলোর সাথে রাগ-তালের নাম পাওয়া যায়। তবে খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ রচিত এই গ্রন্থের পদগুলোর গীতরীতি কেমন ছিল, তা জানা যায় না। এরপর একই ধারায় কীর্তনের সূচনা ঘটেছিল খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতকে বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মাধ্যমে। এর ভাষাকে মধ্যযুগীয় বাংলা হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। এই গ্রন্থটি অনেকাংশই গীতগোবিন্দম্ দ্বারা প্রভাবিত। এরপর বা এর কাছাকাছি সময়ে বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস প্রমূখ পদকর্তারা রাধাকৃষ্ণের পার্থিব লীলাকে উপজীব্য করে পদ রচনা করেছিলেন। কিন্তু এই পদগুলো
গীতগোবিন্দম্ বা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর মতো কোনো অখণ্ড আখ্যান-কাব্য হিসাবে গ্রথিত হয় নি। এ সকল পদের সুর হারিয়ে গেছে।
বড়ুচণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন -এর সূত্রে বঙ্গদেশের পরবর্তী বৈষ্ণব কবিরা সৃষ্টি করেছিলেন রাধাকৃষ্ণের লীলাভিত্তিক এক ধরনের গান। কালক্রমে এই গানের সাধারণ নাম হয়ে ছিল কীর্তন। এই গানের চর্চা বৈষ্ণবদের অদ্বৈতাচার্য , যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিতদের প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব গোষ্ঠীর ভিতরে প্রচলিত ছিল। সে সময় বৈষ্ণবগোষ্ঠী ক্ষুদ্রাকার একটি গোষ্ঠী হিসেবে নদীয়ায় প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এঁরা মূলত রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক কীর্তন গান করতেন। ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
শ্রীচৈতন্ য বৈষ্ণবগোষ্ঠীর অন্যতম সদ্স্য হিসেবে যোগদান করেন। পরে তিনি এই গোষ্ঠীর নেতৃত্ব দেন। গীতগোবিন্দম্
কীর্তনের মধ্য দিয়ে যে লীলাকীর্তনের ধারা ক্রমে ক্রমে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছিল।
শ্রীচৈতন্ য বিষ্ণু বা কৃষ্ণের আরাধনার সহজতর উপায় হিসাবে, সুর ও ছন্দে এঁদের নাম ক্রমাগত উচ্চারণের রীতি প্রচলন করেন। এই ধারায় নাম হিসাবে বেছে নেওয়া হলো- হরে (বিষ্ণুর অপর নাম) এবং কৃষ্ণ। এই দুইটি শব্দ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুর-সহযোগে আবৃত্তি করার মধ্য এই কীর্তন ধারাটি প্রচলিত হয়েছিল। মূলত শ্রীচৈতন্ য সেকালের কীর্তনের আদলে হরে-কৃষ্ণ মন্ত্রটিকে জপমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। এই সময় বৈষ্ণবগোষ্ঠীদের কীর্তনের নাম হয় 'লীলাকীর্তন'। পক্ষান্তরে শ্রীচৈতন্য প্রবর্তিত নবতর কীর্তনের নাম দেওয়া হয়েছিল নামকীর্তন। চৈতন্যদেবের সময় নামকীর্তনের ধাক্কায় নদীয়ায় লীলাকীর্তন অনেকাংশই ম্লান হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে নাম-কীর্তনের পাশাপাশি লীলা-কীর্তনের চর্চা অব্যাহত ছিল। আঞ্চলিকতার প্রভাবে ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লীলা-কীর্তন আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। তবে এর সবচেয়ে চর্চা হয়েছে − উত্তরবঙ্গ, বীরভূম, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা সংলগ্ন বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলসহ মেদিনীপুর, নদীয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। আঞ্চলিকতার প্রভাবে এবং বিভিন্ন কীর্তনীয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে শিষ্য পরম্পরায় এই ধারাগুলো পরিপুষ্ট হয়েছিল।
মঙ্গলকাব্যের কবিরা চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, মনসামঙ্গল, শীতলামঙ্গলের মাধ্যমে কীর্তনের রস পরিবেশন করতেন বটে, তাতে মূলকীর্তনের ধারা থেকে কিছুটা বিচ্যুত ছিল। মধ্যযুগের শেষে এসে বাংলা গান কীর্তন দ্বারা দুই ভাবে সমৃদ্ধ লাভ করেছে। এর একটি ধারায় মূল কীর্তনীয়ার কীর্তনের আদর্শ ধরে রেখে নতুন নতুন কীর্তন সৃষ্টি করেছেন। অন্য ধারায়, কীর্তনের সুরশৈলী অনুসরণে অন্য ধরনের গান রচনা করেছেন। কীর্তনের আদলে সৃষ্ট গানকে বলা হয় কীর্তনাঙ্গের গান।
বর্তমানে  পুরীধাম ও বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলে প্রচলন সর্বাধিক। কীর্তিনীয়াদের মধ্যে প্রাচীনকালে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য, ব্রহ্ম হরিদাস, শ্রী মহাপ্রভু, শ্রীবাস পণ্ডিত সবিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিলেন। শ্রীপুরীধামে কীর্তনীয়াগনের মধ্যে স্বরূপ দামোদার, দামোদার পণ্ডিত, শ্রী গোবিন্দ ঘোষ, বল্লভ সেন, ছোট হরিদাস বিখ্যাত। বঙ্গের কীর্তনীয়াদের মধ্যে ময়নাডাল, শ্রী নিবাস আচার্য, সরোত্তম দাস ঠাকুর, শ্রী শ্যামানন্দ, রসিক দাস, গনেশ দাস, নন্দ কিশোর দাস, রাধাশ্যাম দাস, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, রাধারানী , রথীন ঘোষ, ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিদাস কর, ব্রজেন সেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
কীর্তনগানের অত্যাবশ্যকীয় যন্ত্র ছিল শ্রীখোল ও করতাল ব্যবহৃত হয়। ইংরেজ শাসনমালে ইউরোপীয় যন্ত্র হারমোনিয়ামের ব্যবহার শুরু হয়েছে বাংলা গানের মধ্যুগের শেষের দিকে।
কীর্তন গান পরিবেশনা কীর্তন বাংলা সঙ্গীতের অন্যতম আদি ধারা। সাধারণ লোকের পক্ষে অতি সহজে ঈশ্বর সাধনার একটি উপায় হিসেবে এর উদ্ভব। গানের মাধ্যমে ধর্মচর্চার এ ধারা প্রাচীনকাল থেকেই এদেশে চলে আসছে। সে ধারাবাহিকতায় বাংলার বৈষ্ণবধর্মজাত সঙ্গীতধারার বিকশিত রূপই কীর্তন। এতে সাধারণত ঈশ্বরের গুণ ও লীলা বর্ণিত হয়।

