বাংলা সাহিত্যে অলংকার


বাংলা সাহিত্যে অলংকার

সাহিত্য স্রষ্টার যে রচনা কৌশল কাব্যের শব্দধ্বনিকে শ্রুতিমধুর এবং অর্থধ্বনিকে রসাপ্লুত ও হৃদয়গ্রাহী  করে তোলে তাকে বলে অলংকার।

বাণী বহিরঙ্গে শব্দময়ী ,  অন্তরঙ্গে অর্থময়ী। তাই অলংকার দুই প্রকার-- শব্দালংকার ও অর্থালংকার।

শব্দালংকার:- শব্দের বহিরঙ্গ ধ্বনির আশ্রয়ে যে কাব্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়  তাকে বলে শব্দালংকার।

 অর্থালংকার- শব্দের অন্তরঙ্গ  অর্থের আশ্রয়ে  যে কাব্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয় তাকে অর্থালংকার বলে।

শব্দালংকার তিন প্রকার। -- অনুপ্রাস, যমক ও  শ্লেষ। 

 অনুপ্রাস-- একই বর্ণগুচ্ছ যুক্তভাবেই হোক আর বিযুক্তভাবেই হোক  একাধিকবার আবৃত্ত হলে অনুপ্রাস অলংকার হয়। যেমন-- ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে।

অনুপ্রাস তিন প্রকারের হয়।-- আদ্যানুপ্রাস, মধ্যানুপ্রাস ও অন্ত্যানুপ্রাস।

আদ্যানুপ্রাস-- শব্দের আদি বর্ণের আবৃত্তিতে  আদ্যানুপ্রাস হয়। যেমন-- কেতকী-কেশরে কেশপাশ করো সুরভি।

মধ্যানুপ্রাস--  শব্দের মধ্যস্থিত বর্ণের আবৃত্তিতে মধ্যানুপ্রাস হয়।। যেমন--বাদ্যঘটা লক্ষ বলি অলক্ষে সব যায়  যে চলি।

অন্ত্যানুপ্রাস-- পদান্তের সাথে পদান্তের বা চরণান্তের সাথে চরণান্তের যে ছন্দমিল তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে। যেমন-- 
      এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
       গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা।

যমক-- দুই বা ততোধিক ব্যক্রন বর্ণ একই স্বরধ্বনিসহ  ভিন্ন ভিন্ন অর্থে দুই বা ততোধিকবার ব্যবহৃত হলে যমক অলংকার হয়। যেমন-- ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে।
আদ্য যমক--  গিরিশ -করে  গিরীশ করে কন্যা সম্প্রদান।
মধ্য যমক--কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।
অন্ত্য যমক--
      কান্তার আমোদপূর্ণ  কান্ত-সহকারে।
       কান্তার আমোদপূর্ণ  কান্ত-সহকারে।।

অন্ত্য যমক একাধারে যমক ও অনুপ্রাস দুইই। কিন্তু অন্ত্যানুপ্রাস অন্ত্য যমক না হতেও পারে।

শ্লেষ-- কোনো শব্দ একবারমাত্র ব্যবহৃত হয়ে একাধিক অর্থ প্রকাশ করলে শ্লেষ অলংকার হয়। যেমন-- এনেছে তোমার স্বামী বাঁধি নিজগুণে।

📚  অর্থালংকার 📚
অর্থালংকারের মধ্যে  উপমা , উৎপ্রেক্ষা , রূপক , ব্যতিরেক ও সমাসোক্তি প্রধান।

উপমা-- একই বাক্যে দুটি বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে তুলনা করে যে চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করা হয় তাকে উপমা অলংকার বলে। যেমন-- "ননীর মতো কোমল শয্যা পাতা " ----- এখানে শয্যা উপমেয়, ননী উপমান , কোমল উপমান , মতো সাদৃশ্যবাচক শব্দ। তাই এখানে উপমা অলংকার  হয়েছে।

লুপ্তোপমা----  যেখানে উপমেয় , উপমান , সাধারণধর্ম ও তুলনাবাচক শব্দ ------ এই চারটি অঙ্গের যেকোনো একটি বা একাধিক অঙ্গ যদি অনুল্লিখিত থাকে তবে সেখানে লুপ্তোপমা হয়। যেমন--- "তিলেক না দেখি ও চাঁদবদন মরমে মরিয়া থাকি" ।  এখানে বদন উপমেয়, চাঁদ উপমান , সাধারন ধর্ম ও সাদৃশ্যবাচক শব্দ এখানে লুপ্ত।

