ইতিহাস ; সাহিত্যের শাখায় শাখায়।


বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস:
          কোনও মানুষই সমাজ নিরপেক্ষ নয়। সমাজ চলে সময়ের হাত ধরে। সময়ের প্রয়োজনে সাহিত্য সৃষ্টি। চৈতন্যদেব যেমন সময়ের সৃষ্টি , তেমনি চৈতন্য জীবনী সাহিত্যও। সাহিত্য জীবনের জলছবি। আর সময় জীবনের ধারক। তাই এক অর্থে সময় সাহিত্য, ইতিহাস সাহিত্য। বা সাহিত্য ইতিহাসকে বহন করে চলে। সে ইতিহাস বর্গীর হাঙ্গামা হতে পারে , বনোয়ারী -করালি দ্বন্দ্ব হতে পারে ; আবার বনলতা সেনও হতে পারে। নিজেকে নিয়ে বলার তেমন কিছুই নেই.

ইতিহাস ; সাহিত্যের শাখায় শাখায় :
          বর্তমানের গর্ভে অতীতের জন্ম। জয় গোস্বামী বর্তমান ; লুই পাদও বর্তমান ছিলেন .. এখন অতীত। অতীত হয়ে যাবেন জয় গোস্বামী , শ্রীজাতরা।
চর্যায় সমাজ রয়েছে। সমাজ রয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনেও। রাধা বিরহ , ধুলোময় মাটিতে পা রেখে পারিজাত ছিঁড়ে আনার প্রয়াস ..বা হাসনাবাদ , বসিরহাট , বর্ধমানে  নদীর তীরে বসে বাঁশির স্বর্গীয় সুর শোনার চেষ্টা।
তুর্কি আক্রমণের পর অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে এক সময় অনুবাদ সাহিত্য অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। ভয় এবং রোগ ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে লৌকিক দেব দেবীর সৃষ্টি হয়েছিল। কে কবে মনসার কাছে বিদ্যা বুদ্ধি ধন দৌলত চেয়ছে ? কলেরা বা ওলউঠা থেকে মুক্তি পেতে ওলাইচন্ডীর পূজো নদীয়া ২৪ পরগণায় আজও হয়। মায়ের দয়া " (pox) হলে শীতলতার প্রয়োজন থেকে শীতলা'র উদ্ভব। ধর্ম ঠাকুর বৃষ্টি এবং বন্ধ্যাদের সন্তান দান করেন বলে বিশ্বাস।
চৈতন্যোত্তর পদকর্তারা চৈতন্য আদর্শ এবং গৌড়ীয় দর্শন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু বিদ্যাপতি চন্ডীদাসের পদ মানবীয় রসে পূর্ণ। এঁরা দুজন ব্যক্তিগত আবেগ অনুভব রাধার মুখে বসিয়ে চালিয়েছেন বললে অত্যুক্তি হয়না বোধকরি। যেমন বঙ্কিম বাবুকে বাঘ বা বিড়ালের মুখ দিয়ে নিজের কথা বলতে হয়েছিল। এটা যেমন আর্ট তেমনি পিঠ বাঁচানোরও উপায় ।বৈষ্ণবের গান তো শুধুমাত্র বৈকুণ্ঠের জন্য নয়। ...
সই কেমনে ধরিব হিয়া
আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায়
আমারই আঙিনা দিয়া ... এ কি শুধু রাধার কথা ? না কি আমার আপনার ; বা জুলফিকার ভাইয়েরও কথা ? 
অষ্টাদশ শতক রাষ্ট্রিক ঝড় ঝঞ্জার কাল ...এক পালা বদলের কাল । ইংরেজরা এদেশে গুটি গুটি পায়ে এসেছিল জাহাঙ্গীরের সময়ে । বসার জায়গা পায় শাজাহানের সময়ে । আরামে শোয়ার জায়গা করে নেয় অষ্টাদশ শতকে । এসময়ে কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হচ্ছে । প্রাদেশিক শক্তি মাথাচাঁড়া দিয়ে উঠছে । ঔরঙ্গজেব মারা যাচ্ছেন । মগদের আক্রমণ , বর্গীদের আক্রমণ হচ্ছে , ছিয়াত্তরের মন্বন্তর এসময়ে । গোঁদের উপর বিষফোড়া পলাশী , বক্সার ।
চলছে পুরাতন সাহিত্য শাখাগুলির ব্যর্থ অনুকরণ  অনুসরণ । নতুন এলো শাক্তপদাবলী , ধর্ম মঙ্গল ,ভারতচন্দ্র ।
সামাজিক চাপে মানুষ আর কান্তকোমল পদাবলী নয় ; শক্তির আরাধনা করতে চাইলেন । নূতন মঙ্গল ' নিয়ে এলেন ভারতচন্দ্র । দৈবী ভাবনা ক্ষীণ হতে শুরু করলো এসময়ে । শিবকে কৃষিকাজ  করতে দেখা গেল , ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতেও ছাড়লেন না ভারতচন্দ্র । এ শিব যেন কৈলাশপতি নন ; যেন কাটোয়ার শিবু ঠাকুর এবং পার্বতী ঠাকুরণ ।