💐💐কীর্তনের প্রকারভেদ:---💐💐

কীর্তন দুপ্রকার নামকীর্তন বা নামসংকীর্তন এবং লীলাকীর্তন বা রসকীর্তন। হরি বা বিষ্ণুকে সম্বোধন করে ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে\’ এ ষোল পদবিশিষ্ট কীর্তনই নামকীর্তন। অবশ্য নামকীর্তনের এ বোল ছাড়া আরও বোল আছে। সেগুলিও নামকীর্তন হিসেবেই প্রচলিত। আর রাধাকৃষ্ণ এবং গোপী-শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী অবলম্বনে যে পালাগান তা লীলাকীর্তন। পরবর্তীকালে গৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্যের কাহিনী অবলম্বনেও লীলাকীর্তনের প্রচলন হয়। কয়েকটি প্রধান লীলাকীর্তন হলো গোষ্ঠ, মান, মাথুর, নৌকাবিলাস, নিমাই সন্ন্যাস ইত্যাদি। এগুলি পদাবলি কীর্তন নামেও পরিচিত।
জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ কীর্তন গানের আদি উৎস। এতে বিভিন্ন রাগ ও তালের উল্লেখ আছে। এর পদগুলি যে সাঙ্গীতিক কাঠামোতে রচিত, পরবর্তীকালের কীর্তনের ধারায় তারই প্রভাব পড়েছে। বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকেই কীর্তন নামের এ সঙ্গীতধারার বিকাশ ঘটে। এ সময়ের কাছাকাছি মিথিলার কবি বিদ্যাপতিও ব্রজবুলিতে কীর্তনাঙ্গের বৈষ্ণবপদ রচনা করেন। পনেরো শতকে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে কীর্তন গানে অসামান্য বেগ সঞ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন নামকীর্তনের প্রচারক।
চৈতন্যদেব বুঝতে পেরেছিলেন যে, নারী-পুরুষ ও বয়স নির্বিশেষে সঙ্গীতের আবেদন সর্বাধিক এবং কোনো কঠিন বিষয়ের প্রতি অশিক্ষিত কিংবা স্বল্পশিক্ষিত জনগণকে আকৃষ্ট করার সহজতম উপায় হচ্ছে সঙ্গীত । তাই ঈশ্বর-সাধনার সহজতম পন্থা হিসেবে তিনি বেছে নেন কীর্তনকে। তিনি সকলকে জানান আর কোনো শাস্ত্র নয়, কেবল ‘হরে কৃষ্ণ...’ ইত্যাদি ষোল পদবিশিষ্ট কীর্তন করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে। ঈশ্বর-সাধনার এ সহজ পথের সন্ধান পেয়ে সাধারণ লোকেরা তাঁকে অনুসরণ করে কীর্তন গাইতে শুরু করে। ফলে কীর্তন একটি সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়। এভাবেই চৈতন্যদেব কীর্তনের মাধ্যমে তাঁর আদর্শ, অধ্যাত্মচিন্তা এবং তাঁর সাম্যের ধর্ম সারা বাংলায় প্রচার করেন। তিনিই নামকীর্তনের পরিপূর্ণ সাঙ্গীতিক রূপ দান করেন এবং এ গানকে অধ্যাত্মমার্গে উন্নীত করে বাঙালির কাছে জনপ্রিয় করে তোলেন।
চৈতন্যোত্তর যুগে লীলাকীর্তন পাঁচটি ধারায় বিকশিত হয়: গড়ানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটি, মন্দারিণী ও ঝাড়খন্ডী। ধারাগুলি ঘরানা নামেও পরিচিত। উৎপত্তিস্থানের নামানুসারে এসব ধারার নামকরণ করা হয়। ষোল শতকে
রাজশাহী জেলার অন্তর্গত গড়ানহাটি পরগনার পদকর্তা নরোত্তম দাস কর্তৃক গড়ানহাটি ধারা প্রবর্তিত হয়। তিনি প্রথমে গৌরচন্দ্রিকা গেয়ে পরে কীর্তন গাওয়ার রীতি প্রবর্তন করেন। নরোত্তম দাস ধ্রুপদ সঙ্গীতে ব্যুৎপন্ন ছিলেন বলে তাঁর প্রবর্তিত গড়ানহাটি ধারাটি ছিল ধ্রুপদাঙ্গের কীর্তন। বীরভূমের মনোহরশাহী ধারার প্রবর্তক জ্ঞানদাস মনোহর। এতে খেয়াল গানের প্রভাব আছে। বর্ধমানের রেনেটি ধারার প্রবর্তক বিপ্রদাস ঘোষ। এতে টপ্পাঙ্গের প্রভাব আছে। মন্দারণ সরকার নামক জনৈক কীর্তনীয়া প্রবর্তিত ধারার নাম হয় মন্দারিণী এবং ঝাড়খন্ড অঞ্চলে উদ্ভূত ধারার নাম ঝাড়খন্ডী কীর্তন। মন্দারিণী ধারায় ঠুংরির প্রভাব লক্ষণীয়।