পূর্ণোপমা----- যে  উপমায় উপমেয়, উপমান, সাধারণধর্ম এবং সাদৃশ্যবাচক শব্দ এই চারটি অঙ্গই উল্লিখিত থাকে তাকে পূর্ণোপমা বলে।  যেমন--- "জ্যোৎস্না নামে মৃদুপদে ঝাঁপি লয়ে লক্ষ্মীর মতন"  ।  এখানে জ্যোৎস্না উপমেয়, লক্ষ্মী উপমান , নামে  সাধারণ ধর্ম , মতন সাদৃশ্যবাচক শব্দ। উপমার চারটি অঙ্গই এখানে উল্লিখিত থাকায় এটি পূর্ণোপমা অলংকার।

মালোপমা--- উপমেয় যেখানে মাত্র একটি এবং তার উপমা অনেক সেইখানে হয় মালোপমা।  যেমন--   মেহগনির মঞ্চ জুড়ি
              পঞ্চ হাজার  গ্রন্থ;
           সোনার জলে দাগ পড়ে না, 
          খোলে না কেউ পাতা
              আস্বাদিত মধু যেমন 
              যুথী অনাঘ্রাতা।

এখানে গ্রন্থ উপমেয়, উপমান মধু আর যুথী।

বস্তু-প্রতিবস্তুভাবের উপমা--- একই সাধারণ ধর্ম যদি উপমেয় আর উপমানে বিভিন্ন ভাষায় প্রকাশিত হয়, তাহলে সাধারণ ধর্মের এই ভিন্ন ভাষারূপ দুটিকে বলাহয় বস্তু প্রতিবস্তু। এই ভাবের উপমার তুলনা বাচক শব্দ ভাষায় প্রকাশ করতেই হবে। যেমন--
               
                    নিশাকালে যথা
                 মুদ্রিত কমলদলে থাকে গুপ্তভাবে
               সৌরভ, এ প্রেম, বঁধু, আছিল হৃদয়ে
                   অন্তরিত।
এখানে উপমেয় প্রেম, উপমান সৌরভ, সাধারণধর্ম  অন্তরিত গুপ্তভাবে বস্তুপ্রতিবস্তু। অন্তরিত, গুপ্তভাবে ভাষায় বিভিন্ন কিন্তু অর্থে এক--- গোপনে। তুলনাবাচক শব্দ ,যথা।

বিম্ব প্রতিবিম্বভাবের উপমা-- উপমেয়ের ধর্ম এবং উপমানের ধর্ম যদি সম্পূর্ণ বিভিন্ন হয় অথচ তাদের মধ্যে যদি একটা সূক্ষ্ম সাদৃশ্য বোঝা যায়, তাহলে ওই ধর্মদুটিকে বলা হয় বিম্বপ্রতিবিম্বভাবাপন্ন সাধারণ ধর্ম। বিম্বপ্রতিবিম্বভাবের উপমায় তুলনাবাচক শব্দ থাকতেই হবে। যেমন-- 

কানুর পিরীতি                   বলিতে বলিতে
              পাঁজর ফাটিয়া উঠে।
শঙ্খবণিকের                   করাত যেমতি
           আসিতে যাইতে কাটে।।

এই উদাহরণটিতে উপমেয়  কানুর পিরীতি , উপমান  শঙ্খবণিকের করাত, উপমেয়র ধর্ম বলিতে বলিতে পাঁজর ফাটিয়া উঠে  এবং  উপমানের ধর্ম  আসিতে যাইতে কাটে।   সব অবস্থাতেই দুঃখময়  এই তাৎপর্যে ধর্মদুটির সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে বলে এরা প্রতিবিম্ব ভাবের সাধারণ ধর্ম।

স্মরণোপমা---- কোনো পদার্থের অনুভব থেকে যদি তৎ সদৃশ অপর বস্তুর স্মৃতি মনে জেগে ওঠে তবেই স্মরণোপমা অলংকার হয়।  যেমন--- 

     শুধু যখন আশ্বিনেতে
       ভোরে শিউলিবনে
          শিশিরভেজা হাওয়া বেয়ে
              ফুলের গন্ধ আসে
                  তখন কেন মায়ের কথা
                      আমার মনে ভাসে?

আলোচক- গার্গী চ্যাটার্জি
অ্যাডমিন, Success বাংলা।

Share this