          বলা যায় , অষ্টাদশ শতাব্দীতেই মঙ্গল কাব্যের বেড়ি ভাঙলেন ভারতচন্দ্র । নামে 'মঙ্গল' হলেও আন্তর্বৈশিষ্ট্যে মঙ্গলকাব্যের দেবীদের সাথে অন্নদার পার্থক্য বিস্তর । কবির আনুগত্যও দেবী অন্নদার প্রতি নয় ; অন্নদাতার প্রতি । বোঝা যাচ্ছিলো মঙ্গলকাব্যের দিন শেষ হয়ে আসছে।
ঊনিশ শতক , নবজাগরণের শতক । সাগরের ওপার থেকে উড়ে এসেছেন "বাংলার নবজাগরণের ঝড়ের পাখি " .... হেনরি ভিভিয়ান ডিরোজিও । সে দলে নাম লেখালেন কালীবাবু , মধুবাবুরা ।

কাব্যে ইতিহাস :
          এ সময়ের কবি ঈশ্বর গুপ্ত । যুগসন্ধির কবি । তাঁর এক হাত ধরে আছেন ভারতচন্দ্র ; অন্য হাত রঙ্গলাল । পদ্মিনী উপাখ্যানে শোনা গেল এক নতুন সুর । আধুনিকতার শুভলগ্ন । এলেন মধুসূদন । একেবারে স্যুটেড ব্যুটেড । লিখলেন মেঘনাদ বধ কাব্য ১৮৬১ । ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ / মহাবিদ্রোহ । মধুসূদন দত্ত নিশ্চয়ই মহাবিদ্রোহ দেখেছেন । প্রশ্ন হল ., মঙ্গল পান্ডে , নানা সাহেব , তাঁতিয়া টোপি প্রাণ দিচ্ছেন ; আর মধুসূদন রাম রাবণ স্বর্গ মর্ত্য ... এসব নিয়ে কাব্য লিখলেন ...কেন ? আসলে দেশভক্তি দেখানোর অন্য কোনো উপায় ছিল না । রাবণ ভালো কি মন্দ ... সে বিতর্ক ভিন্ন । রাবণ মেঘনাদ দেশ রক্ষার জন্য লড়াই করছেন..প্রাণ দিচ্ছেন ...সেটাই বড় কথা । সমীকরণটা এরকম বলা যায় ..... রাবণ,মেঘনাদ=নানা সাহেব ,তাঁতিয়া টোপি । আর রামের পক্ষ= ইংরেজ পক্ষ । আসলে রূপকে স্বদেশীদের সঙ্গে বিদেশীদের লড়াই । বৃত্রসংহারেও তাই ।
একপর বিহারীলাল । তার পরই তাঁর ভাবশিষ্য..এক আলোময় জগৎ । হ্যাঁ , রবি ঠাকুর ।দীর্ঘকাল তিনি বাংলা কবিতাকে শাসন করেছেন ... লালন করেছেন । বলা হয় , রবীন্দ্রনাথের পর প্রথম আধুনিক কবি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ।(সময় পেলে এ প্রসঙ্গে অন্য এক দিন বলবো )
উপন্যাসে ইতিহাস:
          ফোর্টউইলিয়ম কলেজ গোষ্ঠী , রামমোহন , বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় বাংলা গদ্য তখন বেশ পরিনত । ভাব প্রকাশে ছন্দের বাঁধনকে মুক্তি দিলো গদ্য । উপন্যাসের আতুড় ঘরে প্যারীচাঁদ কালীপ্রসন্ন । কলকাতার বাস্তব চিত্র এবং মৌখিক বুলির জ্যান্ত ছবি আমরা পেলাম ।যদিও সার্থক বাংলা উপন্যাসের সূচনা দুর্গেশ নন্দিনী'র মধ্য দিয়ে । লিখলেন রবি ঠাকুরও । কিন্তু উপন্যাসে তখন জমিদারদের রাজত্ব । বঙ্কিম সমকালে তারকনাথই একমাত্র ব্যতিক্রম । হাসিম শেখ , রামা কৈবর্ত বা নিতাই কবিয়াল , অভাগী কাঙালীদের সাহিত্যে স্থান পেতে একটু সময় লেগেছে । নিম্নবর্গের মানুষকে গুরুত্ব দেওয়ার ফলে বাংলা উপন্যাসের রক্তাল্পতা কমেছে মূলত তারাশঙ্করে এসে ।