পরবর্তীকালে কলকাতায় টপ্পার প্রভাবে কীর্তনের এক নতুন ধারার সৃষ্টি হয়, যা ঢপকীর্তন নামে পরিচিত। নরোত্তম দাস কর্তৃক উদ্ভাবিত কীর্তনের এ ধারায় প্রথমে অনিবন্ধ গীতে আলাপ তথা স্বরালাপের মধ্য দিয়ে গানের শুরু হয়। আলাপের পর ধ্রুপদের গঠনভঙ্গি অনুযায়ী মূল গান অর্থাৎ নিবন্ধ গান গাওয়া হয়। নিবন্ধ গানের চারটি ধাতু উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ-এর গঠনরীতি অনুযায়ী পদাবলি কীর্তনের রূপ নির্মিত হয়েছে। বৈষ্ণব পন্ডিতদের মতে কীর্তনে ৬৪ প্রকার রসের উল্লেখ আছে। সাধারণত দাঁড়িয়ে অথবা নৃত্যসহযোগে কীর্তন পরিবেশিত হয়, তবে বৈঠকি স্বভাবে কীর্তন পরিবেশনেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। কীর্তনের গঠন-প্রকৃতিতে রয়েছে কথা, আখর, দোহা, ছুট ও তুক্। এতে আখরের প্রয়োগ খুবই মধুর ও আকর্ষণীয়। কীর্তনের একটি পদ গাওয়ার পর আখর দ্বারা সঙ্গীতের মূল কথাটি ভাব ও রসে ভরিয়ে তোলা হয়। কীর্তন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত ধারার গান। এর সুর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিশেষ করে হিন্দুস্থানি সুরের প্রভাব থেকে মুক্ত এবং উদার ভক্তিভাবরসেপূর্ণ।
কীর্তন রাগসঙ্গীত ধারার গান হলেও এতে রাগের ব্যবহার অনেকটা শিথিল, কারণ কীর্তন তার মূল ভাব, রূপ ও রসের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হিন্দুস্থানি রাগ-রাগিণীর কঠিন বিধি-নিষেধ থেকে সব সময় ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছে। তবে কীর্তন গানের একটি বিষয় লক্ষণীয় হলো যে, তা সাধারণত সম্পূর্ণ জাতিতে অর্থাৎ সাত স্বরে গীত হয়ে থাকে। ষাড়ব এবং ঔড়ব জাতির গান তুলনামূলকভাবে কম। কীর্তনে তোড়ী, কামোদ, শ্রীরাগ, পাহাড়ী, পটমঞ্জরী প্রভৃতি রাগ-রাগিণীর ব্যবহার ছাড়াও প্রাচীন রাগ-রাগিণীর পরিচয়ও পাওয়া যায়।
কীর্তন গানে ভারতীয় প্রাচীন তালের বৈচিত্র্য লক্ষণীয়। দ্রুত, মধ্য ও বিলম্বিত এ তিন লয়েই তাল বাজানো হয়। এর তাল বিভিন্ন ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রদর্শিত হয়, যেমন তাল, ফাঁক, কাল, কোশী বা কুশী ও অর্ধতালী। কীর্তনে বিভিন্ন প্রকার তাল ব্যবহূত হয়, যেমন ছোট লোফা, বড় লোফা, রূপক, যতি, তেওট, দোঠুকী, মধ্যম দশকোশী, বড় দশকোশী, দাশপেড়ে, শশীশেখর, বীর বিক্রম ইত্যাদি। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে এ গানে আনদ্ধ ও ঘন বিশেষত শ্রীখোল এবং করতালের ব্যবহারই সমধিক।
ইংরেজ কর্তৃক কলকাতা শহরের পত্তনের পূর্ব পর্যন্ত কীর্তন গ্রামবাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে ছিল। অর্থনৈতিক কারণে গ্রামছাড়া মানুষ যখন কলকাতায় ভিড় জমাতে থাকে তখন তাদের সঙ্গে কীর্তন, পাঁচালি ইত্যাদি সঙ্গীতধারা কলকাতার নগরসমাজে প্রবেশ করে। ওই সময় কলকাতায় ঢপকীর্তন বেশ জনপ্রিয় ছিল। তবে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় সমগ্র বাংলাদেশেই হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কীর্তনের শ্রোতৃজগৎ ছিল বিস্তৃত। পাকিস্তান আমলেও এদেশে গ্রামে গ্রামে কীর্তন গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল। বর্তমানে এর প্রচলন সংকীর্ণ হলেও শ্রোতা আছে। আধুনিক বাংলা গানে অনেক সময় কীর্তনের মৌলিক সুর ও ভাব সংযোজনের প্রবণতাও দেখা যায়।

কীর্তনের সাধারণ শ্রেণি বিভাজন: বিষয় ও বাণীর বিচারে কীর্তনকে মোট দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগ দুটি হল- নামকীর্তন ও লীলা কীর্তন।
নামকীর্তন : শুধু হর ও কৃষ্ণ শব্দের ক্রমাগত উচ্চারণ যখন সুর ও ছন্দে প্রকাশ করা হয়, তখন তাকে নামকীর্তন বলা হয়। অবশ্য কখনো কখনো হরে ও কৃষ্ণ উচ্চারণের পাশাপাশি বিষ্ণুর অন্যান্য অবতারদের বা কৃষ্ণের অন্যান্য নাম বা রাধা নামও উচ্চারণ করা হয়। যেমন- রাধে গোবিন্দ, হরে হরে, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে, রাম রাম হরে হরে ইত্যাদি। এই কীর্তনে মন্দিরা প্রধান বাদ্য-উপকরণ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। কখনো কখনো এর সাথে শ্রীখোলও ব্যবহার করা হয়। এই কীর্তন একা বা একাধিক গায়ক বসে বসে বা ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় পরিবশেন করে থাকেন। চৈতন্যদেবের সময় থেকে কীর্তনের এই ধারাটি চালু হয়েছে।

লীলা-কীর্তন: এর অন্য নাম পদকীর্তন বা পদাবলী কীর্তন। এই কীর্তনে বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ এবং শ্রীরাধার পার্থিব প্রেম-লীলার ভিতর দিয়ে আধ্যাত্মিক দর্শন অনুধাবনের চেষ্টা করা হয়। গ্রন্থনার বিচারে লীলা কীর্তনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। ভাগ দুটো হলো- আখ্যান-কীর্তন ও ছুট কীর্তন। রাধা-কৃষ্ণের লীলাকে একটি পূর্ণাঙ্গ আখ্যান-গীতি হিসাবে উপস্থাপনই হলো আখ্যানকীর্তন। অনেকে মনে করেন যে, 'আখ্যান কীর্তন' হলো- আদি কীর্তন। কারণ গীতগোবিন্দম্' -এর সূত্রে এই কীর্তনের সূচনা হয়েছিল। পক্ষান্তরে একটি স্বতন্ত্রভাবকে প্রকাশ করার জন্য পৃথকভাবে যে কীর্তন রচনা করা হয়, তাকে 'ছুট কীর্তন'। এই কীর্তন কোনো আখ্যান-এর অংশ হিসাবে পরিচিতি লাভ করে না। কিন্তু এই জাতীয় কীর্তন যে কোন আখ্যান-কীর্তনের অংশ হিসাবে চালিয়ে দেওয়া দেওয়া যেতে পারে।
লীলা-কীর্তনে একজন মূল গায়েন এবং তোঁহার মিলে শ্রীকৃষ্ণলীলাকে প্রকাশ করেন। এই কীর্তনে নন্দ, যশোমতী, শ্রীকৃষ্ণ, রাধা, ললিতা ইত্যাদি চরিত্রগুলো চরিত্র হিসেবে উপস্থিত থাকেন না। গায়েনের গানের ভিতর দিয়ে এদের কাহিনি, কথোপকথন প্রকাশ করা হয়।
লীলা কীর্তনের ধারা : গীতগোবিন্দম্ -এর সূত্রে লীলাকীর্তনের যে ধারার সূচনা হয়েছিল, চৈতন্যদেবের সময় নামকীর্তনের ধাক্কায় তার অনেকাংশই ম্লান হয়ে গিয়েছিল নদীয়া অঞ্চলে কমে গিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলে নাম-কীর্তনের পাশাপাশি লীলা-কীর্তনের চর্চা অব্যাহত ছিল। আঞ্চলিকতার প্রভাবে ক্রমে ক্রমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে লীলা-কীর্তন আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিকশিত হয়ে উঠেছিল। তবে এর সবচেয়ে চর্চা হয়েছে- উত্তরবঙ্গ, বীরভূম, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা সংলগ্ন বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলসহ মেদিনীপুর, নদীয়া এবং তৎসংলগ্ন অঞ্চলে। আঞ্চলিকতার প্রভাবে এবং বিভিন্ন কীর্তনীয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন ধারার সৃষ্টি হয়েছিল। পরে শিষ্য পরম্পরায় এই ধারাগুলো পরিপুষ্ট হয়েছিল। নিতান্তই ছোটো খাটো ধারাগুলো কালক্রমে হারিয়ে গেলেও কিছু ধারা এখনও অল্প-বিস্তর চর্চিত হয়ে থাকে। এর ভিতরে উল্লেখযোগ্য ধারাগুলো হলো- গড়ানহাটি, মনোহরশাহী, রেনেটি, মন্দারিণী, ঝাড়খণ্ডী এবং ঢপ্।