          ঊনবিংশ শতক,  নবজাগরণের শতক । সতীদাহ রদ হচ্ছে , বিধবা বিবাহ চালু হচ্ছে , বাল্য বিবাহ বন্ধ হচ্ছে । যদিও বিদ্যাসাগরের বিয়ে ১৪ বছরে , বঙ্কিমের ১৩-র মধ্যে, রবি ঠাকুর বিয়ে করেছিলেন ১০ বছরের মেয়ে । বিদ্যাসারের চেষ্টায় নারীশিক্ষার ব্যবস্থা হচ্ছে । নারীমুক্তির চেষ্টা সাহিত্যেও চলছে । বীরবাহুর মা চিত্রাঙ্গদা মধুসূদনের নিজস্ব সৃষ্টি । আঙুল তুলছেন তিনি রাবণের বিরুদ্ধে । ১৮৬১ সালে ব্যাপারটা সহজ ছিলো না । আঙুল তুলেছেন জনা, তারা, কৈকেয়ী , মন্দোদরীরা ।
আধুনিকতা কাব্যে উপন্যাসে:
          আধুনিকতা বিষয়টা বেশ গোলমেলে । যদি শব্দটি 'অধুনা' থেকে আসে , তাহলে তো মুকুন্দরামও আধুনিক । বা যাঁর যাঁর সময়ে সে সে আধুনিক । তবে ১৭৬০ কে যদি মধ্য যুগের শেষ ধরা হয় , তাহলে তার পরবর্তীকাল আধুনিক । তবে বলা হচ্ছে ... কালের দিক থেকে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল এবং ভাবের দিক থেকে রবীন্দ্র প্রভাব মুক্তির প্রয়াসকে আধুনিকতা / আধুনিক যুগ বলা যায় ।
দেখা যাক রবীন্দ্র প্রভাব মুক্তির চেষ্টা কিভাবে হচ্ছে । .........
সচেতন ভাবে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের থেকে আলাদা হতে চেয়েছিলেন বা রবীন্দ্র কাব্যের বেড়ি ভাঙতে সচেষ্ট হয়েছিলেন ; তাঁরা হলেন .....
১) সত্যেন দত্ত
২) মোহিতলাল
৩) যতীন সেনগুপ্ত
৪) নজরুল ।
প্রশ্ন হল কিভাবে .....?
সত্যেন দত্ত ছন্দের দিক থেকে আলাদা হয়ে গেলেন । শ্বাসাঘাত বা লাফিয়ে চলা ডিঙিয়ে চলা ছন্দের প্রাধান্য তাঁর কাব্যে লক্ষ্য করা গেল । পাল্কীর গান বা ঝর্ণা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ । তিনি ছন্দের জাদুকর । তবে তিনি প্রচুর আরবি ফার্সী শব্দের ব্যবহার করলেন ; যা রবীন্দ্র সমসাময়িক কালে এত ঊজ্জ্বল ব্যতিক্রম ।
মোহিতলাল দেহবাদী কবি । শরীর বিহীন প্রেমের তিনি পূজারি নন । ভালবাসবেন একেবারে রক্তমাংস সহ । রবীন্দ্রনাথের ভাববাদী ভাবনার বিপ্রতীপে এ ভাবনার অবস্থান ।