গড়ানহাটি ধারা : খ্রিষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে রাজশাহী জেলার গড়েরহাট বা গড়েনহাটি পরগণার পদকর্তা নরোত্তম দাস এই বিশেষ ধরনের কীর্তনের ধারা প্রবর্তন করেন। এই ধারায় মূল লীলা-কীর্তনের পূর্বে 'গৌরচন্দ্রিকা' নামক প্রারম্ভিক গান গাওয়ার রীতি প্রচলন করেন। নরোত্তম দাস ধ্রুপদ গানের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত ছিলেন। এই কারণে তাঁর গানে ধ্রুপদের প্রভাবটা বেশি ছিল। এই ধারার কীর্তনে ধ্রুপদের মতো প্রথমে স্বরালাপ করা হয়ে থাকে। এই আলাপ শেষে নিবদ্ধ গান পরিবেশন করা হয়। ধ্রুপদের মতো এই কীর্তনে চারটি তুক রয়েছে। এগুলোকে বলা হয়- উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ।
মনোহরশাহী : চৈতন্যদের সমসাময়িক কালে বর্ধমান জেলার মনোহরশাহী পরগণার শ্রীখণ্ডে কীর্তনের একটি নতুন ধারার প্রবর্তন করেছিলেন জ্ঞানদাস মনোহর। এই ধারাটি 'মনোহরশাহী' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এই ধারাকে যেসব প্রখ্যাত কীর্তনীয়ারা সমৃদ্ধ করেছিলেন, এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন – নরহরি সরকার, রঘুনন্দন আচার্য, কবি লোচন দাস, বাসুদেব ঘোষ প্রমুখ। এই কীর্তনে খেয়ালের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তবে এর সাথে মিশ্রিত হয়েছিল আঞ্চলিক লোকধারার সুর।

রেনেটি : খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে বর্ধমান জেলার রাণীহাটি পরগণার কীর্তনের এই ধারটি বিকশিত হয়েছিল। এই অঞ্চলের বিপ্রদাস ঘোষ কীর্তনকে টপ্পার মতো করে পরিবেশন করার রীতি প্রচলন করেন। টপ্পা অঙ্গের গায়নরীতি যাঁরা পছন্দ করতেন, তাঁদের কাছে কীর্তনের এই ধারাটি বিশেষভাবে আদৃত ছিল। এই ধারাটি রাণীহাটী ধারা হিসাবে প্রথমদিকে প্রচলিত ছিল। পরবর্তী সময় এই নামটি লোকমুখে ধারাটি
'রেনেটি' নামে পরিচিতি লাভ করে।পরবর্তী সময়ে এই ধারাটিই কলকাতা অঞ্চলে আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল।

মন্দারিণী : উড়িষ্যা ও মেদিনীপুরের মন্দারণ অঞ্চলের চর্চিত কীর্তন ধারাটি 'মন্দারিণী' নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বংশীবদন নামক প্রখ্যাত কীর্তনীয়া এই ধারাটির প্রবর্তন করেন। এই গানে ঠুংরির প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ঝাড়খণ্ডী : শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্য গোকুলানন্দ ষোড়শ শতকের শেষে এই কীর্তন ধারার প্রবর্তন করেন। ঝাড়খণ্ডে এই কীর্তনের উদ্ভব হয়েছিল বলে ধারাটি

ঝাড়খণ্ডী নামে অভিহিত হয়ে থাকে।
ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের লোকায়ত সুরাশ্রয়ী ও বাণীশৈলী দ্বারা এই ধারা পুষ্ট হয়েছিল।
চৈতন্য চরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত গ্রন্থে এই কীর্তনের নাম পাওয়া যায়। কথিত আছে চৈতন্যদেব এই পথে বৃন্দাবনে গিয়েছিলেন। এই ধারায় ঝাড়খণ্ড-এর লোকগানের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। বর্তমানে এই ধারার কীর্তনের ব্যাপক চল নেই।

ঢপকীর্তন: খ্রিষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে ঢপ্কীর্তন নামে নতুন একটি ধারার সূচনা হয়। এই ধারার সূচনা হয়েছিল কলকাতায়। এই ধারার গুরু হিসাবে মান্য করা হয় রাধামোহন ঠাকুর-কে। নতুন ধারার এই কীর্তনে বৈঠকি-মেজাজে কোনো না কোনো রাগের আশ্রয়ে সুরবিন্যাস করা হতো। গানের মাঝে মাঝে কথকতার ভঙ্গিতে কিছু বাক্য ব্যবহার রীতিও ক্রমে ক্রমে এই কীর্তনের অংশে পরিণত হয়। যেমন- রাধা কহিতেছেন, কৃষ্ণ কহিলেন ইত্যাদি। এছাড়া এই কীর্তনে আঞ্চলিক পালাগানের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সেকালের কীর্তনীয়রা এই কীর্তনে বাউলের সুরভঙ্গিমা অত্যন্ত কুশলতার সাথে ব্যবহার করতেন। বৈঠকি আসরে ঢপকীর্তনে অনেক সময় খোলকর্তাল, মন্দিরা, হারমোনিয়াম সহযোগে রাগভিত্তিক সম্মিলিত বাদ্য পরিবেশন হতো। কথকতার নাট্যকীয়তা, বাদ্যযন্ত্রের অনুসঙ্গ, শিল্পীদের লীলায়িত নৃত্য ইত্যাদি মিলে ঢপ্কীর্তন গ্রাম বাংলায় যাত্রাগানের মতও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এক সময়। মধুসূদন কিন্নর বা মধুকান (১২২৫-১২৭৫ বঙ্গাব্দে) নামক যশোহর জেলার জনৈক কীর্তনীয় এই কীর্তনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। অনেকের ধারণা, ঢপ্কীর্তন নামটি মধুসূদন কানের দেওয়া। পরবর্তী সময়ে এই ধারাকে ঐতিহ্যগত একটি ধারায় পরিণত করেন রূপচাঁদ পক্ষী, লোচন দাস, দ্বারিক দাস, শ্রীরাম দাস, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, দাশরথী রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, পান্নাবাই, পটলবাই, ছাপান্ন ছুরী কমল ঝরিয়া, ললিতা বৈষ্ণবী প্রমুখেরা। ঢপ্কীর্তনে ব্যবহৃত হত লোফা, ঝাঁপ, চঞ্চুপুট, আদ্ধা প্রভৃতি তাল।
কালীকীর্তন: কীর্তনের সুরশৈলীতে কীলী দেবীর বন্দনা করা হয়, একেই কালীকীর্তন বলা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এর অল্পবিস্তর প্রচলন আছে। কালী কীর্তন মূলত শাক্তপদাবলীর গীতিরূপ মাত্র। এতে শক্তির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর লীলা মাহাত্ম পায়। এই গানের জন্য দ্বিজরামপ্রসাদ, কমলাকান্ত, নীলকণ্ঠ বিশেষ খ্যতি লাভ করেছিল।
কীর্তনে কলঙ্কভঞ্জন
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর দিকে 'কলঙ্কভঞ্জন' নামে পালাকীর্তনে পৃথকভাবে একটি অধ্যায় ব্যবহৃত হতো। কৃষ্ণের সাথে প্রণয়, কলহ, মান-অভিমানের সূত্রে কলঙ্ক রটতে পারে, এই কলঙ্কমোচনের দায় গায়েন নিজেই গানে গানে মোচন করতেন। কখনো অতিরিক্ত কাহিনিও যুক্ত করতেন। কলঙ্কভঞ্জনের এই বিষয়টি অনেক সময় সেকালের কৃষ্ণবিষয়ক পালাগান বা কবি গানেও ব্যবহৃত হতো।

💐কীর্তনের রাগ ও রস : কীর্তণে রাগাশ্রয়ী রূপ থাকলেও রাগরূপটি প্রাধান্য পায় না। মূলত কীর্তনে রাগের ছায়া বা কাঠামো পাওয়া যায় মাত্র। ওই কাঠামোর উপর ভিত্তি করে কীর্তনের মূল ভাবকে প্রকাশ করা হয়। কিছু বিশেষ রাগের উপর কীর্তন গান নিবদ্ধ হতে দেখা যায়। এই রাগগুলো হলো- তোড়ি, কামোদ, শ্রীরাগ, পাহাড়ী, পটমঞ্জরী ইত্যাদি। কীর্তনে ভাবের কারণে বিভিন্ন ভাবে প্রায় সকল স্বরই ব্যবহৃত হয়। সেক্ষেত্রে অধিকাংশ রাগের বিচারে কীর্তনের সুর অশুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু রসের বিচারে তার মূল্য অনন্যসাধারণ। কীর্তনগুরুরা কীর্তনে ৬৪-রসের কথা বলে থাকেন। এই রস ফুটিয়ে তোলা হয়, সুরে নিবদ্ধ কথায় বা আখরে। কীর্তনের আসরে রস সৃষ্টির জন্য অনেক সময় দোহার-এর দল সঙ্গ দেয়।