দু:খের উপাসক যতীন সেনগুপ্ত । সবেতেই তিনি দু:খ খুঁজে পান । দু:খবাদী কবি তিনি । রবীন্দ্রনাথ ঔপনিষদিক ভাবনায় বিশ্বাসী ; আনন্দবাজারের মহারাজ ; যতীন্দ্রনাথ যেন দু:খের খরিদ্দার । অবশ্য শেষের দিকে তিনি খানিকটা বদলেছিলেন । মানসী , সোনার তরী, বলাকা'র পাশে মরুনায়া, মরুশিখা অন্যরকম বৈকি ।
রইলেন নজরুল । তিনি বিদ্রোহী কবি । সামাজিক , রাজনৈতিক, ধর্মীয় অবিচার অনাচারের বিরুদ্ধ তাঁর বিদ্রোহ । বাজেয়াপ্ত হয়েছে তার কাব্য । সে সময়ে বিয়ে করেছিলেন হিন্দুর মেয়ে ।২০১৭ সালেও অনেক রথীর পক্ষে কল্পনাও সম্ভব নয় । তবে নজরুল শুধু বিদ্রোহী কবি নন ; রোমান্টিক কবিও । আসলে তিনি আগুণ হাতে প্রেমের গান গেয়েছিলেন ।
নজরুল আর জীবনানন্দের জন্মসাল এক । বরং জীবনানন্দ মাস তিনেকের বড় । কিন্তু জীবনানন্দকে তথাকথিত আধুনিক কবি বলা হয়। এই আধুনিক কবিদের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বিংশ শতাব্দীতে সমাজ নানা কিছু দেখেছে। সামন্ততন্ত্র বিদায় নিচ্ছে । উদীয়মান ধনতন্ত্র। চিমনীর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঈশ্বরের আকাশ। করালীরা আর কাদা মাটি মাখেনা ; তেল কালী মাখে । জমিদারদের তাড়নায় কৃষক গফুর কাজ করতে চলে যায় ফুলবেড়ের চটকলে ।ফরাসী বিপ্লবের ঢেউ লেগেছে এপারেও । সুইনবার্ণ , ব্যোদলেয়ার, ওয়েস্ট ল্যান্ড'এর কবি টি.এস.এলিয়টের প্রভাব পড়ছে বাংলাতেও ।
শাশ্বত নীতি , মূল্যবোধ এবং ঈশ্বর বিশ্বাসে অভাবে অভাব দেখা গেল । মানুষ বুঝতে পারলো মানুষই মানুষকে মারছে । মানুষই বাঁচাতে পারে । ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ । অবশ্য এতে নেতিবোধও রয়েছে । সমস্ত আধুনিক শিল্পের মর্মে মর্মে এই যন্ত্রণাময় নেতিবোধ অনুভূত হয় । "বিরূপ বিশ্বে মানুষ নিয়ত একাকী"... সুধীন দত্ত।

আলোচক – কমলাকান্ত স্যার।

Share this