💐 কীর্তনের তাল : কীর্তনে প্রকৃতিভেদে বিভিন্ন ধরনের তাল ব্যবহার করা হয়। এই সব তাল-বাদনে শ্রীখোলের ও মন্দিরা ব্যবহার করা হয়। কীর্তনের ভাব বা বিষয়ের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন তাল ব্যবহার করা হয়। যেমন- কাহারবা, দাদরা, একতাল, ছোট লোফা, বড় লোফা, রূপক, যৎ, তেওড়া, দোঠুকী, মধ্যম দশকোশী, দশকোশী, দাশপেড়ে, শশীশেখর, বীরবিক্রম ইত্যাদি।
কীর্তনের অঙ্গ : কীর্তন বিচিত্রভাবে শ্রোতাদের সামনে উপস্থাপিত করা হয়। উপস্থাপন বৈশিষ্ট্য হিসাবে কীর্তনের ভাবগুলোকে অঙ্গ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। কীর্তনগুরুরা কীর্তনের অঙ্গকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করেছেন। এই ভাগগুলো হলো-
১. কথা : কীর্তনের বাণীকে সাধারণভাবে কথা বলা হয়। কথা হলো লীলা-কীর্তনের ভিত্তি। এই কারণে কথা-কে অনেক সময় মূল কীর্তন বলা হয়।
২. দোঁহা : কীর্তনের এই অঙ্গে কীর্তনের বিষয়কে আবৃত্তি করা হয়। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনে বৈচিত্র্যতা প্রকাশ পায়। এবং দীর্ঘ সময় ধরে কীর্তন পরিবেশনের সময়, শ্রোতা একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পায়।
৩. আঁখর : কীর্তনের ভাবকে সহজভাবে সুর-তাল সহযোগে ব্যাখ্যা করার একটি প্রক্রিয়া। মূলত কীর্তনিয়া এই অঙ্গে তাঁর নিজের অভিমত ব্যাখ্যা সহযোগে জানিয়ে দেন। এর ভিতর দিয়ে কীর্তনীয়া তাঁর প্রতিভার প্রকাশ ঘটানোর সুযোগ লাভ করেন।
৪. তুক : কীর্তনের কাব্যগীতি অংশ হলো তুক। এই অঙ্গে অনুপ্রাসযুক্ত, ছন্দোময়, অন্ত্যমিলযুক্ত পদ পরিবেষণ করা হয়।
৫. ছুট : কীর্তনের কোনো পদকে সম্পূর্ণ পরিবেশন না করে, ছোটো ছোটো ছন্দে লীলায়িত ভঙ্গিতে উপস্থাপন করা হয়। এই অঙ্গটির মধ্য দিয়ে কীর্তনীয়ার ব্যক্তি পারঙ্গমতা বিশেষভাবে ফুটে ওঠে।
এছাড়া একটি ঐচ্ছিক অঙ্গ কোনো কোনো কীর্তনের আসরে ঝুমুর নামক একটি অঙ্গ পরিবেশন করা হয়। এক্ষেত্রে ঝুমুরের চটুল ছন্দে, নেচে নেচে কীর্তন পরিবেশন করা হয়। সাধারণত এই অঙ্গ পরিবেশনের মধ্য দিয়ে কীর্তন পালা শেষ করা হয়।


💐 তথ্যসূত্র :💐

কীর্তন গানের সুরে
 মাসিক পত্রিকা ---'প্রত্যয়', লেখা---অমিয়তোষ ঘোষ

সাহিত্যের ইতিহাস---তপন কুমার চট্টোপাধ্যায়

রবীন্দ্রনাথের কীর্তনাঙ্গের গান। স্মৃতি চট্টোপাধ্যায়।

♦আলোচনায় :--অমিয়তোষ ঘোষ♦
(বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা ভাষা সাহিত্য বিভাগ)

♦অ্যাডমিন-- success বাংলা♦

Share this